শিন গার্ড ও কেডস জোড়া হালকা ঝাড়া দিয়ে তুলে নিলেন এক হাতে। আরেক হাতে নিলেন নীল রঙের ট্রেনিং ম্যাট। বুধবার সন্ধ্যায় যখন ছোট্ট বেণী দুলিয়ে কমলাপুর স্টেডিয়ামের টার্ফ ছাড়ছিলেন মোসাম্মৎ সাগরিকা, মুখে লেগে ছিল স্নিগ্ধ হাসি। শুধু সাগরিকা নয়, পুরো বাংলাদেশ দলেই যে হাসিটা সংক্রামক হয়ে রইলো অনুশীলনের সময়।
বয়সভিত্তিক সাফের যতগুলো টুর্নামেন্টে এ পর্যন্ত অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ এর মধ্যে চারটি বিভাগে হয়েছে (অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৮, অনূর্ধ্ব-১৯ ও অনূর্ধ্ব-২০) চ্যাম্পিয়ন। সেই ধারাবাহিকতায় শোকেসে আরেকটি ট্রফি তোলার অপেক্ষায় বাংলাদেশের মেয়েরা। বৃহস্পতিবার অনূর্ধ্ব-১৯ সাফের ফাইনালে বাংলাদেশ মুখোমুখি হবে শক্তিশালী ভারতের। ফাইনালের আগে বুধবার শেষ বারের মতো কমলাপুরে নিজেদের ঝালিয়ে নিয়েছেন সাগরিকা-আফঈদারা। ম্যাচটি শুরু হবে সন্ধ্যা ৬টায়। ফাইনাল সরাসরি সম্প্রচার করবে বাংলাদেশ টেলিভিশন। খেলা দেখা যাবে ইউটিউবেও।
এই ভারতকে ভয় পাচ্ছে না বাংলাদেশ
ভারতের মেয়েদের জাতীয় দলের ফিফা র্যাঙ্কিং ৬৫। বাংলাদেশের ১৪০। বড়দের টুর্নামেন্টে এক সময় ভারতের কাছে নিয়মিত হারতে থাকা বাংলাদেশই এখন প্রতিবেশী দেশটির জন্য বড় হুমকি। এই তো ২০২২ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত বড়দের সাফে ভারতকে প্রথমবার হারিয়ে দেন সাবিনা খাতুনরা। ছোটদের সাফে সবসময়ই ভারতকে চোখ রাঙিয়ে আসছে বাংলাদেশ।
এই টুর্নামেন্টের পরিসংখ্যানের কথাই ধরা যাক। অনূর্ধ্ব-১৯ সাফের দুটি আসরে এ পর্যন্ত ৩ বার ভারতের মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ। ৩ বারই জয়ী বাংলাদেশের মেয়েরা। এবারও জয় ছাড়া অন্য কিছু ভাবছেন না কোচ সাইফুল বারী টিটু।
২০২১ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ সাফের প্রথম টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। ওই দলে খেলেছিলেন মারিয়া মান্দা, মনিকা চাকমা, ঋতুপর্ণা চাকমা, শামসুন্নাহার জুনিয়র, রুপনা চাকমা। বয়সভিত্তিক দল ছেড়ে যারা এখন জাতীয় দল মাতাচ্ছেন।
একটা সময় ভাবা হতো, মারিয়া-রূপনাদের বিকল্প হয়তো পাওয়া যাবে না। কিন্তু আফঈদা, সাগরিকা, মুনকি আক্তাররা এরই মধ্যে নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছেন। বিশেষ করে সাগরিকা এই টুর্নামেন্টের বড় আবিষ্কার। টুর্নামেন্টে ২ ম্যাচেই অসাধারণ ফুটবল উপহার দিয়েছেন। করেছেন ৩ গোল। ভারতের বিপক্ষে শেষ মিনিটে অফসাইড ভেদ করে চিতার গতিতে বের হয়ে বলের দখল নিয়ে ভারতের পোস্টে ঢোকেন সাগরিকা। ঠান্ডা মাথার ফিনিশিংয়ে করেন গোল। অ্যাঙ্গেল ব্লক করেও গোল বাঁচাতে পারেননি ভারতের গোলরক্ষক অনিকা দেবী। বৃহস্পতিবারও পুরো বাংলাদেশ এই সাগরিকাকেই দেখতে চাইবে।
আঁখির বিকল্প আফঈদা
রক্ষণে আফঈদাও যেন আঁখি খাতুনের বিকল্প হয়ে উঠেছেন। দূরপাল্লার নিখুঁত শট নেওয়ার বাড়তি দক্ষতা রয়েছে সাতক্ষীরার এই মেয়ের। গত আসরে আফঈদা ছিলেন দলের সাধারণ ফুটবলার। এবার অধিনায়ক। গতবার লিগ পর্বে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হ্যাটট্রিক পেয়েছিলেন ডিফেন্ডার আফঈদা। এবারও ভারতের বিপক্ষে যোগ করা সময়ে সাগরিকার গোলটিতে বড় অবদান ছিল তার।
মাঝমাঠে স্বপ্না রানী, পূজা দাস। দুই উইংয়ে ইতি খাতুন, বন্যা খাতুন। ফলস নাইন হিসেবে কোচ খেলাচ্ছেন মুনকি আক্তারকে। আর সবার আগে দলের প্রধান অস্ত্র সাগরিকা। ভারতের কোচ শুক্লা দত্ত নিশ্চয়ই সাগরিকার জন্য আলাদা কোনও পরিকল্পনা করে রেখেছেন!
শক্তিতে সমান ভারত-বাংলাদেশ
ভারত যতোই লিগ ম্যাচে বাংলাদেশের কাছে হারুক না কেন, শক্তিতে সমান সমানই বাংলাদেশের। এই দল খেলছেন ভারতে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ চার ফুটবলার। বিশেষ করে ভারতের নিতু লিন্ডা, নেহা, সুলঞ্জনা রাউল, পূজা হতে পারে বাংলাদেশের জন্য আতঙ্ক।
ইস্ট বেঙ্গলের ফরোয়ার্ড সুলঞ্জনা মারাত্মক গতিময় ফুটবলার। বুদ্ধিদীপ্তও। লিগে প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে অফসাইড হওয়ার মুহূর্তেও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে যায়। বাংলাদেশ কোচ সাইফুল বারী টিটুও আলাদা নজর রাখতে চাইবেন সুলঞ্জনার, “ও খুবই চতুর খেলোয়াড়। গত ম্যাচে ইচ্ছা করে অফসাইডে ছিল। কিন্ত বল আসতে দেখে দাড়িয়ে গেছে। সে ওদের গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলার।”
নেহা বাম পায়ে অনেক দূর থেকে ক্রস ফেলতে পারে। তাকেও চোখে চোখে রাখতে চাইবেন বাংলাদেশের ডিফেন্ডাররা।
প্রথম ট্রফি জেতার সুযোগ কোচের
জাতীয় নারী দলের সব সাফল্য এসেছে গোলাম রব্বানী ছোটনের হাত ধরে। তার চলে যাওয়ার পর সাইফুল বারীর সামনে প্রথম শিরোপা জয়ের হাতছানি। ম্যাচে জয় ছাড়া কিছু ভাবছেন না তিনি। মেয়েদেরও জানিয়ে দিয়েছেন এই ম্যাচে কি করতে হবে, “মেয়েরা খুব বেশি উজ্জীবিত। ওরা এর আগেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। আমার মনে হয় ওদের খুব বেশি কিছু বলতে হবে না। ওরা জানে ওদের কি করতে হবে। এত কষ্টকরে ফাইনালে এসে তো সবাই চাইবে শিরোপা জিততে “
ভারতের কোচ শুক্লা দত্তও প্রতিশোধ নিতে মুখিয়ে রয়েছেন, “গত তিন বছর ধরে এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের কাছে হেরেছে ভারত। আমি এটা নিয়ে মোটেও খুশি না। সময় এসেছে সেটার বদলা নেওয়ার। আগামীকালই সেটার মোক্ষম সুযোগ।”
বাংলাদেশ দলের বড় অস্ত্র সাগরিকার জন্য একটা ‘সারপ্রাইজ’ হতে পারে আজ। ঠাঁকুরগাও থেকে মেয়ের খেলা দেখতে গ্যালারিতে থাকবেন বাবা মোহাম্মদ লিটন আলী। মেয়েকে চমকে দিতে ঢাকায় আসছেন তিনি, যেটা জানেন না সাগরিকা। ট্রফিটা জিতে নিশ্চয় প্রথমবার ঢাকায় আসা বাবাকেও বড় উপহার দিতে চাইবেন বাংলাদেশের স্ট্রাইকার।