যে দলের মাথায় দক্ষিণ এশিয় মহিলা ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট সেই বাংলাদেশের কোনও ক্লাব নেই এএফসি ওমেন্স চ্যাম্পিয়নস লিগে! আছে ভারত, নেপাল এমনকি ভুটানের চ্যাম্পিয়ন ক্লাবও। নেই শুধু দুর্ভাগা বাংলাদেশের ক্লাব।
২০২৩ সালের আগস্টে এএফসি সভায় প্রথমবারের মতো সিদ্ধান্ত হয় এএফসি উইমেন্স চ্যাম্পিয়নস লিগ আয়োজনের। এশিয়ার নারী ফুটবলকে আরও চাঙ্গা ও প্রতিদ্বন্দ্বতামূলক করার জন্যই এই উদ্যোগ। এজন্য বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগের চিন্তা এএফসির।
নারী ফুটবলকে উৎসাহিত করতেই তারা একেকটি দলকে ১ কোটি ১৭ লাখ টাকা (১ লাখ ইউএস ডলার) দিচ্ছে শুধুমাত্র টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের জন্য। সেখানে বাফুফে অজুহাত হিসাবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে এদেশে মেয়েদের ফুটবলের অপেশাদারিত্বকে। যদিও এএফসির টুর্নামেন্ট বাইলজে পেশাদরিত্ব লাগবে বলে কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।
কয়টি দল এবং প্রাইজমানি
এএফসির এই নতুন টুর্নামেন্টে বিভিন্ন দেশের ২২টি ক্লাব দল অংশ নিচ্ছে। গত বছর আগস্টে সিদ্ধান্ত হওয়ার পর তারা সদস্য দেশগুলোকে আমন্ত্রণ জানায়। ঘরোয়া ফুটবলের চ্যাম্পিয়ন দলের নাম পাঠাতে বলে। সেই অনুযায়ী, ২২টি দেশের ক্লাব দলের নাম জমা পড়ে এএফসিতে।
দক্ষিণ এশিয় অঞ্চল থেকে ভারতের ওডিশা এফসি, নেপালের এপিএফ (আর্মড পুলিশ ফোর্সেস) ক্লাব, ভুটানের আরটিসি (রয়্যাল থিম্পু কলেজ) অংশ নিচ্ছে। তবে নেই সাফজয়ী বাংলাদেশের কোনও ক্লাব।
এই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণকারী দল পাবে ১ কোটি ১৭ লাখ (১ লাখ ডলার) টাকা করে। কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠা দলগুলো পাবে বাড়তি ৮০ হাজার ইউএস ডলার। সেমিফাইনালিস্টদের দেওয়া হবে ১ লাখ ২০ হাজার ডলার করে। আর চ্যাম্পিয়ন দল পাবে ১০ লাখ ইউএস ডলার।
প্রাথমিক পর্বে ১৪ দল চার গ্রুপে খেলবে। চার গ্রুপসেরার সঙ্গে সরাসরি যোগ দেবে র্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা এশিয়ার সেরা ৮ দল। এই ১২টি দল তিন গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলবে গ্রুপ পর্বে। আগামী ২৫-৩১ আগস্ট হবে এই ম্যাচগুলো। তিন গ্রুপ সেরা ও রানার্সআপ এবং সেরা দুই তৃতীয় দলসহ মোট ৮ দল নিয়ে ২০২৫ সালের মার্চে হবে কোয়ার্টার ফাইনাল। এরপর ২১-২৪ মার্চ হবে সেমিফাইনাল ও ফাইনাল।
বাংলাদেশের ক্লাব কেন নেই
বাংলাদেশে প্রথম মহিলা ফুটবল লিগ শুরু হয় ২০১১ সালে। তবে নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ২০১৯ সাল থেকে। সুবাদে মেয়েদের ফুটবল খেলা তরতর করে এগোচ্ছে এবং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ২০২২ সালে সাফ শিরোপা জিতে দেশের মহিলা ফুটবল পৌঁছে যায় নতুন এক মাইলস্টোনে।
এই দেশে যখন মেয়েদের লিগ নিয়মিত হয় তখন অবশ্যই চ্যাম্পিয়ন দলের এই টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ আছে। মেয়েদের লিগের হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংসের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর যোবায়ের নিপু, “২০২৩ সালের লিগ জিতে আমরা হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। আমরা অবশ্যই এএফসির এই টুর্নামেন্ট খেলার দাবিদার ছিলাম। বাফুফে কেন আমাদেরকে সুযোগটা দেয়নি আমি জানি না।”
কিংস অবশ্য চলতি বছরের (২০২৪ সালে) লিগে অংশ নেয়নি। সেজন্যই কি তাদের সুযোগ দেয়নি? নিপুর জবাব, “২০২৩ সালের ঘরোয়া লিগ চ্যাম্পিয়নদের নিয়েই এএফসির এই টুর্নামেন্ট। সুতরাং আমরাই খেলার সুযোগ পেতাম। বাফুফে এই ইস্যুতে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগই করেনি। ক্লাব লাইসেন্সিংয়ের অজুহাত দিলেও ধোপে টিকবে না। আমাদের ফুটবল অবকাঠামো সবচেয়ে ভাল। যদি আমাদের পাঠাতে না চায় তাহলে রানার-আপ দলকে পাঠাতে পারতো। তাতে অন্তত মেয়েরা খেলার সুযোগ পেতো এবং দেশের মহিলা ফুটবলের উন্নতি হতো।” এএফসি ওমেন্স চ্যাম্পিয়নস লিগে বাংলাদেশের কোনও দল না থাকাটা আসলে রহস্যময় ঠেকছে।
মাহফুজা আক্তার কিরণ কি বলছেন
বাংলাদেশ মহিলা ফুটবলের বড় কর্তা মাহফুজা আক্তার কিরণ, যার কথাই মহিলা ফুটবলের শেষ কথা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমাদের দেশের নারী ফুটবল লিগ প্রফেশনাল না। এই কারণে আমরা সেখানে অংশ নিতে পারিনি।”
নেপাল, ভুটান ও ভারতের ক্লাবগুলো তো সেখানে অংশ নিচ্ছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তার ব্যাখ্যা, “ওরা যদি প্রফেশনাল ক্লাব হয় তাহলে অবশ্যই ওরা এই লিগে খেলার সুযোগ পাবে। আমাদের দেশের ক্লাবগুলি যদি প্রফেশনাল ফুটবলের শর্তগুলো পূরণ করতো তাহলে তারাও খেলতে পারত। আমরা যেহেতু আমাদের ঘরোয়া লিগটা প্রফেশনাল হিসেবে ঘোষণা দিতে পারিনি তাই ওদের শর্ত পূরণ করতে পারিনি।”
অবশ্য ভারতের ক্লাব উড়িষ্যা এফসি ছাড়া বাকিদের নারী ফুটবল লিগে পেশাদারিত্ব বাংলাদেশের তুলনায় কম। নেপাল ও ভুটানের লিগ মোটেও পেশাদার নয়।
মজার ব্যাপার হলো, ক্লাব ফুটবলে পেশাদারিত্ব থাকলেই চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে খেলতে পারবে- এএফসি থেকে এমন কোনও শর্ত দেওয়া হয়নি। তথ্যটা জানানোর পর বাফুফের মহিলা কমিটির চেয়ারম্যান বলেন, “এ বিষয়ে আমার তাহলে পুরোপুরি জানা নেই। তাছাড়া আমি একটু ব্যস্ত আছি। আমার সঙ্গে ঈদের পর দেখা করলে পুরো বিষয়টা জেনে আপনাকে জানাতে পারব।”
ক্ষতিটা মেয়েদের ও দেশের মহিলা ফুটবলের
২০২২ সালে সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ১০ মাস মেয়েদের কোনও খেলা ছিল না। অর্থাভাবের অজুহাত দিয়ে মিয়ানমারে অলিম্পিক বাছাইয়ে মেয়েদের দলকে পাঠায়নি বাফুফে। ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচও খুব কম খেলেছে বাংলাদেশ। শুধু সিঙ্গাপুর ও চাইনিজ তাইপের সঙ্গে খেলার সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশের মেয়েরা। আর জাতীয় দলের এই মেয়েরাই ঘুরে ফিরে খেলে ঘরোয়া ফুটবলের শীর্ষ ক্লাবে। নারী লিগে গত বছরে যারা খেলেছিলেন বসুন্ধরা কিংসে। এবার বসুন্ধরা কিংস অংশ না নেওয়ায় নাসরিন স্পোর্টস একাডেমিতে খেলেছেন সাবিনারা।
এএফসি ওমেন্স চ্যাম্পিয়নস লিগে বাংলাদেশের ক্লাব খেলতে না পারায় পিছিয়ে যাবে মেয়েরাই। এমনটাই মনে করেন জাতীয় দলের সাবেক কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন, “এ টুর্নামেন্টে কারা খেলতো? বসুন্ধরা কিংস বা নাসরিন একাডেমি। আমাদের জাতীয় দলের মেয়েরাই খেলতো। এমনিতেই আমাদের মেয়েরা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় খেলার সুযোগ কম পায়। অন্তত ২-৩টা ম্যাচ তো খেলতেই পারতো। সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হলো তাদের।”
গুঞ্জন রয়েছে বসুন্ধরা কিংসকে পাঠাবে না বলেই এমন সিদ্ধান্ত বাফুফের। “এটা পুরোপুরি তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এ নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না”- বলেছেন গোলাম রব্বানী।
মোট কথা, কোন দলকে এএফসির টুর্নামেন্টে না পাঠিয়ে বাফুফে আরেকবার অত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খেললে বড় আর্থিক সুবিধা পেতো। সঙ্গে সাবিনা-মারিয়া-মনিকারা আরেক দফা বড় মঞ্চে খেলার সুযোগ পেতেন।