জানুয়ারিতে ৪৫ কোটি ডলার রেমিটেন্স এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। সৌদি আরব থেকে এসেছে এর তিন ভাগের এক ভাগ- ১৫ কোটি ৫৬ লাখ ডলার। শুধু জানুয়ারি নয়, গত কয়েক মাস ধরেই সৌদি আরবের তুলনায় সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বেশি রেমিটেন্স দেশে আসছে। অথচ বরাবরই সৌদি আরবে অবস্থানকারী প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স পাঠিয়ে আসছেন।
হিসাব বলছে, গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে সৌদি আরব থেকে যে পরিমাণ রেমিটেন্স এসেছে, আরব আমিরাত থেকে এসেছে তার দ্বিগুণের বেশি; শতাংশের হিসাবে যা প্রায় ৫২ শতাংশ। এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় আমিরাত থেকে ৮৪ শতাংশ বেশি রেমিটেন্স এসেছে, ৫১ শতাংশ বেশি এসেছে যুক্তরাজ্যের চেয়ে।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে ৩৭৬ কোটি ৫৩ লাখ (৩.৭৬ বিলিয়ন) ডলার এসেছিল। আরব আমিরাত থেকে এসেছিল ২৪ দশমিক ১০ শতাংশ কম, ৩০৩ কোটি ৩৮ লাখ (৩.০৩ বিলিয়ন)। তার আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) সৌদি থেকে ৪৫৪ কোটি ১৯ লাখ (৪.৫৪ বিলিয়ন) ডলার প্রবাসী আয় দেশে আসে। আমিরাত থেকে আসে অর্ধেকেরও কম, ২০৭ কোটি ১৮ লাখ (২.০৭ বিলিয়ন) ডলার।
এই দুই অর্থবছরে তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রবাসী আয়ের উৎস ছিল আরব আমিরাত। দ্বিতীয় ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই দুই দেশকে পেছনে ফেলে শীর্ষে চলে এসেছে আরব আমিরাত। এই অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) দেশটিতে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ২ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন, যা এই সাত মাসে আসা মোট রেমিটেন্সের প্রায় ১৯ শতাংশ।
জুলাই-জানুয়ারি সময়ে বিভিন্ন দেশে থেকে মোট ১২ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার প্রবাসী আয় দেশে এসেছে। এই সাত মাসে সৌদি আরব থেকে রেমিটেন্স এসেছে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে ১ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে ১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার দেশভিত্তিক রেমিটেন্সের হালনাগাদ এই তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, জুলাই-জানুয়ারি সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছে আরব আমিরাত থেকে। দ্বিতীয় স্থানে আছে যুক্তরাজ্য। শীর্ষ থেকে তৃতীয় স্থানে নেমে এসেছে সৌদি আরব। গত দুই অর্থবছরে দ্বিতীয় স্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্র নেমে এসেছে চতুর্থ স্থানে।
হঠাৎ করে আরব আমিরাত থেকে রেমিটেন্সের এই উল্লম্ফন কেন— এ প্রশ্নের উত্তরে অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “অদ্ভুদ একটা কারণ খুঁজে পেয়েছি। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার হচ্ছে সৌদি আরব। আমিরাতে সৌদির চার ভাগের এক ভাগ প্রবাসীও অবস্থান করেন না। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে— সৌদির চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি রেমিটেন্স আসছে আরব আমিরাত থেকে।”
এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “ওই যে একটা কথা আছে না— টাকায় টাকা আনে। এখানেও ঘটেছে তাই। আরব আমিরাত থেকে রেমিটেন্স পাঠালে প্রবাসীরা প্রতি ডলারে ৩/৪ টাকা বেশি পাচ্ছেন। সে কারণে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলো থেকে রেমিটেন্সের একটি বড় অংশ এখন দুবাই হয়ে দেশে হয়ে আসছে। সে কারণে কাগজে-কলমে আমিরাত থেকে রেমিটেন্স বেশি আসছে।”
বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে আহসান মনসুর বলেন, “সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবি হলেও দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় দুবাইকে ঘিরে। দুবাই একটি বৈশ্বিক শহর এবং মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র। মধ্যপ্রাচ্যে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নসহ বিশ্বের বড় বড় মানি ট্রান্সফার কোম্পানির কার্যক্রম দুবাইকেন্দ্রিক।
দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর বলেন, “দেশে ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো এখন রেমিটেন্স সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে ৬/৭ টাকা বেশি দামে রেমিটেন্স আনছে ব্যাংকগুলো। রেমিটেন্স বাড়াতে ব্যাংকগুলো এখন বেশি দরে রেমিটেন্স আনলেও বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু বলছে না। দুবাই হয়ে রেমিটেন্স আসলে ডলারের বিপরীতে বেশি টাকা পাওয়া যায়। সে কারণেই এখন সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোতে অবস্থানকারী প্রবাসীরা রেমিটেন্স দুবাই হয়ে দেশে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন।”
“কোথাটার টাকা কোথায় যাচ্ছে— কিছুই বলা যাচ্ছে না। দুবাইকেন্দ্রিক একটি গ্রুপ এক্ষেত্রে কাজ করছে”, বলেন তিনি।
একই কথা বলেছেন জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার।
তিনি বলেন, “প্রবাসীরা যেখানে টাকা বেশি পাবেন, সেখান থেকেই পাঠাবে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে— গত দুই বছরে আরব আমিরাতে আমাদের অনেক লোক গেছেন কাজের জন্য। তারা কাজ করছে, রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন।”
আরব আমিরাত থেকে রেমিটেন্সের উল্লম্ফনের আভাস গত অর্থবছরেই পাওয়া গিয়েছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশটি থেকে ৩০৩ কোটি ৩৮ লাখ ৫০ হাজার (৩.০৩ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ৪৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেশি।
প্রথমবারের মতো আমিরাত থেকে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স দেশে আসে ২০২২-২৩ অর্থবছরে। গত অর্থবছরে তিনটি দেশ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স এসেছিল। বাকি দুটি দেশ ছিল- সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র।
গত অর্থবছরের কয়েক মাসেও শীর্ষে ছিল আমিরাত
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে কোনও কোনও মাসে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি প্রবাসী আয় এসেছিল আরব আমিরাত থেকে। যেমন, ২০২২ সালের মার্চে আরব আমিরাত থেকে ৩০ কোটি ৭৬ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ওই মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছিল ৩০ কোটি ৩৯ লাখ ডলার। আর সৌদি আরব থেকে এসেছিল ২৮ কোটি ৩ লাখ ডলার।
২০২৩ সালের জানুয়ারি এবং ২০২২ সালের মে মাসেও সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি রেমিটেন্স এসেছিল আরব আমিরাত থেকে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এর আগে একক মাসের হিসাবে আমিরাত থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স দেশে আসে গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে, ৪৪ কোটি ২৯ লাখ ডলার। সেই রেকর্ড ভেঙে জানুয়ারিতে ৪৪ কোটি ৭১ লাখ ১০ হাজার রেমিটেন্স এসেছে আমিরাত থেকে।
স্বাধীনতার পর থেকে শীর্ষে ছিল সৌদি আরব
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে বরাবরই সৌদি আরব থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসছে। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবাসীরা মোট ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ (২৪.৭৮ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন। তার মধ্যে সৌদি আরব থেকে এসেছিল ৫৭২ কোটি ১৪ লাখ (৫.৭২ বিলিয়ন) ডলার।
দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, এসেছিল ৩ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। আর সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছিল ২ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাজ্য থেকে এসেছিল ২ দশমিক শূন্য দুই বিলিয়ন ডলার।
কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিটেন্স প্রবাহ ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কমে যায়; আসে ২১ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার; সব দেশ থেকেই কম আসে অর্থনীতির এই সূচক।
ওই অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে ৪ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার আসে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে ৩ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছিল ২ দশমিক শূন্য সাত বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাজ্য থেকে আসে ২ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের শীর্ষ শ্রমবাজার সৌদি আরব। ১৯৭৬ সাল থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে কাজের জন্য যত শ্রমিক বিদেশে গেছেন, তার প্রায় ৩৬ শতাংশই গেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে, সংখ্যায় যা ৫৫ লাখের বেশি। এই সময়ে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া শ্রমশক্তির প্রায় ২০ শতাংশ গেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে, যা সংখ্যায় প্রায় আট লাখ।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। তাদের বড় অংশই রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে; কাজ করছেন বিভিন্ন শ্রমঘন পেশায়।
তেলশিল্পের কারণে আরব আমিরাতের অর্থনীতি অনেক শক্তিশালী এবং জীবনযাত্রার মানের দিক দিয়ে এই দেশ বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর একটি। সম্প্রতি আরব আমিরাত তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করছে। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে দেশটি পর্যটনশিল্প এবং পণ্য উৎপাদনের ওপর জোর দিচ্ছে।
এটিও চাঙা থাকা অর্থনীতির এই দেশ থেকে বাংলাদেশে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ার আরেকটি কারণ বলে মনে করেন আহসান মনসুর।