Beta
বুধবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
বুধবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৫

‘দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক চিত্র বদলে দিচ্ছে বাংলাদেশ-পাকিস্তান’

কায়রোর সেন্ট রেজিস নিউ ক্যাপিটাল হোটেলে বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি : পিআইডি
কায়রোর সেন্ট রেজিস নিউ ক্যাপিটাল হোটেলে গত বছরের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ফাইল ছবি : পিআইডি
[publishpress_authors_box]


বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের নৈকট্য দক্ষিণ এশিয়াকে স্থিতিশীল করবে, এমনটা মোটেও নয়; তবে আঞ্চলিক রাজনীতির পারদ যে চড়াবে, তা বলাই যায়। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের ওপর ভারতের চাপ আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। গত বছর বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসন অবসানের পর দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এমন বিশ্লেষণ উঠে এসেছে দ্য ডিপ্লোমেটে প্রকাশিত এক লেখায়।

গত আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে দুটি মোড় নিেয়ছে। একটি হলো, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্রমাবনতি। পালাবদলের এই সময়ে নয়া দিল্লি চেষ্টা চালিয়েও এই অবনতির ধারা ঠেকাতে পারেনি।

২০০৪ সালের শুরুটা হয়েছিল, বাংলাদেশকে উদাহরণ দেখিয়ে ভারতের ‘প্রতিবেশীই প্রথম’ নীতির বড় সাফল্যগাথা দিয়ে। কিন্তু বছর শেষে এর সীমাবদ্ধতার সবচেয়ে বড় নজির হয়েছে বাংলাদেশেই।

ঢাকা-দিল্লির বন্ধন ঢিলে হয়ে যাওয়া নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। তবে এর অভিঘাত দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে দিচ্ছে আরেকটি মোড়।

নয়া দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক নাজুক হওয়ার বিপরীতে ঢাকার সঙ্গে ইসলামাবাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে শনৈ শনৈ উন্নতি দৃশ্যমাণ হচ্ছে।

রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার তিন বছর পর নতুন দেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিল ইসলামাবাদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাশে দাঁড়িয়েছিল পাকিস্তানের বৈরী প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত।

তারপর চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যেই চলেছে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের সম্পর্ক। গত গত কয়েক মাসে সামরিকসহ নানা ক্ষেত্রে সম্পর্ক উন্নয়নে দুই দেশের এগিয়ে আসার আগ্রহ লক্ষণীয়।

কৌশলগত সম্পর্ক ও ভারতের উদ্বেগ

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে তেমন কিছুই করেননি; বিশেষ করে নয়া দিল্লির যে দুটি প্রধান উদ্বেগের বিষয়, উগ্রবাদীদের শক্তিশালী হওয়া কিংবা হিন্দুদের ওপর আক্রমণ, সেগুলো নিয়ে কিছু করেননি।

বিপরীতে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে মনোযোগী হয়েছেন তিনি। কায়রোয় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে ১৯৭১ সাল থেকে অমীমাংসিত সব বিরোধ মিটিয়ে ফেলার কথা বলেছেন। শরিফও বিষয়টি দেখবেন বলে জানিয়েছেন, সেই সঙ্গে ‘ভ্রাতৃপ্রতিম’ দুই দেশের সম্পর্কের কৌশলগত সম্পর্ক আরও এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন।

এর পরপরই কয়েকটি পদক্ষেপ সাক্ষ্য দেয়, দুই দেশের কৌশলগত সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ায় উভয় সরকারই গুরুত্ব দিচ্ছে।  

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসানের একটি একটি সামরিক প্রতিনিধি দল পাকিস্তানে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের কাছ থেকে।

বাংলাদেশ নৌবাহিনী পাকিস্তান নৌবাহিনীর বার্ষিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে। প্রতিরক্ষায় সহযোগিতার সম্পর্ক বাড়ানোর ক্ষেত্রে এগুলো বড় পদক্ষেপ।

পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর প্রধানের বাংলাদেশ সফরের খবরও দিয়েছে ভারতের সংবাদপত্রগুলো; যদিও ঢাকা বিষয়টি স্বীকার করেনি।

কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে এগুলো যতটা না বড় পদক্ষেপ; এটা তার চেয়ে বেশি ইঙ্গিত দেয় যে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সহযোগিতা বাড়াতেই দুই পক্ষ আগ্রহী।

বাংলাদেশ-পাকিস্তানের এই ঘনিষ্ঠতা স্বাগত জানাবে চীন। কারণ পাকিস্তান তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আবার চীন বাংলাদেশের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে। বলাই বাহুল্য যে এটা দিল্লির উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।

ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কের এই গতি নিরাপত্তা সম্পর্কিত তিনটি বিষয়ে দিল্লির উদ্বেগ তৈরি করেছে।

এক, অভ্যুত্থানের সময় এক ঝাঁক জঙ্গির কারাগার থেকে বেরিয়ে আসা, যাদের কট্টর ভারতবিরোধী অবস্থান রয়েছে।

দুই, বাংলাদেশি হিন্দুদের ওপর এই জঙ্গিদের আক্রমণ, যা নিয়ে ভারতেও হিন্দু সংগঠনগুলোর চাপে রয়েছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। দিল্লি এনিয়ে তাদের উদ্বেগ এরই মধ্যে ইউনূস সরকারকে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও তুলে ধরেছে।

তিন, দিল্লি এই কারণে উদ্বিগ্ন যে পাকিস্তান বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাতে পারে। মনিপুর রাজ্যে কুকিদের অস্ত্র সরবরাহ শুধু ওই রাজ্যেই নয়, গোটা অঞ্চলে সংঘাত উসকে দিতে পারে।

পাকিস্তানের কী লাভ

ভারত তার বিশাল অর্থনীতি আর সাংস্কৃতিক আধিপত্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় যে প্রভাব তৈরি করে, তাতে পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।

কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের অবনতি, পাশাপাশি ইউনূস সরকারের পাকিস্তানমুখী তৎপরতা ইসলামাবাদের জন্য নতুন সুযোগ হয়ে এসেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় একঘরে হয়ে পড়া পাকিস্তান আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।

ভারতকে বিপদে ফেলা যায়- এমন সুযোগ কখনও হাতছাড়া করে না পাকিস্তান। এখন এখন বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক ভারতের ভঙ্গুর জায়গা অর্থাৎ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জটিলতা সৃষ্টির একটি পথ করে দিয়েছে পাকিস্তানকে।

গত কয়েক দশকে পাকিস্তানের হাত থেকে আফগানিস্তানকে নিজের হাতে আনার কাজটি করে গেছে ভারত। এখন পাকিস্তানেরও সুযোগ হয়েছে, ভারতের হাত থেকে বাংলাদেশকে বের করে নিয়ে তার প্রতিশোধ নেওয়ার।

ভারতের মতো বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা দেওয়ার অবস্থা পাকিস্তানের নেই। ভারত বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছিল বাংলাদেশকে, তা দিতে পারবে না পাকিস্তান।

বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ১৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়, যা বাংলাদেশ-পাকিস্তানের বাণিজ্যিক লেনদেনর ১৫ গুণ। ফলে অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের কাছে ভারতের বিকল্প হতে পারবে না পাকিস্তান।

তাই পাকিস্তানকে ভর করতে হবে ভারত বিরোধিতা দিয়ে। আর এই পথে বাংলাদেশিদের নিতে পারলে বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের নতুন আঙ্গিকে সম্পর্ক গড়ার প্রয়াস সফল হতে পারে।

বাংলাদেশের চাওয়া কী

বাংলাদেশের নতুন সরকার জাতীয়তাবাদের নতুন সংজ্ঞায়নের পথে হাঁটছে, তার ভিত্তিতে নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে তারা, খুঁজছে নতুন মিত্র। এটা স্পষ্ট হচ্ছে ইউনূস সরকারের চাওয়ায়, তারা শেখ হাসিনা কর্তৃত্ববাদী শাসন অবসানের পর ভারতের আধিপত্য থেকেও মুক্তি পেতে চাইছে।

তাদের এই চাওয়া দেশের অভ্যন্তরে যেমন পরিবর্তন আনছে, তেমনি ভারতের নিয়ন্ত্রণমুক্ত পররাষ্ট্র নীতির পালেও হাওয়া দিচ্ছে।

আর এই সমস্যাটি আরও জটিল করে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনরায় প্রেসিডেন্ট হওয়া। কারণ আগের জো বাইডেন প্রশাসনের সময়ে যেভাবে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সহায়তা পাওয়া যেত, তা আর পাওয়া নাও যেতে পারে।

আর তা বাংলাদেশ সরকারকে আরও নাজুক অবস্থায় ঠেলে দিলে সে পাকিস্তান ও চীনের দিকে আরও ঝুঁকে পড়তে পারে।

বাংলাদেশের এই পরিস্থিতি পাকিস্তানকে আরও প্রাসঙ্গিক করার পাশাপাশি চীনের প্রভাব বাড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক চিত্র বদলে দিচ্ছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বেড়ে যাওয়ার প্রকাশ এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে। তবে বাণিজ্য বাড়ানোর মাধ্যমে চীন-ভারত সম্পর্ক গলার যে ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ নিয়ে তাদের নতুন ভাবনার অবকাশও রয়েছে।

তাহলে চীনের এড়িয়ে চলা আর যুক্তরাষ্ট্রের অনিশ্চয়তার মধ্যে হঠাৎ পাকিস্তানপ্রেমী বাংলাদেশ পড়ে যাবে যুদ্ধংদেহি ভারতের সামনে।

বাংলাদেশ এখন তিনটি বড় চ্যালেঞ্জের সামনে; ভারতের দিক থেকে, যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে এবং আওয়ামী লীগের দিক থেকে।

হিন্দু নির্যাতন নিয়ে বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়িয়েই যাচ্ছে ভারত। খাদ্য, জ্বালানির পাশাপাশি পোশাক শিল্পের কাঁচামালের জন্য ভারতের ওপর বাংলাদেশ অনেকটাই নির্ভরশীল। ভারত এগুলো অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাংলাদেশ নিয়ে ভাবছেন বলে মনে হচ্ছে না। আর যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া বাংলাদেশের নাজুক অর্থনীতির মতো নাজুক সরকার পড়ে যেতে পারে।

আর অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগও আন্দোলনে ফিরছে। আর তা দেশটিকে অস্থিতিশীল করে ইউনূস সরকারের জন্য নিরাপত্তা সঙ্কট তৈরি করতে পারে।

মূল্যায়ন

বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের বন্ধন আরও মজবুত হওয়া দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা আনবে না, বরং আঞ্চলিক উত্তেজনার পারদ চড়াবে এবং বাংলাদেশের ওপর ভারতের আরও চাপ সৃষ্টির ক্ষেত্র তৈরি করবে।

ওয়াশিংটনের নিজেদের দূরে রাখার মানে হলো বাংলাদেশের বিষয়ে নাক গলাতে ভারতকে অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া।

চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের বরফ গলার মানে হলো বাংলাদেশে বেইজিংয়ের নিরাপত্তা সহযোগিতা ধীরে ধীরে কমে যাওয়া। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সংঘাতের দিকে নেওয়ার চেয়ে উত্তেজনা কমাতেই এখন বেশি আগ্রহী চীন।

বাংলাদেশ বৃহত্তর অস্থিতিশীলতার মধ্যে রয়েছে এবং ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ ত্রিভূজ সামরিক ও গোয়েন্দা ভারসাম্য আরও তীব্র করে তুলেছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত