ঋণের গুণগত মান বাড়াতে দেশে প্রথমবারের মতো বেসরকারি খাতে ক্রেডিট ব্যুরোর লাইসেন্স দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যক্তি উদ্যোগে এ ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স পেতে আগামী ১ জুলাই থেকে আবেদন করা যাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জারি করা নীতিমালা অনুসারে এই আবেদন করতে হবে।
নীতিমালা অনুযায়ী, বেসরকারি ক্রেডিট ব্যুরোর লাইসেন্স পেতে উদ্যোক্তাদের নাম-ঠিকানা, কর সংক্রান্ত তথ্য, প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনাসহ আবেদন করতে হবে। প্রতিটি আবেদনের ফি বাবদ বাংলাদেশ ব্যাংককে অফেরতযোগ্য পাঁচ লাখ টাকা দিতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের গুণগত মান বাড়াতে বেসরকারি খাতে ক্রেডিট ব্যুরো স্থাপনের জন্য নীতিমালা জারি করা হয় গত ৫ জুন। ওই নীতিমালা অনুযায়ী এ ধরনের প্রতিষ্ঠান দেশের ব্যাংক গ্রাহকদের লেনদেনের তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। একই সঙ্গে কোনও গ্রাহক ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণ নেওয়ার জন্য আবেদন করলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ক্রেডিট ব্যুরোর কাছ থেকে ওই গ্রাহকের লেনদেনের তথ্য সংগ্রহ করে ঋণ ঝুঁকি পর্যালোচনা করতে পারবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি খাতে ক্রেডিট ব্যুরোর নিবন্ধন দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এটা অধিকাংশ দেশেই আছে। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতেও আছে।”
তিনি বলেন, “গ্রাহকের লেনদেনের তথ্য এবং আর্থিক তথ্যের মধ্যে কিছু ভিন্নতা আছে। একজন গ্রাহক ব্যাংকের সঙ্গে যে ধরনের লেনদেন করে তার বাইরেও কিছু তথ্য থাকে। ওই গ্রাহক কোন ধরনের দোকানে কেনাকাটা করেন, একটি নির্দিষ্ট সময়ে কত ব্যয় করেন, এরকম অনেক তথ্যই গ্রাহকের আর্থিক তথ্যের মধ্যে পড়ে।
“একটি ব্যাংকের পক্ষে যেহেতু এসব তথ্য জোগাড় করা সম্ভব হয় না, এ কারণে বেসরকারি ক্রেডিট ব্যুরোর লাইসেন্স দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালাও জারি করা হয়েছে।”
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইবি) স্বল্প পরিসরে কিছু তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। এতে কোনও গ্রাহকের খেলাপির তথ্য বা কোন ব্যাংকে কত ঋণ আছে তা উল্লেখ থাকে। তবে ওই গ্রাহকের লেনদেনের আচরণগত অনেক তথ্যই থাকে না। বেসরকারি খাতের এসব ক্রেডিট ব্যুরো প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের লেনদেনের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে।
বর্তমানে আর্থিক খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), মেশিন লার্নিং, বৃহত্তর তথ্য পর্যালোচনার প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বেসরকারি ক্রেডিট ব্যুরো প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের ঋণ ঝুঁকির একটি পর্যালোচনা তৈরি করতে সক্ষম হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে ৬১টি ব্যাংক, ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান লেনদেন সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া রয়েছে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পেমেন্ট গেটওয়ে সার্ভিস, পেমেন্ট সার্ভিস অপারেটর প্রতিষ্ঠান ও ডিজিটাল ব্যাংক।
এসব প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকের আলাদা আলাদা লেনদেনের তথ্য থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সাপেক্ষে বেসরকারি ক্রেডিট ব্যুরো এই তথ্য সংগ্রহের সুযোগ পাবে। কোনও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ বিতরণের আগে সেই তথ্য সংগ্রহ করে ঝুঁকি এড়ানোর সুযোগ পাবে। আর এই তথ্য সরবরাহের মধ্যে দিয়ে ক্রেডিট ব্যুরোর আয় আসবে। তবে কোন গ্রাহকের ব্যাংকে কত টাকা আমানত রয়েছে- এই তথ্য কোনোভাবেই সরবরাহ করতে পারবে না বেসরকারি খাতের এই প্রতিষ্ঠান।
ক্রেডিট ব্যুরো প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন পেতে হলে প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানকে লিমিটেড কোম্পানি হতে হবে, যার পরিশোধিত মূলধন হবে ১০ কোটি টাকা।
নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, বেসরকারি ক্রেডিট ব্যুরোর আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ ১১ জন পরিচালক থাকতে পারবে। পরিচালকদের কমপক্ষে দুজনের ১০ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তাদের মধ্যে কমপক্ষে দুই জনের প্রযুক্তি ও ব্যবসা সম্পর্কিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকতে হবে। কোনও ব্যক্তি একই সময়ে একাধিক ক্রেডিট ব্যুরোর পরিচালক হতে পারবে না।
ক্রেডিট ব্যুরো প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা (সিটিও), ডেটাবেস অ্যাডমিনিস্ট্রেটর এবং চিফ ইনফরমেশন সিকিউরিটি অফিসারদের প্রত্যেকের ব্যাংকিং, ইলেকট্রনিক মানি বা ফিনটেক পরিষেবার ক্ষেত্রে কমপক্ষে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
লাইসেন্সের আবেদন জমা দিতে প্রবেশ করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে (https://license.bb.org.bd)।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সরকারের ভিশন মাথায় রেখে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি সমন্বয়ের বিষয়টি মাথায় রেখেই বেসরকারি খাতে ক্রেডিট ব্যুরোর নিবন্ধন দেওয়া হবে।