সংকটের মধ্যেও চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৬ দশমিক ০৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই তিন মাসে স্থিরমূল্যে এই জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৭৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
অর্থবছরের সাড়ে সাত মাস চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বৃহস্পতিবার জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রথম তিন মাসের এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
বিবিএসের হিসাবে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ০৭ শতাংশ। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এই হার ছিল ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ। তার আগে ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ।
এই হিসাব বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৬ দশমিক ০৭ শতাংশ বেড়েছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেখা যায়, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে স্থিরমূল্যে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ছিল ১০ লাখ ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৭৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে কৃষি ও সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি কমেছে। তবে শিল্প খাতে বেড়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কৃষি খাতে ২ দশমিক ০৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে তা কমে দশমিক ৮৪ শতাংশে নেমে এসেছে। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশে উঠেছে। আর সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি ১২ দশমিক ৮৭ শতাংশ থেকে কমে ৩ দশমিক ৯৬ শতাংশে নেমেছে।
অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সংকটের মধ্যে ৬ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনকে আমি খুবই ভালো বলে মনে করি। তবে বাকি তিন প্রান্তিকে কী হয়, সেটাই দেখার বিষয়।”
তিনি বলেন, “আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি— সংকটের এই সময়ে আমরা যদি ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারি তাও যথেষ্ট। প্রবৃদ্ধির দিকে না তাকিয়ে এখন আমাদের মূল্যস্ফীতি কমানোর দিকে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়তে হবে। ডলারের বাজার স্বাভাবিক করতে হবে।”
চলতি অর্থবছরে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। অর্থনীতির চলমান এ অবস্থায় তা অর্জিত হওয়া নিয়ে অর্থনীতিবিদরা বাজেট ঘোষণার পর থেকেই সংশয় প্রকাশ করে আসছেন।
অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতায় অর্থ মন্ত্রণালয় জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কমানো হবে বলে জানিয়েছে। তবে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি।
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে প্রান্তিকভিত্তিক (তিন মাস পরপর) জিডিপি হিসাব প্রকাশ করছে পরিসংখ্যান ব্যুরো। ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫-১৬ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত প্রান্তিকভিত্তিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির তথ্য প্রকাশ করা হয়। এরপর ২১ নভেম্বর ২০১৫-১৬ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত তথ্য প্রকাশ করে বিবিএস।
প্রান্তিকভিত্তিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব প্রকাশ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দিয়েই শুরু করল পরিসংখ্যান ব্যুরো।
এর ফলে এখন প্রতি অর্থবছরে চারবার জিডিপির হিসাব পাওয়া যাবে। প্রতিবার আগের তিন মাসের জিডিপির গতিপ্রকৃতির চিত্র মিলবে। পরে বছর শেষে তা গড় করা হবে।
দীর্ঘদিন ধরে প্রান্তিকভিত্তিক জিডিপির হিসাব করার তাগিদ দিয়ে আসছিলেন দেশের গবেষক ও অর্থনীতিবিদেরা। দুই বছর আগে এ নিয়ে উদ্যোগও গ্রহণ করে বিবিএস। এ জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনুমোদনও নেওয়া হয়।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ। এই ঋণের দুই কিস্তি ইতোমধ্যে পেয়েছে সরকার। ঋণের শর্ত হিসেবে আইএমএফ বলেছে, তিন মাস পরপর জিডিপির হালনাগাদ হিসাব প্রস্তুত করতে হবে। পাশাপাশি শ্রমশক্তি জরিপও প্রান্তিকভিত্তিক করতে হবে।
সেই শর্ত পূরণের অংশ হিসেবেই বিবিএস প্রান্তিকভিত্তিক জিডিপির হিসাব প্রকাশ করছে। ইতোমধ্যে প্রান্তিকভিত্তিক শ্রমশক্তি জরিপ প্রকাশ শুরু হয়েছে।
এতদিন পুরো এক বছরের হিসাব দিয়ে দুই বার জিডিপির তথ্য প্রকাশ করত বিবিএস। সংশ্লিষ্ট অর্থবছরের প্রথম ছয়-সাত মাসের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রথমে জিডিপির আকার, প্রবৃদ্ধিসহ সাময়িক হিসাব দেওয়া হত। পরে পুরো বছরের তথ্য নিয়ে প্রকাশ করা হত জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব।
তিন মাস পরপর জিডিপিতে সুবিধা
প্রান্তিকভিত্তিক জিডিপির হিসাব প্রকাশের নানা ধরনের সুবিধা আছে। সাধারণত কৃষি, শিল্প ও সেবা— এই তিন খাতের মূল্য সংযোজন দিয়ে জিডিপির হিসাব করা হয়। এ জন্য মোটাদাগে ১৯টি খাতের তথ্য-উপাত্ত নেওয়া হয়। এ তালিকায় আছে কৃষি, প্রাণিসম্পদ, কলকারখানা, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা, নির্মাণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, পরিবহন, শিল্প-সংস্কৃতি, গ্যাস-বিদ্যুৎ ইত্যাদি।
তিন মাস পরপর হিসাব প্রকাশ করা হলে এসব খাতের মূল্য সংযোজন কত হলো, তা জানা যাবে। কোনও খাতের মূল্য সংযোজন কমে গেলে, সেই বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া যাবে।
আহসান মনসুর বলেন, “প্রান্তিকভিত্তিক জিডিপি হিসাব করলে নীতিনির্ধারকেরা অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা ও সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন।”