এ বছরের শুরুতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে দুটো ডাবল সেঞ্চুরি করে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন যশস্বী জয়সওয়াল। সাদা পোশাকে ২২ বছর বয়সী ভারতীয় ব্যাটারের টেস্ট অভিষেক হয় গত বছর। মাত্র ৯ টেস্ট খেলেই পাকা করে ফেলেছেন নিজের জায়গা।
বাংলাদেশ দলে দেখুন। অনেক তরুণের অভিষেক হলেও কেউ যশস্বীর মতো যশ নিয়ে আবির্ভূত হতে পারেননি বা আলাদা করে নিজেদের জায়গা তৈরি করতে পারেননি। নির্ভরতার প্রতীকও হয়ে উঠতে পারেননি। পঞ্চপাণ্ডবের পরে লিটন দাস-মোস্তাফিজুর রহমান-মেহেদী হাসান মিরাজ-তাসকিন আহমেদ ছাড়া চট করে এমন কারও নাম বলা যাবে না যাকে বাদ দিলে, দলের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
বেশিরভাগ ক্রিকেটারই দলে আসা-যাওয়াতেই ব্যস্ত থাকেন। তাদের নিয়মিত সুযোগ দিয়েও প্রতিদান পাননি লম্বা সময় দায়িত্বে থাকা দুই নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু ও হাবিবুল বাশার। উল্টো চাপে পড়েছেন তাদের খেলিয়ে! দেখে নেয়া যাক এরকম ক্রিকেটার কতজন?
পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১১ সালে নাসির হোসেন থেকে ২০২৩-এ শামীম হোসেনের অভিষেক পর্যন্ত ১৪ জন ক্রিকেটারকে তিন ফরম্যাটে সুযোগ দিলেও তারা নিজেদের মেলে ধরতে পারেননি। দলে জায়গা ধরে রাখার মতো পারফরম্যান্স করতে পারেননি। নির্বাচকদের প্রত্যাশানুযায়ী তারা লম্বা রেসের ঘোড়া হয়ে উঠতে ব্যর্থ। এই তালিকায় আছেন সৌম্য সরকার, সাব্বির রহমান, নাসির হোসেন, নুরুল হাসান সোহান, এনামুল হক বিজয়, মোহাম্মদ মিঠুন, ইয়াসির আলি, মোসাদ্দেক হোসেন, আফিফ হোসেন, শামীম হোসেন, সাইফ হাসান, সাদমান ইসলাম, মুনিম শাহরিয়ার ও স্পিনার নাজমুল ইসলাম অপু। এদেরকেই কিন্তু প্রতিভাবান হিসাবে ধরা হয়েছিল।
তাদের সম্পর্কে নির্বাচকদের মূল্যায়ন হচ্ছে, এসব ক্রিকেটারের নিজস্ব পরিকল্পনার অভাব ও ‘মাইন্ডসেটে’র সমস্যা। জাতীয় দলের সাবেক নির্বাচক হাবিবুল বাশার সকাল সন্ধ্যাকে বলেছেন, “তাদের সমস্যা মাইন্ডসেটে। স্কিলের দিকটা অবশ্যই একটা ব্যাপার কিন্তু এর চেয়েও মাইন্ডসেট (মনস্থির করা) অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমি কতটুকু কী করতে চাই, নিজেকে কোথায় দেখতে চাই- এই ব্যাপারগুলো একজন ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার গড়ার জন্য খুব জরুরি। জয়সওয়ালের যে উদাহরণটা দিয়েছেন, ওর সঙ্গে বাকিদের পার্থক্যটা হয়তো এখানেই। তার লক্ষ্যটা অনেক বড়।”
বাশার দেশিদের সঙ্গে বাবর আজম ও কুইন্টন ডি ককের উদাহরণ টেনে বলেছেন, “ক্রিকেটে আমি নিজেকে কোথায় দেখতে চাই, এটা খুব বড় ব্যাপার। অনেকে অল্পতে সন্তুষ্ট হয়ে যায়। বড় অবস্থানে নিজেকে দেখতে চায় না। এখানেই পার্থক্যটা হয়ে যায়। ব্যক্তির ওপরই বিষয়টা নির্ভর করে। ২০১২ যুব বিশ্বকাপে বিজয়-সৌম্যরা খেলেছিল। ওই আসরে দেখেছি বাবর আজম ও কুইন্টন ডি কককেও। এদের চেয়ে বেশি রান করেছিল বিজয়। এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ওই দুজনের সঙ্গে বিজয়-সৌম্যর পার্থক্যটা হয়ে গেছে বিশাল।”
নির্বাচক হিসেবে নান্নু ও বাশারের পথচলা শেষ হয়েছে গত ফেব্রুয়ারি। পহেলা মার্চ থেকে নতুন প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু এবং সহকারী নির্বাচক আবদুর রাজ্জাক ও হান্নান সরকার দায়িত্ব পালন করছেন।
২০১৬ থেকে একসঙ্গে নির্বাচক হিসেবে কাজ করেছেন সাবেক দুই অধিনায়ক নান্নু ও বাশার। তাদের নির্বাচনে তিন ফরম্যাট মিলিয়ে পঞ্চাশের অধিক ক্রিকেটার জাতীয় দলে খেলেছেন। কিন্তু জায়গা পাকা করতে পেরেছেন হাতে গোনা কয়েকজন।
লিটন-মোস্তাফিজ-তাসকিন-মিরাজদের সাফল্য পরোক্ষভাবে জমা হবে নান্নু-বাশারদের ঘরেও। কিন্তু প্রতিভার ঝলক দেখে তারা অনেককেই সুযোগ দিয়েছিলেন জাতীয় দলে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে না পারা ক্রিকেটারদের ব্যর্থতার দায়ও চাপছে ওই নির্বাচকদের ঘাড়ে।
একটু আক্ষেপ করেই সকাল সন্ধ্যাকে সাবেক প্রধান নির্বাচক নান্নু বলেছেন, “যারা ব্যর্থ হয়েছে তাদের পরিকল্পনায় ভুল ছিল। প্ল্যাটফর্মটা তারা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেনি। ক্রিকেট তো অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত খেলা। সুতরাং নিজের ক্ষেত্রে পরিকল্পনাটা নিজেকে করতে হয়, ওই অ্যাসেসমেন্ট নিজের। আমাকে কতদূর যেতে হবে, সেটা পরিকল্পনা করে এগোতে হয়। সবসময় সুযোগটা তাদের দিয়েছি কিন্তু ধারাবাহিকতা দেখাতে পারেনি।”
ক্রিকেটারদের এই ব্যর্থতা নির্বাচকদের কীভাবে আহত করে, সেটা হয়তো মানুষ জানে না। তবে সেই কষ্টটা কেমন, সেটা বলেছেন বাশার, “খুব কষ্ট হয় যখন আমাদের নির্বাচিত ছেলেটা মাঠে পারফর্ম করে না। মানুষ কী বলছে তাতে যতটা দুঃখিত হই, তার চেয়ে বেশি দুঃখ পাই যখন বিশ্বাস রাখা কোনও ক্রিকেটার পারফর্ম করতে পারে না।”
বিপিএলে ভালো খেলছেন দেখে মাহমুদউল্লাহকে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে দলে নেওয়া হয় দেড় বছর পর। এই অন্তর্ভুক্তির পেছনে আগামী জুনে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের চিন্তাও আছে। অথচ ২০২২ সালে সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি খেলেছিলেন এই ব্যাটার, এরপর মাহমুদউল্লাহকে আর ভাবাই হয়নি এই ফরম্যাটে।
তার জায়গায় সাত নম্বর পজিশনে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল নুরুল হাসান সোহান, আফিফ হোসেন ও শামীম হোসেনকে। কিন্তু তিনজনের কেউই প্রত্যাশা মেটাতে পারেননি। নিজেদের অবস্থান পাকা করতে পারেননি। একই পজিশনে মোসাদ্দেক হোসেনকেও অনেকবার সুযোগ দেওয়া হলেও জাতীয় দলের প্রয়োজন মেটাতে পারেননি। অগত্যা “বুড়ো” মাহমুদউল্লাহ’র ওপর ভরসা রাখতে হয়েছিল নির্বাচকদের।
শুধু মাহমুদউল্লাহ নন, মুশফিক-তামিমদের অভাব মেটানোর জন্য অনেককেই সুযোগ দেওয়া হয়েছিল জাতীয় দলে। সাকিব আল হাসানের জায়গা পূরণ করার মতো কাউকে এখনও পাওয়া যায়নি। প্রতিভা থাকলেও হারিয়ে যাওয়াদের তালিকায় সবচেয়ে বড় নাম হবেন নাসির হোসেন ও সাব্বির রহমান। ইয়াসির আলি রাব্বি, মোসাদ্দেক হোসেন, মোহাম্মদ মিঠুনরাও বাদ পড়াদের তালিকায় চলে গেছেন। সৌম্য, আফিফ, শামীম, এনামুল ও সোহান লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন জায়গা ফিরে পাওয়ার জন্য।
ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্সের চিত্র
খেলোয়াড় | টেস্ট | ওয়ানডে | টি-টোয়েন্টি |
সৌম্য সরকার | ১৬ ম্যাচে ৮৩১ | ৬৬ ম্যাচে ১৯৪২ | ৭৫ ম্যাচে ১২৩৮ |
সাব্বির রহমান | ১০ ম্যাচে ৩৩৩ | ৬৬ ম্যাচে ১৩৩৩ | ৪৮ ম্যাচে ৯৭৭ |
নাসির হোসেন | ১৯ ম্যাচে ১০৪৪ | ৬৫ ম্যাচে ১২৮১ | ৩১ ম্যাচে ৩৭০ |
নুরুল হাসান সোহান | ১১ ম্যাচে ৪৪০ | ৭ ম্যাচে ১৬৫ | ৪৬ ম্যাচে ৪৪৫ |
এনামুল হক | ৫ ম্যাচে ১০০ | ৪৮ ম্যাচে ১৩৪০ | ২০ ম্যাচে ৪৪৫ |
মোহাম্মদ মিঠুন | ১০ ম্যাচে ৩৩৩ | ৩৪ ম্যাচে ৭১৪ | ১৭ ম্যাচে ১২৭ |
মোসাদ্দেক হোসেন | ৪ ম্যাচে ১৭৩ | ৪৩ ম্যাচে ৬৩৪ | ৩৩ ম্যাচে ৩৮৯ |
আফিফ হোসেন | – | ৩১ ম্যাচে ৬০০ | ৬৯ ম্যাচে ১১০৯ |
ইয়াসির আলী | ৬ ম্যাচে ২০৫ | ৯ ম্যাচে ১০২ | ১১ ম্যাচে ১২৮ |
সাইফ হাসান | ৬ ম্যাচে ১৫৯ | – | ৫ ম্যাচে ৫২ |
শামীম হোসেন | – | ৪ ম্যাচে ৩৩ | ১৯ ম্যাচে ২৫৪ |
সাদমান ইসলাম | ১৩ ম্যাচে ৫৫৯ | – | – |
মুনিম শাহরিয়ার | – | – | ৫ ম্যাচে ৩৪ |
· একজন বোলার– নাজমুল ইসলাম অপু। ১৩ টি-টোয়েন্টিতে তার ৮ উইকেট। ৫ ওয়ানডেতে নিয়েছেন ৫ উইকেট। আর এক টেস্টে ৪ উইকেট।