‘বাংলার জ্যোতি’ দিয়ে সাগরে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর যে যাত্রার শুরু হয়েছিল, তিন যুগে তা ১ থেকে ১০০ তে উন্নীত হতে যাচ্ছে। সেই শততম জাহাজের মালিক কে হবে, তা নিয়ে এখন চলছে লড়াই। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানই চাইছে সমুদ্রে লাল-সবুজ পতাকাবাহী শততম জাহাজের মালিক হওয়ার ইতিহাস গড়তে।
এই দৌড়ে রয়েছে দেশের তিনটি বড় শিল্পগ্রুপ। এর মধ্যে মেঘনা গ্রুপ ‘মেঘনা সেঞ্চুরি’, কবির গ্রুপ ‘এমভি জাহান-১’, আর ভ্যানগার্ড গ্রুপ ‘রয়েল আরাকান’ জাহাজ সাগরে নামাতে নিবন্ধন চাইছে।
বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে প্রথম সাগরে যাওয়ার ছাড়পত্র পায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের জাহাজ বাংলার জ্যোতি। ১৯৮৮ সালে নিবন্ধন পায় এই ট্যাংকারটি। তৃতীয় জাহাজ নিবন্ধনের সময় বেসরকারি মালিকানা প্রথম আসে।
এখন যে জাহাজগুলো সাগরে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে চলাচল করছে, তার বেশিরভাগেই বেসরকারি উদ্যোক্তাদের। সরকার মালিকানাধীন জাহাজ আছে মাত্র সাতটি।
নতুন করে নিবন্ধন পেতে তিন-চারটি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে বলে জানান জাহাজের নিবন্ধনকারী প্রতিষ্ঠান রেজিস্ট্রার অব শিপস বাংলাদেশের প্রধান ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “৩/৪টি কোম্পানি শততম জাহাজে নিজেদেরটি নিবন্ধনের আবেদন করেছে। এরমধ্যে দুটি কোম্পানি এগিয়ে আছে। তারা প্রাথমিক নিবন্ধন করেছে।
“কিন্তু চূড়ান্ত নিবন্ধনের জন্য ভ্যাট-ট্যাক্স পরিশোধ করেই জমা দিতে হবে। এখন সেই প্রক্রিয়ায় যে আগে আসবে, সেই নিবন্ধন পাবে।”
লড়াইয়ে থাকা কবির গ্রুপের এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এমভি জাহান-১ নাম দিয়ে আমরা আবেদন করছি। আমাদের জাহাজটি অন্য জাহাজের চেয়ে আগে চলে আসছে। ফলে আশা করছি, নিবন্ধনে আমরাই এগিয়ে থাকব।”
আশা ছাড়ছে না মেঘনা গ্রুপও। এই শিল্প গ্রুপের মার্কেন্টাইল শিপিংয়ের মহাব্যবস্থাপক মো. আবু তাহের সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “৬৬ হাজার ৫০০ টন ধারণ ক্ষমতার লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী এমভি নিউ চ্যাম্প জাহাজটি আমরা কিনে ‘মেঘনা সেঞ্চুরি’ নামে নিবন্ধন করেছি। জাহাজটি জুনে হস্তান্তর করা হবে। আমরা দেরিতে জাহাজ হস্তান্তর করলেও নিবন্ধনে এগিয়ে আছি।”
কেন এই লড়াই
পিএনএন শিপিং একটি সমুদ্রগামী জাহাজ ‘এমভি অপরাজিতা’ কিনেছে আগেই। নতুন করে এই বছরই তাদের আরেকটি জাহাজ কেনার কথা ছিল। কিন্তু শিপিং ব্যবসা এখন ভালো না থাকায় সেই চেষ্টা থেকে সরে এসেছে প্রতিষ্ঠানটি।
পিএনএন শিপিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ সাহিকুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “শিপিং বিজনেসের কঠিন এই সময়ে জাহাজের বহর বাড়ানো সত্যিই চ্যালেঞ্জিং। যারা এই কাজটি করছেন, তাদের স্যালুট। সত্যি বলতে কী শততম তালিকায় নিজের জাহাজের নাম থাকা আসলেই গৌরবের।”
বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ বাড়লে তাতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
“বহর দেখে এই খাতে নতুন বিনিয়োগ আসবে। এতগুলো জাহাজ মেরামত ঘিরে গড়ে উঠবে নতুন শিল্পখাত, তৈরি হবে সেবাধর্মী নতুন কোনও বিজনেস।”
লড়াইয়ে থাকা কবির গ্রুপের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, “এই শিল্পে যারা বিনিয়োগ করেছেন, তারা সবাই দেশের জায়ান্ট।
“ফলে শততম জাহাজের মালিক কে হবে, সেটা আসলে আহামরি বড় বিষয় নয়। আমরা প্রতিযোগিতা করছি, ঠিক; তবে এরমধ্যে কিন্তু একজনই জিতবে।”
কার কত জাহাজ
২০২৩ সাল পর্যন্ত সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যায় শীর্ষে ছিল চট্টগ্রামভিত্তিক কবির গ্রুপ। তাদের প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মাধ্যমেই এসব জাহাজ নিবন্ধন-চলাচল করে।
২০২৩ সালে একসঙ্গে কয়েকটি জাহাজ কিনে কবির গ্রুপের কাতারে চলে আসে মেঘনা গ্রুপ। বর্তমানে কবির গ্রুপের বহরে জাহাজ আছে ২৫টি, মেঘনা গ্রুপের বহরেও ২৫টি।
রেজিস্ট্রার অব বাংলাদেশ শিপসের হিসাবে, এখন পর্যন্ত ৯৯টি জাহাজ দপ্তরের স্থায়ী নিবন্ধন পেয়েছে। তিনটি জাহাজ অস্থায়ী নিবন্ধন নিয়েছে।
শিল্প গ্রুপগুলোর মধ্যে আকিজ গ্রুপের ১০টি, সাবের হোসেন চৌধুরীর মালিকানাধীন এইচআর শিপিংয়ের ৮টি, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের ৭টি, ভ্যানগার্ড গ্রুপের ৭টি এবং বসুন্ধরা গ্রুপের ৬টি জাহাজ পণ্য পরিবহন করছে।
বিএসএ শিপিংয়ের তিনটি, এমআই সিমেন্টের তিনটি, ডুরিয়া শিপিংয়ের দুটি, হানিফ মেরিটাইমের দুটি, ওরিয়ন গ্রুপের একটি, মবিল-যমুনা গ্রুপের একটি, পিএনএন শিপিংয়ের একটি, অ্যাডভান্সড শিপিংয়ের একটি, ডরিন শিপিংয়ের একটিসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের জাহাজ সাগরে চলছে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে।
নিবন্ধিত জাহাজের মধ্যে ৯টি কনটেইনারবাহী জাহাজ, যার সবগুলো এইচআর লাইনের। ৩টি এলপিজি ট্যাংকার, ৫টি কেমিকেল ট্যাংকার, ৭টি অয়েল ট্যাংকার ও ৭৭টি কার্গো জাহাজ।
বাংলাদেশি পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজের বেশিরভাগই ৫০-৫৫ হাজার টন পণ্য পরিবহন সক্ষমতার। এর বাইরে রয়েছে কন্টেইনারবাহী ফিডার জাহাজ, যা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে কনটেইনার পরিবহনে নিয়োজিত।
কার কত বিনিয়োগ
দেশের শিল্পগ্রুপগুলো মূলত নিজেদের পণ্য পরিবহন করতেই জাহাজ কেনা শুরু করে। পরে দেখা গেছে অন্যদের পণ্য পরিবহনে যুক্ত হয়ে তারা ভালোই মুনাফা গুনছে। নিজেদের পাশাপাশি অন্য প্রতিষ্ঠানের পণ্য পরিবহনে লাভ দেখার পর সবাই জাহাজ কেনায় বিনিয়োগ বাড়ায়।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের তথ্য অনুযায়ী, মেঘনা গ্রুপের বহরে থাকা সাড়ে ১৩ লাখ টন পণ্য পরিবহন ক্ষমতার ২৪টি জাহাজে বিনিয়োগ হয়েছে ৫০ কোটি ডলার। যাদের সবগুলোই খোলা বা বাল্ক জাহাজ।
কবির গ্রুপের জাহাজে বিনিয়োগ প্রায় ২৯ কোটি ডলার। তাদের জাহাজগুলোর পণ্য পরিবহন ক্ষমতা প্রায় ১৩ লাখ টন। তাদের সবগুলো জাহাজ বাল্ক বা খোলা পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত।
কবির গ্রুপের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত বলেন, “ইনস্ট্যান্ট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের খাত হচ্ছে জাহাজ শিল্পে বিনিয়োগ। বিদেশের বিভিন্ন বন্দরে পণ্য পরিবহন করে যে ভাড়া পাচ্ছি, সেটি কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রায়। এই মুদ্রা সরাসরি কেন্দ্রীয় রিজার্ভে যোগ হয়ে রিজার্ভ শক্তিশালী হচ্ছে।
“একইসাথে বিদেশ থেকে যেসব পণ্য আমরা দেশি জাহাজে পরিবহন করছি, সেই ভাড়ার পুরোটাই দেশে থাকছে। বিদেশি জাহাজ হলে সেই টাকা ডলারে পরিশোধ করতে হতো। ফলে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়েছে এবং হচ্ছে।”
কবির গ্রুপের জাহাজের নাবিকদের বেশিরভাগই দেশের জানিয়ে তিনি বলেন, ফলে কর্মসংস্থানেও ভূমিকা রাখছেন তারা।
কাস্টমস হাউজের তথ্য অনুযায়ী, মোট ১০০টি জাহাজ কেনায় বিনিয়োগের পরিমাণ ১৪৪ কোটি ডলার। যা দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১২০ টাকা হিসেবে)। এর মধ্যে শুধু গত পাঁচ বছরে যুক্ত হওয়া ৭১টি জাহাজে বিনিয়োগ হয়েছে ১১৪ কোটি ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৩ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা।
সরকারের নীতি সহায়তায় বাড়ছে কেনা
বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার কারণে বিশ্ববাজারে যখন জাহাজের দাম কমছিল, সেই সুযোগ নেয় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা।
২০১২ সাল পর্যন্ত দেশের ব্যবসায়ীদের জাহাজ কেনা বাড়ছিল। তখন জাহাজের সংখ্যা ছিল ৬৭টি। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকেই হঠাৎ জাহাজ কেনা কমতে শুরু করে। কমতে কমতে ২০১৫ সালে ৪৭টিতে নামে।
২০১৬ সালে জাহাজের সংখ্যা নামে ৪৫টিতে, ২০১৭ সালে ৩৮টি এবং ২০১৮ সালে এর সংখ্যা ৩৭টিতে নামে। এই অবস্থায় অনেক উদ্যোক্তা নিজেদের জাহাজ ভেঙে স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করতে শুরু করে।
জাহাজ কেনার ক্ষেত্রে ২০১৯ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড মূল্য সংযোজন কর এবং সম্পূরক শুল্ক কমিয়ে দেয়। আগে বিদেশি জাহাজ কিনে বাংলাদেশের বহরে যুক্ত করার ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ হারে শুল্ক দিতে হলেও তা কমিয়ে ১ শতাংশ করা হয়। এই সুযোগে শুধু ২০১৯ সালেই ৩টি জাহাজ যোগ হয়।
এরপর কোভিড মহামারি শুরু হলে বিশ্ববাজারে সমুদ্রগামী জাহাজের দামে ধস নামে। এই সুবিধা লুফে নিতে সরকার নতুন করে নীতি সহায়তা দেয়। সেই বাজেটে সমুদ্রগামী জাহাজ কেনায় অগ্রিম কর প্রত্যাহার, পুরনো জাহাজের আয়ুষ্কাল ২২ বছরের পরিবর্তে ২৫ বছর এবং আমদানির পর বিক্রির সময়সীমা পাঁচ বছরের পরিবর্তে তিন বছর নির্ধারণ করে দেয়।
এরপর ২০২০ সালে জাহাজের সংখ্যা বেড়ে এক লাফে ৬৪টিতে পৌঁছায়। এরপর ২০২১ সালে জাহাজের সংখ্যা আরও বেড়ে হয় ৭৩টি। ২০২২ সালে জাহাজের সংখ্যায় ১৫টি যোগ হয়, মোট দাঁড়ায় ৮৮টি।
২০২৩ সালে ১২টি জাহাজ যোগ হয়ে সংখ্যা বেড়ে হয় ৯০টি। সর্বশেষ ২০২৪ সালে জাহাজের সংখ্যা ৯৯টিতে উন্নীত হয়।