সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে আসা জাতীয় দলের দুই সাবেক কোচের কথা বলি। বাংলাদেশ দলের সাবেক কোচ ডেভ হোয়াটমোর গত বছরও বাংলাদেশে এসেছিলেন। বিপিএলে ফরচুন বরিশালের কোচ হয়ে এসে যে সম্মান সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন তা হয়তো মনে রাখবেন আজীবন। জাতীয় দলের আরেক সাবেক কোচ জেমি সিডন্সও এসেছিলেন ব্যাটিং কোচ হয়ে। প্রথম মেয়োদের (২০০৮ থেকে ২০১১) মতো সফল হননি তবুও পরের বার সম্মানহানি হয়নি তার।
কিন্তু ২০১১ সালে সিডন্স অধ্যায় শেষ হওয়ার পর থেকে এক যুগে এমন কোন কোচ নেই যার বিদায়টা হয়েছে হাসিমুখে। ১২ বছরে ছয় জন কোচ আসা-যাওয়া করেছেন দেশের ক্রিকেটে, তাদের শেষ পরিণতিটা কম-বেশি একই রকম। কাউকে মন খারাপ করে বিদায় নিতে হয়েছে, কাউকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কোচদের বিদায়ের ক্ষণগুলোয় একটু চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক
স্টুয়ার্ট ল (২০১১-১২)
২০১১ সালে জেমি সিডন্সের পর কোচ হয়েছিলেন স্টুয়ার্ট ল। তার অধীনে উইন্ডিজের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি জয় এবং ২০১২ এশিয়া কাপে প্রথমবারের মতো ফাইনালে খেলে বাংলাদেশ। কিন্তু এ টুর্নামেন্টের পরই এই অস্ট্রেলিয়ান তার পরিবারকে সময় দেওয়ার কথা বলে কোচের পদ ছাড়েন।
জানা যায় ২০১৩ সালে পাকিস্তান সফর করবেন না বলে এ সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু পেছনের কারণ ছিল ভিন্ন। অস্ট্রেলিয়ান বংশোদ্ভুত এই কোচ বাংলাদেশ দলে শৃঙ্খলা আনতে চেয়েছিলেন। সাকিব আল হাসানের জায়গায় মুশফিকুর রহিমকে নেতৃত্ব দেওয়ার পেছনে তার প্রভাব ছিল বলে শোনা গিয়েছিল তখন। এছাড়া দলে কঠোর নিয়ম-অনুশাসন রাখতে চেয়েছিলেন ল। যা ক্রিকেটারদের ভালো লাগেনি। সাকিবের নেতৃত্বে বদলের কারণে বিসিবির পরিচালকদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন এই কোচ।
রিচার্ড পাইবাস (২০১২)
দক্ষিণ আফ্রিকান এ কোচ ওই সময় বেশ নাম কুড়িয়েছিলেন। সফল কোচ হিসেবে বাংলাদেশে ভালো শুরুও করেছিলেন নেদারল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড সফরে তিন ম্যাচ জিতে। ওই সময় পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়াকে টপকে র্যাংকিংয়ের চারে উঠেছিল বাংলাদেশ।
একই মাসে স্কটল্যান্ডের কাছে একমাত্র টি-টোয়েন্টিতে হার ও নেদারল্যান্ডেসের সঙ্গে ১-১ ব্যবধানে অপ্রত্যাশিতভাবে সিরিজ ড্র করে পাইবাসের দল। ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ভরাডুবিতে বিসিবি তার বাজে কোচিংকে দুষেছে অনানুষ্ঠানিক ভাবে। কিন্তু পাইবাস পাল্টা অভিযোগ আনে বোর্ড কর্তাদের বিরুদ্ধে যে তাদের হস্তক্ষেপে দলের বেহাল অবস্থা হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে তার আর টিকে থাকার সুযোগ নেই, দুই বছরের চুক্তির চার মাস পার করে চাকরি ছাড়েন।
শেন জারগেনসেন (২০১২-১৪)
স্টুয়ার্ট ল ও রিচার্ড পাইবাসের সময়ে বোলিং কোচ হিসেবে কাজ করেছেন শেন জারগেনসেন। নিউজিল্যান্ডের এই কোচকেই অন্তর্বর্তীকালীন হেড কোচ করা হয়েছিল ওই সময়। তার অধীনে উইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডেতে সিরিজ জয়ে শুরু হয় বাংলাদেশের। এটা জার্গেনসেনের কোচিং ক্যারিয়ারে নিশ্চিতভাবে উজ্জ্বল অধ্যায়।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেটে তার পথচলা তিক্ত হতে শুরু করে। শ্রীলঙ্কা ও নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে টেস্ট ড্র করলেও ২০১৪ এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর জার্গেনসেনের সময় আর এগোয়নি। মেয়াদ শেষের আগেই পদত্যাগ করতে হয় তাকে। কেন পদত্যাগ করলেন তা জানাননি, বিসিবিও আনুষ্ঠানিক ভাবে কিছু বলেনি।
তবে জানা যায় বোর্ড থেকে দল গঠনের হস্তক্ষেপ মেনে নিতে পারেননি এই কোচ। ২০২২ বিশ্বকাপের সময় বাংলাদেশী মিডিয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তা প্রকাশ করেছিলেন জার্গেনসেন।
চন্ডিকা হাথুরুসিংহে (২০১৪-১৭)
তার অধীনে বাংলাদেশ ক্রিকেট সবচেয়ে ভালো সময় কাটায়। ২০১৫ সালে টানা ৫ সিরিজ জয়, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জয়, ২০১৫ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা হাথুরুর অধীনে বাংলাদেশের সেরা সাফল্য। তাই দুই বছরের মেয়াদ বাড়ে হাথুরুর।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে কড়া হেডমাস্টার হিসেবে খ্যাতি হয় তার। দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের নিজের মতো চালাতে পারছিলেন না। এর মধ্যে কোচকে না জানিয়ে সাকিব আল হাসানের ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট লিগে খেলতে যাওয়ায় হাথুরু বেশ চটেছিলেন। সাকিবকে তার কথা মতো আটকাতে ব্যর্থ হওয়ায় হাথুরু ক্ষোভ ঝাড়েন বিসিবির ওপর। এরপর নিজেই সিদ্ধান্ত নেন সরে দাঁড়ানোর। ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়া থেকেই পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে দেন।
স্টিভ রোডস (২০১৮-১৯)
বাংলাদেশ ক্রিকেটের গ্রাফটা এই কোচের অধীনে আরও একটু এগিয়ে যায়। গ্যারি কারস্টেনের পরামর্শে স্টিভকে নিয়োগ দেয় বিসিবি। এরপর ২০১৯ বিশ্বকাপে তিন জয়, এশিয়া কাপে ফাইনালে খেলা, প্রথমবার ত্রিদেশীয় সিরিজ জয়, উইন্ডিজকে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়েতে সিরিজে হারানোর সাফল্য আসে।
কিন্তু ২০১৯ বিশ্বকাপেই কিছু কারণে স্টিভ রোডসের ওপর অসন্তুষ্ট হয় বিসিবি। জানা যায় ক্রিকেটারদের বেশি ছুটি দেওয়া ও ভুল পিচ পর্যবেক্ষণ করেছেন স্টিভ রোডস। তাই বিশ্বকাপের পর তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
রাসেল ডমিঙ্গো (২০১৯-২০২২)
কাগজে-কলমে বাংলাদেশ ক্রিকেটে সবচেয়ে হাই-প্রোফাইল কোচ ছিলেন ডমিঙ্গো। তাতে অবশ্য পারফরম্যান্সে প্রভাব পড়েনি। বাংলাদেশ ক্রিকেট আগে থেকেই ওয়ানডেতে ভালো ছিল। ডমিঙ্গো শুধু ওয়ানডেতেই সফলতা পেয়েছেন। টেস্টে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাউন্ট মঙ্গানুই জয় বাদে আর কিছু নেই। টি-টোয়েন্টিতে জয় এলেও তা ধারাবাহিক ছিল না।
পারফরম্যান্সের কারণেই ডমিঙ্গোর সঙ্গে বিসিবির শেষটা একেবারে তিক্ত হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত এই কোচকে শুধু টেস্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর পেছনের কারণ ছিল ডমিঙ্গোর মেয়াদ শেষ না হওয়ায় তার সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করতে পারছিল না বিসিবি। তাই ইতিহাসে প্রথমবার এক কোচ থাকাকালীন আরেক কোচ শ্রীরামকে নিয়ে ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে যায় বাংলাদেশ। সবই হাস্যকর কান্ড। এরপর অবশ্য ডমিঙ্গো দেশে ফিরে গিয়ে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এই কোচও জাতীয় দল গঠনে বোর্ডের সরাসরি হস্তক্ষেপের অভিযোগ করেছিলেন।
চন্ডিকা হাথুরুসিংহে (২০২৩-২০২৪)
সর্বশেষ ব্যাক্তি চন্ডিকা হাথুরুসিংহে যার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ হলো এক ক্রিকেটারের গায়ে হাত তোলা ও অতিরিক্ত ছুটি। তবে অনানুষ্ঠানিক অভিযোগ- হাথুরু-ফারুকের পুরনো ইগোর লড়াই। ফারুক আহমেদ বিসিবি সভাপতি হওয়ার পর থেকে এই অস্ট্রেলিয়ানের ভাগ্যে শনির অবস্থান ছিল তুঙ্গে।