বাফুফে নির্বাচনে এবার উৎসাহীর সংখ্যা অনেক। গত চারবার আওয়ামীলীগ সরকারের নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে অনেকে অংশগ্রহণের সাহসই পাননি। বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন পরিচালিত নির্বাচনগুলো হতো সোহাগ-কিরণের নীল-নকশায়। তাদের প্রিয়ভাজন ছাড়া কেউ নির্বাচনে দাঁড়ালেই পোহাতে হয়েছে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা। এই নির্বাচনে সেই নিয়ন্ত্রণ উঠে যাওয়ায় হয়তো আগ্রহী-উৎসাহীর সংখ্যা এত বাড়-বাড়ন্ত। মাত্র ১৫ নির্বাহী সদস্য পদের জন্য লড়ছেন ৩৭ জন প্রার্থী।
এত বেশি লোকের অংশগ্রহণের মধ্যে চাল ও কাঁকর আলাদা করার কাজটি সঠিকভাবে করতে হবে কাউন্সিলরদের। এটা খুব সহজ কাজ নয়। তবে ফুটবলের ভালোর জন্য এটা খুব জরুরি, যা এতদিন সম্ভব হয়নি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে। তাই জাতীয় দলের সাবেক ফরোয়ার্ড সাইফুর রহমান মনির প্রত্যাশা অনেক বেশি এই নির্বাচনে, “আমি তৃতীয়বারের মতো নির্বাচন করছি। আগের দুইবার নির্বাচন করেও পাস করতে পারিনি। এবারও নির্বাচনে আছি, হারি-জিতি যাই হোক, এবার একটা ভাল কমিটি আসবে বলে আমার বিশ্বাস। তারা ফুটবল উন্নয়নে কাজ করবে।”
সদস্য পদের এই প্রতিদ্বন্দ্বি খেলা ছাড়ার পর জড়িয়ে আছেন ফুটবল কোচিংয়ের সঙ্গে। বাফুফে এতদিন যেভাবে চলেছে, সেভাবে চলার কোনও মানে খুঁজে পান না এই কোচ, “ফেডারেশনের বাইরে চিৎকার-চেঁচামেচি করে কোনো লাভ হয় না। কারণ বাফুফের ভেতরে চলে অন্য খেলা। প্রেসিডেন্ট বলার পর পাস-পাস বলে সবাই একমত হয়ে যায়। সভায় আলোচনার ভিত্তিতে কোন সিদ্ধান্ত হয় না, ফুটবলের মঙ্গলও হয় না। খেলোয়াড় তুলে আনার কোনও প্ল্যান-প্রোগ্রাম হয় না বাফুফেতে।”
দেশের ফুটবল এখন ধুঁকছে ফুটবলার সংকটে। সামগ্রিকভাবে ফুটবলারের সংখ্যাটা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ায় মান-সম্পন্ন খেলোয়াড়ও এখন পাওয়া যাচ্ছে না। সংখ্যাটা বাড়াতে গেলে দেশজুড়ে ফুটবল বিপ্লব লাগবে।
ফর্টিস ক্লাবের সভাপতি শাহীন হাসানের কাছে এই বিপ্লবের অন্যতম মাধ্যম হলো ফুটবল একাডেমি। ২০১৯ সালে তার ক্লাবের শুরুও হয়েছিল একাডেমি দিয়ে। বছর তিনেক পর ফর্টিস ক্লাব বিসিএল পার হয়ে এখন খেলছে প্রিমিয়ার লিগে। অভিজ্ঞতা থেকে এই ক্লাব সংগঠক বলছেন, “একাডেমির দিকে না ঝুঁকলে ফুটবলার সংকটের সমাধান হবে না। আমি চাই বাফুফের অধীনে প্রত্যেকটি বিভাগে ফুটবল একাডেমি গড়ে তুলতে। এরকম উদ্যোগ না নিলে মান সম্পন্ন খেলোয়াড় তুলে আনার উপায় নেই।”
বাফুফে নির্বাচনের এই সদস্য প্রার্থীর মতে, ফুটবলকে ব্যবসা হিসাবে না নিলে উন্নতি সম্ভব নয়, “ফুটবল এখন ব্যবসা। দল গড়তে প্রতিটা ক্লাবের একেকবার ৫ কোটি করে খরচ হয়, এভাবে হলে একসময় ক্লাবের মধ্যে অনীহা এসে যাবে। কারণ এখান থেকে কোনো রিটার্ন নেই। ব্যবসা শুধু ফুটবলার বিক্রি করে নয়, অন্যভাবেও লাভবান হওয়া যায়। নিজেদের একাডেমির ফুটবলার নিজেরা খেলালে এক মৌসুমে ৩ কোটি টাকা বেঁচে যায়। যেমন এবার আমার দলে একাডেমির ৭ ফুটবলার খেলেছে।” নির্বাচন জিতলে শাহীন ফর্টিস একাডেমির ধারনাটা শুরু করতে পারেন ফুটবল ফেডারেশনে।
একদিকে যেমন আধুনিক ফুটবল একাডেমির ধারনা অন্যদিকে জেলায় ফুটবল চর্চারও বিকল্প নেই। তাই জেলার ফুটবলার নিয়ে হাহাকার চলছে নিরন্তর। জেলা সংগঠকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা স্থানীয় ফুটবলে আন্তরিক নন। তবে চুয়াডাঙ্গা জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এখলাছ উদ্দীনের অনুযোগ, “আমরা প্রান্তিক পর্যায়ে যারা ফুটবলের কাজ করি, তাদের কথা কখনো বাফুফেতে এসে পৌঁছায় না। স্থানীয়ভাবে ফুটবল করতে কি সমস্যা সেটা কখনো জানতে চাওয়াও হয় না। বাফুফে একটা টাকাও দেয় না। কিন্তু এখানে বসে নানা কথা বলা যায়।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং থেকে পাস করা এই তরুণ এবার নির্বাচন করছেন সদস্য পদে। চুয়াডাঙ্গায় লিগ আয়োজনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলছেন, “আমার জেলায় কোনো বড় বাণিজ্যিক কারখানা নেই যে দু-একটা স্পন্সর আসবে ফুটবলে। ওখানে খেলা চালানোর টাকাও আমি দিই, মাঠের কামলাও আমাকে খাটতে হয়। ফুটবল ফেডারেশনকে পাশে পেলে ও জেলার প্রতি তারা আন্তরিকতা দেখালে এই কামলা খেটেও মনে শান্তি আসে।” সত্যি বললে, ফেডারেশন জেলার খবর নেয় চার বছরে একবার, বাফুফে নির্বাচন এলে।
চট্টগ্রাম ডিএফএ’র সভাপতি সৈয়দ মুহম্মদ শহীদুল ইসলামের সাংগঠনিকে ক্যারিয়ার প্রায় তিন দশকের। নিজে ফুটবল খেলেছেন, এরপর সাংগঠনিক কাজ করেই এতদিন কাটিয়ে দিলেও কখনো জাতীয় পর্যায়ে কাজ করার সাহস দেখাতে পারেননি। এবার বাফুফে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে তিনি বলছেন, “করোনার সময়ই আমরা লিগ করতে পারিনি,নইলে সবসময় খেলা হয়েছে চট্টগ্রামে। আরেকটা কথা, জেলাকে বাদ দিয়ে কখনো ফুটবলের সামগ্রিক উন্নয়ন করা যাবে না। আগের রমরমা ফুটবলের দিকে তাকিয়ে দেখেন, এটাই ঐতিহাসিক সত্য। এটা উপলব্ধি করতে হবে ফেডারেশনকে।”
মহিলা ফুটবল দলের সফল কোচ মাহমুদা খাতুন অদিতিও নেমেছেন ভোটের লড়াইয়ে। বসুন্ধরা কিংসের হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়নের এই কারিগর মনে করেন, “সঠিক পরিকল্পনা করে চললে আমাদের মেয়েদের ফুটবলের আরো এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। ছেলেদের ফুটবলের দিকে তাকান, আমাদের ক্লাবগুলো যে পরিমাণ অর্থ খরচ করে তার জাতীয় দলে কি আমরা তার রিটার্ন পাই? নিশ্চয়ই আমাদের পরিকল্পনায় গলদ আছে। আমি চাই, নতুন ফেডারেশন হোক মাঠমুখী, ফুটবল উন্নয়নমুখী।”