Beta
শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

আমানত ফেরত দিতে টাকা ধার পাবে দুর্বল ব্যাংকগুলো

গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
Picture of সকাল সন্ধ্যা প্রতিবেদন

সকাল সন্ধ্যা প্রতিবেদন

নগদ টাকার সঙ্কট থাকায় ৭-৮টি ব্যাংকের আমানতকারীরা চাহিদামতো তাদের অর্থ তুলতে পারছে না। মাস খানেক ধরে এ নিয়ে নানা অভিযোগ ওঠার প্রেক্ষাপটে ব্যাংকগুলোকে তার‌ল্য জোগান দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এই আমানতকারীরা যাতে সীমিত আকারে হলেও টাকা তুলতে পারে, সে লক্ষ্যে ব্যাংকগুলোকে অন্য ব্যাংক থেকে নগদ টাকা ধার করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘গ্যারান্টর’ হিসেবে কাজ করবে বলে জানিয়েছেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।

তিনি বলেছেন, “আমরা চেষ্টা করছি আমানতকারীদের এই সঙ্কট থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি (রিলিফ) দিতে। পুরোটা দেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ সেই পরিমাণ টাকা ব্যাংকগুলোর হাতে নেই।”

বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে ব্যাংকার্স সভা শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। সভায় বিভিন্ন ব্যাংকের নির্বাহীর সঙ্গে ব্যাংক খাতের সমসায়িক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়।

গভর্নর বলেন, “আমরা এই বিষয়টি (তারল্য সঙ্কট) নিয়ে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছি। ব্যাংক খাত থেকে বড় অঙ্কের অর্থ বিভিন্নভাবে পাচার করা হয়েছে। আত্মসাৎ করা হয়েছে। এটা প্রধানত ৭-৮টি ব্যাংকের মধ্যে সীমিত আছে। এই ব্যাংকগুলো এখন তারল্য সঙ্কটের মধ্যে আছে।”

গ্রাহকদের অভিযোগ খতিয়ে দেখা গেছে, চাহিদামতো আমানত তুলতে না পারার ঘটনা বেশি ঘটছে শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোতে। এই ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন শাখায় চেক নিয়ে ঘোরাঘুরি করেও চাহিদামতো টাকা তুলতে পারেনি গ্রাহকরা। গত দুই সপ্তাহ ধরে এ সংক্রান্ত অভিযোগ বেশি পাওয়া গেছে। 

ব্যাংকগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্শিয়াল ব্যাংক।

আওয়ামী লীগ সরকার আমলে চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এস আলমের নিয়ন্ত্রণে ছিল এসব ব্যাংক। ঋণ অনিয়মের কারণে আস্থা সঙ্কট দেখা ছিল এসব ব্যাংক নিয়ে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনে সরকার পতন হলে এস আলমের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় ব্যাংকগুলো। এরপর পুরনো আস্থা সঙ্কটের সঙ্গে আতঙ্ক যোগ হয় ব্যাংকগুলো নিয়ে; টাকা তুলে নিতে শুরু করে আমানতকারীরা।

শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদ ছাড়েন আব্দুর রউফ তালুকদার। নতুন গভর্নর করা হয় আহসান এইচ মনসুরকে। তিনি দায়িত্ব নিয়ে ব্যাংক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করে সংস্কারের উদ্যোগ নেবেন বলে জানান। এজন্য সময় লাগবে বলেও জানান তিনি।

গভর্নরের দায়িত্বে নিয়ে আহসান মনসুর সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, “বেআইনিভাবে কোনও দুর্বল ব্যাংককে আর তারল্য সহায়তা দেওয়া হবে না। এটা অর্থনীতির জন্য ভালো হবে না।”

এর মধ্যেই আতঙ্কিত হয়ে টাকা তোলা শুরু হলে ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তোলা সীমিত করে আনে বাংলাদেশ ব্যাংক। ৮ আগস্ট নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম সপ্তাহে ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ তোলা যেত এক লাখ টাকা। এরপর আস্তে আস্তে টাকা তোলার সীমা বাড়ানো হয়।

গত সপ্তাহে দিনে ব্যাংক থেকে টাকা তোলার সীমা ছিল ৪ লাখ। চলতি সপ্তাহে সেই সীমা বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা করা হয়েছে।

অথচ আমানতকারীরা বলছেন, এই ব্যাংকগুলো দিচ্ছে ২০ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা। মোবাইল অ্যাপ এবং ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবাও সীমিত করে রাখা হয়েছে এসব ব্যাংকে।

এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক উভয় সঙ্কটে পড়েছে বলে বুধবার সাংবাদিকদের জানান গভর্নর।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, “আমরাও উভয় সঙ্কটে আছি। আমরা যদি সকল ব্যাংককে বেইলআউট করতে যাই, তাহলে হয়তো দুই লাখ কোটি টাকা লাগবে। এই টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকগুলোকে দিলে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে।

“বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার হয়তো ১৫০ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। মূল্যস্ফীতি হয়তো ২৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এটা আমাদের কাম্য নয়। কাজেই আমাদের মুদ্রানীতির ব্যবস্থাপনা ঠিক রেখে সীমিত আকারে ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেব।”

“আমরা চেষ্টা করছি, এই ব্যাংকগুলো যাতে আন্তঃব্যাংক মার্কেট থেকে টাকা ধার করতে পারে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক গ্যারান্টার থাকবে। কেননা, এই ব্যাংকগুলোকে এখন কোনও ব্যাংক ধার দেবে না,” যোগ করেন তিনি।

এই মুহূর্তে ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের পুরো টাকা ফেরত দিতে পারবে না জানিয়ে গভর্নর বলেন, “এই মুহূর্তে ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পারবে না। তাদেরকে (আমানতকারীদের) একটু ধৈর্য ধরতে হবে।”

তিনি বলেন, সমস্যাগুলো অনেক দিনের। এটা আমানতকারীরাও জানত। তারপরও তারা অতিরিক্ত মুনাফার জন্য ওই ব্যাংকগুলোতে টাকা রেখেছে।

এ কারণে ব্যাংকগুলোর মালিকরাও টাকা বেশি আত্মসাৎ করতে পেরেছে বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর।

তিনি বলেন, “তারপরও আমরা আমানতকারীদের স্বার্থ দেখব। যাতে তারা ব্যাংক থেকে অল্প অল্প করে টাকা তুলে তাদের পারিবারিক খরচ চালাতে পারে। দ্বিতীয়ত আমরা বড় বড় ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে দ্রুত বাংলাদেশের ভেতরে তাদের যেসব সম্পদ আছে সেগুলো উদ্ধার করার চেষ্টা করব। তৃতীয়ত বিদেশে তাদের যেসব সম্পদ আছে সেগুলো উদ্ধার করার জন্য আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সহযোগিতা নেব।”

গভর্নর জানান, দেশ থেকে পাচার করা অর্থ প্রধানত চারটি দেশে আছে। এই দেশগুলোর একটি যুক্তরাজ্য। দেশটিতে একটি পরিবারেই ৫০০-৬০০ বাড়িঘর আছে। এছাড়া দুবাই, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি পাচার করা সম্পদ রয়েছে। 

ব্যাংকগুলোর অবস্থা উন্নয়নে পর্ষদে পরিবর্তন আনার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, বেশ কিছু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ব্যবস্থাপনাতেও পরিবর্তন আসবে। এসব ব্যাংকে নিরীক্ষা করা হবে। এরপর ব্যাংকগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এসব ব্যাংক পুনর্গঠন করে একা চলবে, না কি কারও সঙ্গে একীভূত হবে- সেই সিদ্ধান্তও নেওয়া হবে। ছোট ব্যাংক হলে অবসায়নও হতে পারে।

গভর্নর বলেন, “ইসলামী ব্যাংকের অর্ধেক টাকা নাই হয়ে গেছে। ১-২ বছর সময় লাগবে এসব ব্যাংক মেরামত করতে।”

পাচারকৃত অর্থ পুরোপুরি না পারলেও আংশিকভাবে ফেরত আনা সম্ভব বলে আশা করছেন গভর্নর। তিনি বলেন, “এই টাকা ফেরত আনতে ২-৩ বছর সময় লাগবে।”

সভা শেষে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।

তিনি বলেন, “ব্যাংক খাতের বিভিন্ন সঙ্কট দূর করার জন্য তিনটি টাস্কফোর্স গঠনের কথা জানিয়েছেন গভর্নর। আমরা আশা করি, এগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হলে ব্যাংক খাতের পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটবে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত