শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের মানুষের ভারতে যাতায়াত তো কমেছে অনেক। কিন্তু পণ্যের যাতায়াত কি কমেছে? তথ্যে চোখ রাখলে দেখা যাবে উল্টো চিত্র।
বৈরী সম্পর্কের মধ্যেও ভারত থেকে পণ্য আসা যেমন কমেনি; তেমনি বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি তো কমেইনি, বরং বেড়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যাচ্ছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) প্রতিবেশী দেশটিতে প্রায় ১০০ কোটি (১ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।
এই অঙ্ক গত অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি। এই ধারায় চললে অর্থ বছর শেষে রপ্তানির অঙ্ক ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারে গিয়ে ঠেকতে পারে।
এর আগে কেবল ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ভারতে পণ্য রপ্তানি করে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় হয়েছিল। ওই অর্থ বছরে ২১৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিলেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা।
যে ছয় মাসের হিসাব এসেছে, তার দ্বিতীয় মাস আগস্ট থেকেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিম্নমুখী। জুলাইজুড়ে আন্দোলনের পর ওই মাসের ৫ তারিখে পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। শেখ হাসিনা গিয়ে আশ্রয় নেন ভারতে।
এরপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার সময়ই ভারতকে সতর্ক করেন বাংলাদেশ নিয়ে। এরমধ্যে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা প্রায় বন্ধ করে দেয় ভারত সরকার। ফলে সে দেশে যাতায়াতও যায় বন্ধ হয়ে।
নাজুক অবস্থা আরও নাজুক হয়ে পড়ে বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মীয় নেতা চিন্ময় ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তারের পর। তানিয়ে দুই দেশে পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভের মধ্যে ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলাও হয়।
এরপর সম্প্রতি সীমান্তে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ নিয়ে উত্তেজনা বাড়ে ঢাকা-দিল্লির মধ্যে। ভারতের হাই কমিশনারকে ঢাকায় তলবের পাল্টায় সোমবার দিল্লি সরকারও বাংলাদেশি দূতকে ডেকে পাঠায়।
ঠিক এই দিনই ইপিবির প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ভারতে ৯৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থ বছরের এই ছয় মাসে ভারতে রপ্তানি হয়েছিল ৮৪ কোটি ডলারের পণ্য। ফলে এই অঙ্ক গত অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেশি।
বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারতের সঙ্গে ৩৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি অনেক বড়।
বাংলাদেশ যত রপ্তানি করে তার বহু গুণ বেশি আমদানি করে। বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ১ হাজার কোটি (১০ বিলিয়ন) ডলারের বেশি।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে রপ্তানি বাড়তে দেখা যাচ্ছে।
অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ভারতে ২১৩ কোটি (২.১৩ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। দেশটিতে পণ্য রপ্তানি করে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় বাংলাদেশের সেটাই প্রথম।
তার আগের অর্থ বছরে (২০২১-২২) ভারতে পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ আয় করেছিল ১৯৯ কোটি ১৪ লাখ (১.৯৯ বিলিয়ন) ডলার, যা ছিল ২০২০-২১ অর্থ বছরের চেয়ে ৫৫ দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি।
তবে গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে সেই রপ্তানিতে ভাটা পড়ে; আয় নেমে আসে ১৫৬ কোটি ৯২ লাখ (১.৫৭ বিলিয়ন) ডলারে। এবার আবার ঊর্ধবগতি দেখা যাচ্ছে।
রপ্তানির হাল
ভারত ২০১১ সালে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসাবে বাংলাদেশকে অস্ত্র ও মাদক বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দেয়। তবে সেই সুবিধা খুব বেশি কাজে লাগাতে পারছিল না বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা।
ওই বছরের শেষের দিকে বাংলাদেশের বেশ কিছু কারখানার কাছ থেকে পোশাক নিয়ে টাকা দেয়নি ভারতীয় কোম্পানি লিলিপুট। সে জন্য বেশ কয়েক বছর পোশাক রপ্তানিতেও ভাটা পড়েছিল।
এরপর ভারতে রপ্তানি ধীরে ধীরে বাড়ছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো দেশটিতে পণ্য রপ্তানি আয় ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। পাঁচ বছরের মাথায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে সেই আয় দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ২ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারে ওঠে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে তার আগে মাত্র চারটি অর্থবছরে ভারতে পণ্য রপ্তানি ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারের বেশি হয়।
২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা ভারতের বাজারে ১২৮ কোটি (১.২৮ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানির অঙ্ক ছিল ১২৫ কোটি (১.২৫ বিলিয়ন) ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা কমে ১০৯ কোটি ৬২ লাখ (১.০৯ বিলিয়ন) ডলারে নেমে আসে।
বাংলাদেশ ভারতে মূলত তৈরি পোশাক রপ্তানি করে থাকে। এছাড়া কাঁচা পাট ও পাটজাতপণ্য, সুতা, প্লাস্টিক পণ্য এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে।
গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে ৫৫ কোটি ডলার, পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে ২২ কোটি ডলার এবং চামড়া থেকে ১১ কোটি ডলার আয় এসেছিল।
চলতি অর্থ বছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে ৩৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার, পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে ১০ কোটি ডলার এবং চামড়া থেকে ৫ কোটি ডলার আয় হয়েছে।
ভারত থেকে কাঁচা মরিচ থেকে শুরু করে অনেক পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। ছয় মাসে আমদানির তথ্য পাওয়া না গেলেও এই সময়ে কোনও পণ্য আসা থেমে ছিল না।
ভবিষ্যৎ কী
কোভিড মহামারির সময় সারাবিশ্বে যোগাযোগ থমকে গেলে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য বাড়তে শুরু করে। কারণ অন্য দেশে বাধা থাকায় দুই দেশই নিজেদের উৎস থেকে লেনদেন বাড়াচ্ছিল। আবার দু্ই দেশের পরিবহণ যোগাযোগ বাড়াও এতে প্রভাব ফেলে।
সেই ধারা অব্যাহত থাকেলেও কুটনৈতিক সম্পর্কের আরও অবনতি হলে তা ধরে রাখা কঠিন হবে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বৈরী সম্পর্কের মধ্যেও ভারতে রপ্তানি বৃদ্ধি আমাদের অর্থনীতির জন্য একটি ভালো দিক। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক মোটেই ভালো যাচ্ছে না। এ অবস্থায় আগামী দিনগুলোতে রপ্তানি বাড়বে কি না, তা নিয়ে সংশয় তো থাকছেই।”
ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি আরও বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন সেলিম রায়হান। সেজন্য রপ্তানিকারকদের সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি।
সেলিম রায়হান বলেন, “ভারতের বাজারে অনেক সময় অযৌক্তিকভাবে অশুল্ক বাধা আরোপ করা হয়। এই বাধা দূর করার ক্ষেত্রে কূটনৈতিক যোগাযোগের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং রপ্তানিকারকদের নেগোসিয়েশন দক্ষতা বাড়াতে হবে।”
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ রপ্তানি বাড়ানোর জন্য কূটনৈতিক সম্পর্ক ভালো করার ওপর জোর দিচ্ছেন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ভারতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের কদর বাড়ছে। দেড়শ’ কোটি লোকের চাহিদা মেটাতে ভারতকে বাংলাদেশ থেকে পোশাক কিনতেই হবে। ভারতে পোশাক তৈরি করতে যে খরচ হয়, বাংলাদেশ থেকে আমদানি করলে তার চেয়ে অনেক কম পড়ে। সে কারণে সব হিসাব-নিকাশ করেই তারা এখন বাংলাদেশ থেকে বেশি করে পোশাক কিনবে।”
ভারতের বাজারে যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, রাজনৈতিক কারণে তা যেন নষ্ট হয়ে না যায়, তা চাইছেন পোশাক ব্যবসায়ীরা।
নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের তৈরি পোশাকের খুবই সম্ভাবনা এবং ভালো বাজার হয়ে উঠছিল ভারত। সার্বিক রপ্তানি ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মাঝে হোঁচট খেয়েছিল।
“এখন আবার বাড়ছে। এটা ধরে রাখতে হবে। সেজন্য কুটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। বর্তমানে যে সম্পর্ক দেখা দিয়েছে, তার সম্মানজনক সমাধান করতে হবে।”
“মনে রাখতে হবে, পাশের দেশ হওয়ায় ভারতে পণ্য রপ্তানি করতে আমাদের পরিবহন খরচ অনেক কম হয়। স্থলবন্দর দিয়েই সব পণ্য রপ্তানি হয়। সে কারণে ভারতে আমাদের রপ্তানি যত বাড়বে, ততই ভালো,” বলেন হাতেম।