সকাল সন্ধ্যা: ‘বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের আইন ও আর্থিক বিধান মানতে উৎসাহিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র’। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার গত ২০ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেছেন। বাংলাদেশ এ বিষয়ে কিছু ভাবছে?
মাসুদ বিন মোমেন: আমাদের যে অভ্যন্তরীণ আইনকানুন আছে, সেটা মেনে চলার দায়িত্ব প্রাথমিকভাবে আমাদের নিজেদেরই। আমাদের এখানে দুর্নীতি দমন কমিশন, আদালত, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থা ছাড়াও প্রচলিত বিভিন্ন আইন রয়েছে। আমাদের নির্বাচন কমিশন রয়েছে— এ প্রতিষ্ঠানটির দ্বারা নির্ধারিত আচরণবিধি রয়েছে— নীতিমালা রয়েছে। জাতীয় সংসদেরও এমন আইন-বিধিমালা রয়েছে। এ বিষয়ে অন্য কোনও দেশের প্রত্যাশা থাকতে পারে। তবে আমরা আমাদের নিজস্ব বিধিবিধান ও আইন মেনে চলছি এবং নিজেদের প্রয়োজন ও প্রথা মাফিক স্বাভাবিক নিয়মেই চলব।
সকাল সন্ধ্যা: যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়মিত আসছে। সাংবাদিকরাও বাংলাদেশ নিয়ে প্রশ্ন করছেন। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিষয়টি নিয়মিতভাবে আলোচনায় আসছে। এছাড়াও দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বিষয়টি রয়েছে। এ বিষয়ে আপনার কাছ থেকে জানতে চাই।
মাসুদ বিন মোমেন: আপনি যেটা বলেছেন যে, কিছু প্রশ্ন বারবার করা হয়— এসব প্রশ্নকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রশ্ন বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। সুতরাং তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সবসময় এগুলো বলছে সেটিও সঠিক নয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ক্ষেত্রে— বিশেষ করে আমাদের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বা নির্বাচনের পূর্ববর্তী সময়ে কিছু কিছু বক্তব্য এসেছে।
আমরা মনে করি, যে কোনও দেশেরই তাদের সঙ্গে যেসব দেশের সুসম্পর্ক রয়েছে— তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশা থাকে। সেটা শুধু যুক্তরাষ্ট্র না, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, চীন, ভারত রাশিয়া— বড় বড় সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ রয়েছে— যারা বাংলাদেশকে গুরুত্ব দেয়। এদের সঙ্গে আমরা যখন দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ও যোগাযোগ করি— তখন কিছু কিছু ইস্যু নিয়ে আলাপ-আলোচনা করি, সেখানে যেমন— মানবাধিকার, শ্রমিক অধিকার, সুশাসন ছাড়াও বিনিয়োগ ব্যবস্থা কীভাবে আরও ভালো করা যায় এসব ইস্যুও থাকে।
কিন্তু কিছু দেশের নিয়ম আছে, তাদের মুখপাত্রের মাধ্যমে এসব আলোচনা পাবলিক ডোমেইনে এসে যায়। আবার কিছু কিছু দেশ আমাদের সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনা করে। এগুলো অফিসিয়াল ডোমেইনেই থেকে যায়। এটাই আসলে পার্থক্য।
সকাল-সন্ধ্যা: যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক ব্যুরোর উপ-সহকারী মন্ত্রী আফরিন আখতার বাংলাদেশ সফর করেছেন সম্প্রতি। এ সময় নানাবিষয়ে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা হয়েছে। এছাড়াও মার্চে কয়েকজন পশ্চিমা কূটনীতিক বাংলাদেশ সফর করবেন। নতুন সরকার গঠনের দুইমাসের মধ্যে এমন কূটনৈতিক সম্পর্ককে আপনি কীভাবে দেখছেন?
মাসুদ বিন মোমেন: জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অনেক ধরনের জল্পনা-কল্পনা ছিল। গুজবও ছিল— বাংলাদেশকে স্যাংশন দেওয়া হবে, সরকার পরিবর্তনের জন্য বিদেশ থেকে চাপ রয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন আমরা সবাই বুঝতে পারছি যে, এগুলো নিছক জল্পনা-কল্পনাই ছিল। তাছাড়া আমাদের জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি অবাধ এবং সুষ্ঠু হয়েছে— অংশগ্রহণমূলক হয়েছে। আমাদের এই নির্বাচন শান্তিপূর্ণও হয়েছে। ৪০ শতাংশের বেশি নাগরিক ভোট দিয়েছে। অনেক উন্নত দেশেও ভোট দেওয়ার হার এত হয় না। ফলে প্রায় সবাই ধরে নিয়েছে, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায়ও কোনও ঘাটতি ছিল না। তাদের আন্তরিকতা ও অঙ্গীকারের কোনও অভাব ছিল না। বিভিন্ন দেশ থেকে যে নির্বাচন পর্যবেক্ষকগণ কিংবা বিভিন্ন দেশের নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসেছিলেন— তারা কিন্তু এক বাক্যে স্বীকার করেছেন যে, কোনও একটি নির্দিষ্ট দল অংশগ্রহণ না করলেও নির্বাচনের আয়োজনটা খুব সুষ্ঠু ও অবাধ ছিল।
পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি, প্রতিবেশী দেশগুলোতো আছেই— তাছাড়া বিভিন্ন দেশ নিবার্চনে জয়লাভ করে নতুন সরকার গঠন ও পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন। কয়েকদিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় অভিনন্দন জানিয়েছেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইন।
নির্বাচন পরবর্তী পর্যায়ে এখন বিভিন্ন দেশ বলছে, তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চায়— সম্পর্ক নবায়ন করতে চায়। এরই অংশ হিসেবে তারা বাংলাদেশ সফর শুরু করে দিয়েছে— সামনে আরও আসবে।
সকাল সন্ধ্যা: বাংলাদেশের নতুন সরকারকে ‘অভিনন্দন’ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর কয়েকদিন পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাঠানো এক চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। প্রধামন্ত্রীকে দেওয়া চিঠিতে বাইডেন লিখেছেন, ‘‘একটি অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক ( Indo-Pacific) অঞ্চলের জন্য অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে (যুক্তরাষ্ট্র) অংশীদার হতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’’ আমরা জানি যে, এ অঞ্চলে ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চতুর্পক্ষীয় সামরিক জোট ‘কোয়াড’-কে (QUAD) শক্তিশালী করতে সক্রিয় রয়েছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি’ নিয়ে অংশীদার হওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ কীভাবে দেখছে?
মাসুদ বিন মোমেন: আসলে Indo-Pacific, QUAD এগুলো একেকটা ধারণা— কোনও স্পষ্ট ও পরিষ্কার জোট নয়— সদস্য করা বা না করার বিষয়টি সেজন্য আলোচনায় নেই। আপনি যে ‘কোয়াড’-এর কথা বললেন— এটি চারটি মাত্র দেশের, সামরিক বা নিরাপত্তাকেন্দ্রিক একটা ধারণা নিয়ে তারা কাজ করছে। বাংলাদেশ যেহেতু সামরিক কোনও জোটের মধ্যে যোগ দেয়নি সুতরাং এই জোটেও আমাদের যোগ দেওয়ার আগ্রহ নেই। তবে ইন্দো-প্যাসিফিকের যে ধারণা আছে, সেখানে অনেক অর্থনৈতিক উপাদান আছে। যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিকের ধারণা নিয়েও একটি চিঠি দিয়েছে। সেখানেও কিন্তু যোগদানের বিষয়ে কোনও আমন্ত্রণ বা এমন কিছু নেই। এটা আসলে যুক্তরাষ্ট্র যাদেরকে তার সমমনা দেশ মনে করে— অর্থনৈতিক জোট, অন্যান্য জোট বা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে তারা কী করতে চায়— সেই বিষয়ে তারা মতামত দিয়েছে। এ বিষয় নিয়ে বিভিন্ন দেশও তাদের মতামত দিয়েছে।
গত বছর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের প্রাক্কালে আমরাও আমাদের ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা উপস্থাপন করেছি। আমরাও এখানে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চাই, অবাধে জাহাজ বা পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা চাই। এখানে সামরিক বা অন্য কোনও বাধা যেন না থাকে বা এমন কোনও পরিস্থিতির যেন সৃষ্টি না হয়। সামুদ্রিক যে সম্পদ আছে সেটা যেন ন্যায়সঙ্গতভাবে অন্বেষণ করা যায়।
আমাদের পররাষ্ট্রনীতির যে মূল মন্ত্র— ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’। আমাদের ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখার সঙ্গে অন্যান্য দেশের রূপরেখার অনেক বিষয়ের মিল রয়েছে। আমরা একটি বিষয়ের ওপর বেশ জোর দিয়েছি সেটা হলো যেন ‘একপাক্ষিক’ কিছু না হয়। এ অঞ্চলের সবগুলো দেশ যেন এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে— যেন অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়। কোনও একটি নির্দিষ্ট দেশকে বাদ দিয়ে এটা করার চেষ্টা করার প্রবণতার সঙ্গেও আমরা একমত নই।
সকাল সন্ধ্যা: এরই মধ্যে মিয়ানমারে যুদ্ধ-সংঘাত নিয়ে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। তিনি এ অঞ্চলে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের নিরাপত্তা নিয়েও আলোচনা করেছেন। আপনি বললেন যে, বাংলাদেশের এ অঞ্চলের সব দেশের নিরাপত্তার বিষয়ে চিন্তা আছে। সংঘাতপূর্ণ এ অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে কী ভাবছে বাংলাদেশ?
মাসুদ বিন মোমেন: আপনি ডোনাল্ড লু’র বক্তব্যের একটি অংশ নিয়ে বলেছেন। তার বক্তব্যের অন্য একটি অংশে দৃঢ়ভাবে উঠে এসেছে যে, বাংলাদেশ দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। তাদের প্রতি যে উদার আচরণ করছে গত ছয় বছরের বেশি সময় ধরে এটার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তিনি। সাম্প্রতিক প্রেক্ষপটে নিরাপত্তার মাত্রা যে গুরুতর অবস্থা ধারণ করতে যাচ্ছে তিনি সে সম্পর্কে বলেছেন।
মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আছে, ভারত আছে, চীন আছে, থাইল্যান্ড ছাড়াও আরও কিছু দেশ আছে। এটা ভাবাতো স্বাভাবিক যে, মিয়ানমারে বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আমরা রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দিতে পারি। তিন বছর আগে যে সামরিক সরকার দেশটিতে আসল— আমরা তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা থামিয়ে দেইনি। কারণ প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যতটুকু সুসম্পর্ক রাখা যায়, সেই চেষ্টা আমাদের সবসময় থাকে। কোনও রকমের প্ররোচণা বা উস্কানিতে আমরা সাড়া দেই না— কোনও রকম প্রতিক্রিয়াও আমরা দেখাই না। যদিও পশ্চিমা বিশ্বের অনেকেই সেই সময় স্যাংশন বা অনেক কিছুই করেছে।
গত দুই-তিন মাস ধরে রাখাইন রাজ্যে আরাকান সেনাবাহিনীর (AA) যে অংশটি আছে, তাদের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষীদের সংঘাত বাড়ছে— যদিও এর আগে তাদের মধ্যে একটা ‘যুদ্ধ বিরতি’ কাজ করছিল। কিন্তু গত কয়েকমাস ধরে আমরা দেখছি যে, যুদ্ধ বিরতিটা আর তেমনভাবে কার্যকর নয়। যার কিছু বাড়তি প্রভাব আমাদের এখানেও আসছিল।
ভারতের মতো মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সীমানায় অনেকটা ‘জিগজ্যাগ’ আছে। এর ফলে যে কোনও সময় গোলাগুলি, আকাশ সীমা লঙ্ঘন হয়ে যেতে পারে। এ কারণে আমাদের এখানে দুইজনের মৃত্যুও হয়েছে। যার ফলে অবশ্যই একটা নিরাপত্তার সংকট তৈরি হচ্ছে। সামনে কী হবে সেটি এখনই বলা যাবে না।
আমরা মিয়ানমারের কাছে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছি সম্প্রতি। আমরা এটাও দেখেছি যে, আমাদের বিজিবির বর্ডার পোস্টে মিয়ানমার থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাঁচার তাগিদে চলে এসেছিল, তাদেরকে আমরা অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দিয়ে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ৩৩০ জনকে ফিরিয়েও দিয়েছি। এখনও কিছু কিছু জায়গায় সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে কিছু রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে।
আমাদের অবস্থান এখন নতুন করে কোনও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় না দেওয়া। সেইভাবে সীমান্তে ঘোষণা করা হচ্ছে। আমাদের সীমান্ত রক্ষীরাও এই বিষয়ে সতর্ক। তবে সামনে যদি পরিস্থিতি খারাপ হয়, তাহলে এটা আমাদের জন্য খুবই দুঃচিন্তার বিষয়।
সকাল সন্ধ্যা: গণহত্যার মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর বৃহত্তম ‘শরণার্থী শিবির’ পরিচালনা করছে। কিন্তু সাত বছরেরও বেশি পেরিয়ে গেলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনও অগ্রগতি হয়নি। এই বিষয়ে বাংলাদেশ কী করার কথা ভাবছে?
মাসুদ বিন মোমেন: প্রত্যাবাসনে যে অগ্রগতি হয়েছে সেটিতো আপনারা জানেন। একটা ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ-মিয়ানমারকে চীন এই বিষয়টি নিয়ে সহযোগিতা করছে। আমরাও চেয়েছি, চীনকে সঙ্গে রাখলে সমাধানটা টেকসই হতে পারে।
এরপর এ বিষয়ে অগ্রগতিও ছিল। যেমন— এখান থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে ওখানে কোথায় রাখা হবে তা তারা দেখে এসেছে। মিয়ানমারের কর্মকর্তারাও দুইবার করে ঘুরে গেছে। আলাপ-আলোচনা চলার মধ্যে গত বছরের শেষে প্রতীকীভাবে একটি দলকে পাইলট হিসেবে প্রত্যাবাসনের কথাও ছিল। কিন্তু এর সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়টি ওতপোত্রভাবে জড়িত। এক্ষেত্রে নিরাপত্তার যদি সমস্যা থাকে, তাহলেতো রোহিঙ্গারা সেখানে যাবে না। নিরাপত্তার পরিস্থিতিও স্থিতিশীল নয়।
এ অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কিছুটা থমকে আছে। মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এবং জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্পের (ইউএনডিপি) মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনেক দিন মুলতবি ছিল। তবে গত দুই মাস আগে এ চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তাই রোহিঙ্গারা ফিরে গেলে তাদের দেখাশোনার বিষয়ে ইউএনএইচসিআর, ইউএনডিপি ও জাতিসংঘের কিছু দায়িত্ব নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
অবশ্য, সাম্প্রতিককালে যে সংঘাত হচ্ছে, তাতে পুরো বিষয়টি কিছুটা অনিশ্চয়তার মুখে। তবে আমরা প্রস্তুত আছি। আমরা কাউকে জোর করে সেখানে ঠেলে দিব না— নিরাপত্তার অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলব না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও সেটিই প্রত্যাশা।
সকাল সন্ধ্যা: রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আমাদের চীনের সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। এ দেশটির বিষয়ে পশ্চিমাদের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এই অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের সামনে কী কী পথ খোলা রয়েছে বলে মনে করেন?
মাসুদ বিন মোমেন: পশ্চিমা বিশ্বের তো বিভিন্ন ধরনের দৃষ্টিকোণ থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে চীন ও রাশিয়ার বিষয়ে তারা একটি বিশেষ অবস্থান নিয়েছে। তবে আমাদের অঞ্চলে বাস্তবিক যে বিবেচনাগুলো আছে— রাষ্ট্রীয় যে বিষয়গুলো আছে— সেই অনুযায়ী আমরা কাজ করছি। শুধু চীন নয়, আমরা ভারতের সঙ্গেও যোগাযোগ রেখেছি। মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি ভারত সফর করেছেন। ওই সময়েই এসব বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে। সামনে এটা নিয়ে আরও আলোচনা হবে।
মিয়ানমারের বিদ্রোহ ও সংঘাতের ফল ভারতকে প্রভাবিত করছে। মিজোরামে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেছে। তাদেরকে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। মিজোরামের সঙ্গে মিয়ানমারের একটা প্রদেশ আছে যেটি দিয়ে অবাধ যাওয়া-আসার বিষয় ছিল। সেটিও তারা স্থগিত করেছে।
অবস্থা এমন যে এটা শুধু বাংলাদেশকে প্রভাবিত করছে না, ভারতকেও প্রভাবিত করতে শুরু করেছে। চীনের সঙ্গেও মিয়ানমারের অনেক বড় সীমান্ত রয়েছে। সেখানে বিদ্রোহ-সংঘাতের সমস্যা রয়েছে।
আমরা শুধু চীনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছিলাম তা নয়। আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি চীনের উপস্থিতিতে আলোচনা করেছি। ভারতের সঙ্গেও আমরা আলোচনা এগিয়ে নিচ্ছি।
এ নিয়ে আমরা জাপানের সঙ্গেও আলোচনা করেছি— কোরিয়ার সঙ্গেও আলোচনা করেছি। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে আমরা কথা বলে যাচ্ছি। মিয়ানমারও আসিয়ানের সদস্য। শুধু মানবিক অবস্থান থেকে নয়, রাজনৈতিক অবস্থান থেকে যে যার মতো বিষয়টি সমাধানের দিকে এগিয়ে যায়, তাহলে এটি এই পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও অর্থনীতির জন্য ভালো হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে বাংলাদেশ involved হবে না। জড়িয়ে পড়বে না।
সকাল সন্ধ্যা: সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জার্মানিতে নিরাপত্তা সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। এতে আলোচিত বিষয় ছিল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির দ্বি-পাক্ষিক বৈঠক। ইউক্রেইনের সার্বভৌমত্বের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী একমত প্রকাশ করেছেন। এছাড়া দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এ বৈঠকটি কেমন হয়েছে?
মাসুদ বিন মোমেন: বৈঠকটি খুব ভালো হয়েছে। ইউক্রেইনের পক্ষ থেকে বৈঠকটির অনুরোধ এসেছিল। তারা মিউনিথ নিরাপত্তা সম্মেলনের বড় অংশ জুড়ে আলোচনায় ছিল। সেইদিকে থেকে এটাও স্বাভাবিক যে, তারা যেন সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বেশিরভাগ দেশের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে আমাদের দেশের পররাষ্ট্রনীতির কথা তুলে ধরেছেন। তিনি আমাদের দেশের অভিজ্ঞতার কথাও পুনর্ব্যক্ত করেছেন। যুদ্ধ কারও জন্য মঙ্গল নিয়ে আসে না, সেটি তিনি তার অভিজ্ঞতা থেকে তুলে ধরেছেন।
প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিও সেটা মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কীভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটানো যায় সে বিষয়ে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। শুধু এই বৈঠক নয়, ব্রাসেলসে প্রকাশ্য বৈঠকেও তিনি এ কথা বলেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যুদ্ধের কারণে সেই অঞ্চলের নারী-শিশুসহ সকলেই বিপদগ্রস্ত হচ্ছে। এ যুদ্ধ থেকে যারা দূরে আছে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে স্যাংশন-কাউন্টার স্যাংশন হচ্ছে— অর্থনীতিতে নানা রকম বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে।
যুদ্ধের কারণে যে পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এর মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটছে। এ কথাও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে বলেছেন। এ সময় প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেছেন, চলমান যুদ্ধের অবসান ঘটাতে তারা রাশিয়ার সঙ্গে অনেক বৈঠক করেছেন। তাতে করে দৃশ্যমান কোনও ফল পাওয়া যায়নি বলে তিনি স্বীকার করেছেন।
বৈঠকে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে, স্থিতিশীলতা আসলে বাংলাদেশের সঙ্গে ইউক্রেইনের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাবে। গম লাগলে তারা তা দিতে প্রস্তুত রয়েছেন বলেও জানিয়েছেন।
সকাল সন্ধ্যা: রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন ইস্যু ছাড়াও বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক দেশ চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ গভীর বাণিজ্যিক সম্পর্কে যুক্ত আছে দীর্ঘদিন থেকে। কিন্তু চীনে রপ্তানিতে অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। এমন অর্থনৈতিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার ক্ষেত্রে কতটা সহায়ক?
মাসুদ বিন মোমেন: অর্থনৈতিক এ সম্পর্ক আরও একটু ভারসাম্যপূর্ণ হওয়া উচিত। চীনে আমরা যেন আরও বেশি রপ্তানি করতে পারি সেজন্য তারা বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। ৯৮ শতাংশ ট্যারিফ লাইন-ডিউটি ফ্রি করে দিয়েছে— সামনে আরও হয়তো দেবে। কিন্তু বাস্তবতা যেটা হচ্ছে, এটা শুধু বাংলাদেশের জন্য সত্য নয়, বিশ্বের প্রায় দেশের ক্ষেত্রেই এটা সত্য যে, চীন কম খরচে অনেক পণ্য রপ্তানিতে অত্যন্ত সক্ষম একটি দেশ।
আমরা করোনা মহামারির সময়ও দেখেছি— যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধ শিল্পে Active Parmaceutical Ingredient এর একটা বড় অংশ চীন থেকে আসতো। করোনা ভ্যাকসিন উৎপাদানের ক্ষেত্রেও আমরা এ বিষয়টি দেখেছি।
এটা আমাদের জন্য অবশ্যই চিন্তার বিষয় যে, অর্থনীতিতে আমাদের সঙ্গে চীনের ভারসাম্যহীনতা আছে। ভারতের সঙ্গেও আমাদের একই অবস্থা ছিল। তবে গত কয়েক বছর ধরে ভারতে আমাদের রপ্তানি দ্রুত গতিতেই বাড়ছে। চীনও এ বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
আমরাও চাই, আমাদের রপ্তানিকে বহুমুখী-বৈচিত্র্যপূর্ণ করতে। আমাদের যে রপ্তানি তার ৮৫ শতাংশ পোশাকখাতের। যেটি আমাদেরকে নানাভাবে ‘অসুরক্ষিত’ করে তুলছে। এছাড়াও আমরা আমাদের রপ্তানির গন্তব্যকেও বহুমুখী করে তুলতে চাই। কারণ পোশাকখাতের রপ্তানির বেশিরভাগ অংশ মাত্র কয়েকটি বড় দেশে যাচ্ছে। এটার মধ্যে নানারকম ঝুঁকি দেখা যাচ্ছে। যদি সেই স্বল্পসংখ্যক দেশে কোনওভাবে অর্থনৈতিক মন্দা চলে তাহলে তো সেখানে রপ্তানি কমে যাবে। দ্রুতই তার প্রভাব আমাদের এখানেও পড়ে।
তাই আমাদের রপ্তানির আরেকটি গন্তব্য হতে পারে আফ্রিকা মহাদেশ। এছাড়া ল্যাটিন আমেরিকা আছে, সেন্ট্রাল এশিয়াও আছে। এমন অনেক দেশ আছে, যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন ভালো। এ অবস্থার মধ্যেই ২০২৬ সালে আমাদের এলডিসি থেকে উত্তরণের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। যেটা সর্বোচ্চ ২০২৯ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করা যাবে। ফলে আন্তর্জাতিক সহায়তা যা আছে, এলডিসি হিসেবে যে সুবিধাগুলো আমরা পাচ্ছি— সেগুলো কিন্তু তখন উঠে যাবে। এ জন্য আমরা এখন থেকে এটা মোকাবেলা করতে প্রস্তুত হচ্ছি।
এছাড়া যেসব আঞ্চলিক জোট-সংস্থা আছে— বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বা অন্য বিষয়ে চুক্তি ও ব্যবস্থা আছে সেগুলো নিয়ে আরও কাজ করতে হবে— জোরালো করতে হবে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক। জাপানের সঙ্গে, ভারতের সঙ্গে এ কাজগুলো শুরু হয়ে গেছে। এগুলোতে আরও জোর দিলে দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যে আরও ভারসাম্য আসতে পারে।
এটা আমাদের ভুললে চলবে না যে, আমাদের যথেষ্ট সক্ষমতা ও শক্তি রয়েছে। যদিও এখন আমাদের মূল্যস্ফীতি চলছে। সেটার যদি লাগাম আমরা আর একটু টেনে ধরতে পারি, আমাদের নানারকম যে সীমাবদ্ধতা আছে— সেটাকে যদি আমরা আর একটু নিয়ন্ত্রণে আনতে পারি, তাহলে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি আরও একটু স্থিতিশীল হবে। আমাদের যে ক্যাপিটাল ফ্লাইটের ইস্যু আছে, মানি লন্ডারিং ইস্যু আছে— এগুলো জোরালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
সকাল সন্ধ্যা: আপনার কথার সূত্র ধরেই বলি, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক গভীর বন্ধুত্বের। তারপরও দীর্ঘদিন ধরে কিছু কিছু বিষয় অমীমাংসিত। বাংলাদেশে নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে একসঙ্গে কাজ করছে। এছাড়া ভারতের সঙ্গে আমাদের আর্থিক ঋণ নেওয়ার সম্পর্ক আছে। সম্প্রতি এক বৈঠকে এ ঋণে গতি আনতে দুই দেশই একমত হয়েছে। এ অবস্থায় ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিরসনে বাংলাদেশ কতটা সফল হবে বলে আপনি আশাবাদী?
মাসুদ বিন মোমেন: যে কোনও প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে নানা ধরনের ইস্যু থাকবে। আমরা এসব বিষয় নিয়েই অগ্রসর হবো, একসঙ্গে কাজও করে যাচ্ছি। আমাদের দেখতে হবে যে, দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে সেই রাজনৈতিক আকাঙক্ষাটা আছে কিনা। কিংবা সমঝোতা করার মনোবৃত্তি আছে কিনা।
আমাদের দেশে নির্বাচন হয়ে গেল— ভারতের নির্বাচন আগামী এপ্রিল-মে মাসে। তাদের নির্বাচিত নতুন সরকারের সঙ্গে আমরা সকল বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। কিছু আলোচনা আমরা এখনই শুরু করেছি। এর কিছু ভালো ফলও আমরা পেয়েছি। আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা, বন্দর ব্যবহারে, জ্বালানি আনার ক্ষেত্রে সুবিধা পাচ্ছি। আমরা নেপাল ভুটানের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা পাচ্ছি। কারণ আমাদের সঙ্গে দেশ দুইটির কোনও সীমান্ত নেই।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে আমাদের মিউনিখে দেখা হয়েছে। সেখানে ‘লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি)’ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘উই ক্যান রিভিজিটস সাম অব আওয়ার প্রজেক্টস। উই ক্যান টেক আ ফ্রেশ লুক।’ আমরাও এমন কোনও উদ্যোগ নিতে পারি, যেটা পুরো এ অঞ্চলের জন্য ভালো হবে। এছাড়া ‘এলওসি’কে গতিশীল করতে যেসব প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা আছে সেগুলো চিহ্নিত করে সমাধান নিয়েও আমরা কাজ করছি।
সকাল সন্ধ্যা: চীনের বিষয়ে বাণিজ্যিক সম্পর্কের সূত্র ধরে আপনি আফ্রিকা মহাদেশে সুযোগ অন্বেষণের কথা বলেছেন। এরই মধ্যে ভারত ও চীন নানাভাবে আফ্রিকায় কাজ করছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের কতটা অগ্রগতি হলো?
মাসুদ বিন মোমেন: আমাদের এ বিষয়ে ইচ্ছা আছে। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে ভারত-চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যাওয়া সম্ভব নয়। ভারতের সঙ্গে আফ্রিকার দেশগুলোর সম্পর্ক আজ থেকে দুইশ বছর আগের তা আমরা সবাই জানি। ভারত-আফ্রিকা দুই জায়গাতেই ব্রিটিশদের কলোনি ছিল। মহাত্মা গান্ধীও আফ্রিকাতে আন্দোলন করেছেন। তাদের উদ্যোক্তা ও বিভিন্ন পেশার মানুষ অনেক আগে থেকেই সেখানে আছে। চীনও সেখানে দ্রুত গতিতে বিনিয়োগসহ নানা উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
আফ্রিকায় মাত্র ১০টি দেশে বাংলাদেশের মিশন আছে। যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে সুদানে আমাদের মিশন সাময়িকভাবে তুলে নিতে হয়েছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং নিয়ে কথা বলছি। এটা করতে হলেও কিছু বিনিয়োগ করতে হবে। এ বিষয়ে আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছুটা নমনীয় হতে হবে। আফ্রিকার সবগুলো দেশে যে সম্ভাবনা আছে তা নয়। ইথিওপিয়ায় বাংলাদেশের এক প্রতিষ্ঠান পোশাক কারখানা করেছিল। কিন্তু যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে সেটি সফল হয়নি। তবে এরই মধ্যে কেনিয়াতে স্কয়ার ওষুধ কারখানা করেছে।
আরেকটি বিষয় দেখবেন যে, আমাদের জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনগুলো খুব ভালো কাজ করেছে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। তারা সেই সব দেশের স্থানীয় মানুষদের হৃদয়-মন জয় করে নিয়েছে। এর ফলেও আমাদের সুযোগ তৈরি হয়েছে। সিয়েরা লিওন আমাদের বাংলা ভাষাকে তাদের একটি দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
উগান্ডায় আমাদের এনজিও ‘ব্র্যাক’ ও ‘আশা’ ভালো কাজ করছে। এভাবেও ধীরে ধীরে আমাদের কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। শীঘ্রই আমরা অর্থনৈতিক সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে একটি ব্যবসায়ী দল আফ্রিকায় পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি।
সকাল সন্ধ্যা: ২০২৬ থেকে ২০২৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটবে। এর ফলে যে চ্যালেঞ্জগুলো সামনে আছে তা মোকাবেলা করতে বিশ্বের বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক জোটগুলোর সঙ্গে এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ার বিষয়ে আপনি বলেছেন। যদিও এ অঞ্চলে ‘সার্ক’-এর কার্যক্রম অনেকদিন ধরেই নেই। আমরা ‘দ্য বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকিনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন (বিমসটেক)’ এর সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশ তাহলে কীভাবে বিভিন্ন আঞ্চলিক জোটগুলোর সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে অগ্রসর হতে পারে?
মাসুদ বিন মোমেন: বাংলাদেশ সবসময় আঞ্চলিক জোটগুলোকে গুরুত্ব দিয়েছে। সার্ক প্রতিষ্ঠার সঙ্গে আমরা যুক্তও ছিলাম। কিন্তু আমরা এখন সবাই জানি, কী কারণে এখন সার্ক আর এগিয়ে যেতে পারছে না। অন্যদিকে বিমসটেক নিয়ে আমরা অনেক এগিয়ে গেছি। এ সংস্থাটির পরবর্তী চেয়ারম্যান হবে বাংলাদেশ। আমরা ‘আসিয়ান’-এর Sectoral Dialogue পার্টনার হওয়ারও চেষ্টা করছি। এ জোটের সদস্যভুক্ত দেশগুলো থেকে এ বিষয়ে আমরা ভালো সাড়া পেয়েছি।
সকাল সন্ধ্যা: আপনি বলেছিলেন, পরবর্তী ধাপে ‘ব্রিকস’র সদস্য হতে পারবে বাংলাদেশ। এছাড়া ব্রিকস ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ঋণও নিয়েছে। এ সংস্থার সদস্য হতে কতটা অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়েছে?
মাসুদ বিন মোমেন: ব্রিকস থেকে আমরা সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। আমরা এ বিষয়ে কাজ করছি। তবে ব্রিকস’-এর যে ব্যাংকটি রয়েছে আমরা ইতোমধ্যে সেটির সদস্য হয়েছি। এ ব্যাংক থেকে আমরা আগেও ঋণ পেয়েছি— আরও পাচ্ছি। সুতরাং আমরা সদস্যপদ পেলাম কি পেলাম না— এর জন্য কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আটকে নেই। বরং এটা বেশ ভালোভাবেই চলছে। তবে সদস্যপ্রাপ্তির বিষয়টি একটু সময় সাপেক্ষ এবং এর বেশ কিছু ধাপ রয়েছে। আমরা এ বিষয়ে সক্রিয় রয়েছি।
সকাল সন্ধ্যা: বিশ্বের ৩৬তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নিঃসন্দেহে এখন বহুমাত্রিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী অর্থনৈতিক কূটনীতির প্রতি জোর দিতে বলেছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কীভাবে কাজ করবে?
মাসুদ বিন মোমেন: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অর্থনীতিকে আমাদের কূটনীতিতে প্রধান উপাদান করার কথা বলেছেন। আগে ছিল রাজনৈতিক কূটনীতি। সেক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে যেসব বিষয় আছে, তার জন্য আমাদের সাবেক পন্থাগুলোকেও রাখতে হবে। পজেটিভ ইমেজ নিয়ে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শ্রমশক্তি— এই তিনটি বিষয়কে আমাদের সামনে আনতে হবে। কোথায় কীভাবে আমরা এসব নিয়ে কাজ করব— সেটিও ঠিক করতে হবে।
আগে যেমন মধ্যপ্রাচ্য মনে করত, আমাদের শুধু সস্তা শ্রম আছে। আগে তারা আমাদের অতটা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু গত ১০ বছরে এ অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগের থেকে অনেক বেশি ওই দেশের ব্যবসায়ীরা আমাদের এখানে আসছেন— বিনিয়োগ আসছে। তারা দেখছে, বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে।
সকাল সন্ধ্যা: ৫২ বছর পেরুনো বাংলাদেশের কূটনীতি এখন কতটা পরিণত হয়েছে? আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে তাল মিলাতে বাংলাদেশের বর্তমান কূটনীতিতে এই সময়ের চ্যালেঞ্জগুলো কী বলে মনে করেন?
মাসুদ বিন মোমেন: চ্যালেঞ্জ তো থাকবেই। আমি মনে করি, আমাদের কূটনীতিতে বড় ধরনের একটা রূপান্তর ঘটে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের লক্ষ্য ছিল পুননির্মাণ, পুর্নবাসন। প্রাথমিকভাবে দাতানির্ভর দেশ হিসেবে আমরা পরিচিত ছিলাম। আশির দশক থেকে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়তে থাকল, বাড়তে থাকল আমাদের সক্ষমতা। নব্বইয়ের দশক থেকে আমাদের এখানে বিনিয়োগ বাড়তে থাকল। এর ফলে আমাদের সম্পর্ক আর একটু বিস্তৃত হলো।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জাপানের সঙ্গে প্রাথমিক অবস্থায় আমাদের সম্পর্ক ছিল দাতা-গ্রহীতার। এরপর ধীরে ধীরে তাদের কাছ থেকে বিনিয়োগ আসতে থাকল। আমরা তাদের সঙ্গে কমপ্রিহেনসিভ পার্টনারশিপে গেলাম। গত বছর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের সময় আমরা কৌশলগত অংশীদার হলাম।
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অনেক দেশের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদার হিসেবে এখন কাজ করছি। যার মধ্য দিয়ে আমরা দাতানির্ভর দেশ থেকে ব্যবসা নির্ভর সম্পর্ক— এরপর ব্যবসা বিনিয়োগ নির্ভর সম্পর্ক থেকে এখন আমরা কৌশলগত অংশীদারের পর্যায়ে পৌঁছেছি। এছাড়া বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমরা আন্তর্জাতিক অনেক বিষয়ে এখন একসঙ্গে কাজ করছি।
একটি দেশের সঙ্গে আরেকটি দেশ যখন এমন একটি সম্পর্কে পৌঁছায়, তখন কিন্তু অসম কিছু থাকে না। সকল ক্ষেত্রে সমানভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে। অর্থনীতির একজন ছাত্র হিসেবে আমি মনে করি, ২০৪১ সালের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আমাদের সবাইকেই দরকার। সকলের সঙ্গেই বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় করতে হবে।
সকাল সন্ধ্যা: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মাসুদ বিন মোমেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।