স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে ২০২৬ সালে বাংলাদেশকে পুরোপুরি বের হতে হবে। তবে সরকার এখন এই সময়সীমা কিছুটা বাড়াতে চায়। সকাল সন্ধ্যাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনটাই জানিয়েছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু।
তিনি বলেন, “২০২৬ সালেই (এলডিসি থেকে উত্তরণের সময়) শেষ হবে বিষয়টি ঠিক এমন না, যেমন ইউরোপে আমরা জিএসপি সুবিধা পেয়েছি ২০২৯ পর্যন্ত। প্রথম পর্যায়ে আমাদের লক্ষ্য হলো এলডিসি গ্র্যাডুয়েশনের সময়টা আমরা একটু বাড়িয়ে নিতে পারি কিনা, ৪-৫ বছর। কমপক্ষে ৩ বছর বাড়াতে পারব বলে আমরা আশাবাদী।”
বাংলাদেশসহ বিশ্বে এখন স্বল্পোন্নত দেশের সংখ্যা ৪৫টি। এর মধ্যে এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় আছে বাংলাদেশসহ ছয় দেশ। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) এলডিসিভুক্ত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের বিষয়ে সুপারিশ করে।
নিয়ম অনুযায়ী, এলডিসি তালিকা থেকে উত্তরণের পর বিশ্বের বেশিরভাগ বাজারেই শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাওয়া যায় না। তবে গত অক্টোবরে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) জানায়, স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যেতে সহায়তার অংশ হিসেবে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া হবে।
২০২৬ সালে এলডিসিভুক্ত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশে উত্তরণের বিষয়টি সামনে রেখে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য (জানুয়ারি-জুন) রপ্তানিতে প্রণোদনার নতুন হার ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে তৈরি পোশাক, হস্তশিল্প, প্লাস্টিক, কৃষি, চামড়াসহ ৪৩ খাতের পণ্যে রপ্তানির বিপরীতে বিভিন্ন হারে আর্থিক প্রণোদনা কমানো হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, “আমরাও বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারটা পেয়েছি। আমাদের মন্ত্রণালয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা ২০২৬ সালে স্বল্পন্নোত দেশ থেকে উত্তোরণের লক্ষ্যে ধীরে ধীরে প্রণোদনা কমাব। কিন্তু এ মুহূর্তে কমানোর কোনও প্রস্তাব আমরা মন্ত্রণালয় থেকে দেই নাই।”
তিনি বলেন, “আমরা সার্কুলারটা রিভিউ করছি। রিভিউ করে প্রয়োজনীয় মতামত আমরা বাংলাদেশ ব্যাংককে দেব। কোনটি যৌক্তিক এবং কোনটি অযৌক্তিক সেই প্রতিবেদন আমরা দেব কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে কথা হয়েছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “তিনি আমাকে বলেছেন- ডলার ৮৬ টাকা ছিল, এখন ১১০ টাকা। প্রায় ৩১ শতাংশ আমাদের রপ্তানিকারকরা কিন্তু বেশি পাচ্ছে। অনেকদিন ধরেই রপ্তানিকারকদের দাবি ছিল ডলারকে রি-ভ্যালুয়েশন করে দেওয়ার।
“যেহেতু রপ্তানিকারকরা সেইখানে লাভবান হয়েছেন, আমদানিতে এর জন্য কিন্তু আমাদের ক্ষতি হচ্ছে। ফলে এটাই বাংলাদেশ ব্যাংকের যুক্তি, যেহেতু গত এক বছরে বড় একটি লাভ রপ্তানিকারকরা পেয়েছে ডলার রি-ভ্যালুয়েশনের জন্য, সেহেতু ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় হস্ত শিল্পকে এ বছরের বর্ষপণ্য হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। সকাল সন্ধ্যার সঙ্গে আলাপকালে হস্তশিল্প নিয়েও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা জানান বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “আপনারা জানেন মূলত পাট, চামড়া, বাঁশ, বেত দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি হয় এবং এখানে মূল্য সংযোজন শতভাগ। এখানে সবই দেশি কাঁচামাল। আমরা একটি পরিকল্পনা নিয়েছি, প্রধানমন্ত্রী একটি দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন।
“যেহেতু হস্তশিল্প রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর অধীনে, ফলে বাণিজ্য মেলা শেষ হলেই আমরা তাদের সঙ্গে একটি বৈঠক করব। আমাদের একটি পরিকল্পনা আছে, সেই পরিকল্পনাটা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আমরা চূড়ান্ত করব।”
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের খসড়া পরিকল্পনা নিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “একটি গ্রাম একটি পণ্য। সকল গ্রাম থেকে একটি করে পণ্য নিয়ে ইউনিয়ন থেকে শুরু করে উপজেলা-জেলা-বিভাগ হয়ে ঢাকায় আমরা একটি বড় প্রদর্শনী করব, সেখানে আমরা তাদের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা দেব।
“সবচেয়ে বড় যে সহায়তা দেব, তা হলো বাজারজাতকরণ। উপজেলা-জেলার পণ্য যেন সারা বাংলাদেশে মার্কেটিং হয়। পণ্যের মার্কেটিং মেলার মাধ্যমে আমরা করব, ই-কমার্সের মাধ্যমেও করব। সর্বোপরি, এ পণ্যগুলোর মান বৃদ্ধি করে পণ্যের বৈচিত্র্যতা তৈরির মাধ্যমে সারা বিশ্বে যেন বাজার পায়, সেই উদ্যোগ আমরা নেব।”
এরই মধ্যে বেশ কিছু কাজ শুরু হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের ২০টি দেশে ২৩ জন বাণিজ্যিক কাউন্সিলর রয়েছেন। তাদেরকে এরইমধ্যে বলেছি যেন তারা যেসব দেশে রয়েছেন সেসব দেশের ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে, কীভাবে আমাদের হস্তশিল্পকে প্রমোট করা যায়, সেই বিষয়ে উদ্যোগ নেয়।”
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ ভাগই আসে তৈরি পোশাক শিল্প থেকে। রপ্তানি বাজারের ৬২ দশমিক ৮৮ শতাংশই ইউরোপীয় ইউনিয়ন (৪৫ দশমিক ৪২ শতাংশ) ও যুক্তরাষ্ট্রে (১৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ) ।
পণ্যে ও বাজারে বৈচিত্র্য আনাকেই মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নতুন প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু।
তিনি বলেন, “আমাদের রপ্তানির বড় অংশই আসছে তৈরি পোশাক থেকে। পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ বাজারের বৈচিত্র্যতা। আমরা অনেক বেশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকার বাজারের ওপর নির্ভরশীল।
“আমরা এদের সঙ্গে নতুন বাজার নিয়ে কাজ করছি। এর মধ্যে সিআইএফের ১২টি দেশ, আফ্রিকার দেশ বা আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে সাথে ভারত, চীনসহ এশিয়ান বাজার আছে।”
তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘লুক টুয়ার্ডস ইস্ট’। এই লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় কাজ করছে।”
প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আমরা আমাদের আশেপাশের অঞ্চলগুলোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছি, সার্কভুক্ত দেশগুলো এবং ভারতের সেভেন সিস্টারস- এসব অঞ্চলে কীভাবে আমাদের বাণিজ্য বাড়াতে পারি তার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।”