বারিধারা, জে-ব্লক, হাউজ নাম্বার আট। স্পেশাল অলিম্পিকস বাংলাদেশের বর্তমান ঠিকানা এটাই। ভবনের বাইরে নেই কোন সাইনবোর্ড। কোন তালায় অফিস তারও নেই নির্দেশনা। নতুন কেউ কার্যালয়ে যেতে চাইলে গলদঘর্ম অবস্থা হবে।
প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর হয়ে গেলেও কেন সাইনবোর্ডহীন ঠিকানা? স্পেশাল অলিম্পিকস বাংলাদেশের জাতীয় পরিচালক ফারুকুল ইসলামের হতাশা, ‘‘বারিধারায় আমরা আছি একটা ভাড়া ভবনে। আমাদের এক পরিচালক অর্ধেক ভাড়ায় কার্যালয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আবাসিক এলাকায় সাইনবোর্ড দিলে ভাড়া কয়েকগুণ বেড়ে যাবে বলেই এভাবে কাজ চালাচ্ছি।’’
স্থায়ী কার্যালয় না হওয়ার নেপথ্যে
১৯৯৪ সালের আগস্টে আশরাফ উদ দৌলা প্রতিষ্ঠা করেন স্পেশাল অলিম্পিকস বাংলাদেশ। প্রথম কার্যালয় ছিল তারই মতিঝিলের অফিসে। এভাবে এর-ওর অফিস বা বাড়িতে ছিল এর বসতি। ২০১৪ সালে নিজস্ব কার্যালয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন করে স্পেশাল অলিম্পিকস বাংলাদেশ। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে একটা চিঠি পাঠানো হয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে। সেটা আমলে নিয়ে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে দুটি কক্ষ কার্যালয় হিসাবে বরাদ্দ দেয় সংস্থাটিকে। সেটা স্টেডিয়ামের ১৮ ও ১৯ নম্বর কক্ষ, যা ঢাকা মহানগরী ফুটবল লীগ কমিটির কার্যালয়।
কক্ষ বরাদ্দ দিয়ে এনএসসি চিঠিও পাঠায় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে। কিন্তু বাফুফে কক্ষ দুটি হস্তান্তর করেনি। এর দায় বাফুফের এক শীর্ষ কর্তাকে দিলেন স্পেশাল অলিম্পিকস বাংলাদেশের জাতীয় পরিচালক ফারুকুল ইসলাম, ‘‘আমি চিঠিটা নিয়ে বাফুফের এক শীর্ষ কর্তার কাছে গেলাম (নাম প্রকাশ করতে চাননি)। তিনি চিঠি উল্টো জানালেন, ‘ফারুক ভাই এটা আমি আগেই পেয়েছি।’ বলার পর আমার সামনেই ছিঁড়ে ফেলেন চিঠিটা। পাত্তাই দিলেন না। পরে এনএসসিতে যাই। সেখানকার কর্তারা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী খেলোয়াড়দের নিয়ে মানববন্ধন করতে বললেন। আমরা যেহেতু সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে এনজিও ব্যুরোতে রেজিস্ট্রার্ড করা প্রতিষ্ঠান আর এনএসসির অ্যাফিলিয়েটেড নই, তাই এছাড়া নাকি উপায় নেই। আমরা আর নোংরামিতে জড়াতে চাইনি। ভাড়া ভবনে আছি এজন্য।’’
১৭ জেলায় শাখা
প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৬৪ জেলায় কার্যক্রম ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন স্পেশাল অলিম্পিকস বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। তবে লক্ষ্যটা পূরণ হয়নি। এতদিনে কেবল ১৭টি জেলায় নিজেদের শাখা বা সাব চ্যাপ্টার খুলতে পেরেছে তারা।
প্রতিষ্ঠার ৩০ বছরে কেবল ১৭টি সাব চ্যাপ্টার করা নিয়ে হতাশা লুকালেন না স্পেশাল অলিম্পিকস বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ডা. শামীম মতিন চৌধুরি, ‘‘বুদ্ধি প্রতিবন্ধী অন্তত ৩৪ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছাতে হলে ৬৪ জেলায় সাব চ্যাপ্টার করার বিকল্প নেই। বাস্তবতা হচ্ছে নানা প্রতিবন্ধকতায় কেবল ১৭ জেলায় সেটা করতে পেরেছি। তবে বিভিন্ন গেমসের আগে ট্যালেন্ট হান্টের সময় আমরা চেষ্টা করি ৬৪ জেলায় পৌঁছানোর।’’
পাশাপাশি অভিভাবকদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর কথাও বললেন তিনি,‘‘প্রতি সপ্তাহে ফিটনেস প্রোগ্রাম করি আমরা। আগে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে করা হত এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে করা হয়। বাচ্চাদের অভিভাবকরা আসেন। ওরা একটু দৌড়ায়, লাফায়, হাঁটে। তাতে শুধু ফিটনেস ঠিক হয় না, সোসালাইজেশনও হয়। বন্ধুত্ব হয়। একেকটা বাচ্চার সমস্যা একেকরকম। এই বাচ্চাদের অভিভাবকরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ালে সুফল পাওয়া যাবে নিশ্চিতভাবে।’’
প্রতিবন্ধী আর বুদ্ধি প্রতিবন্ধী এক নয়
সব প্রতিবন্ধীই বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নন। এটা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি আছে যথেষ্ট। এজন্যই স্পেশাল অলম্পিকস ও প্যারা অলিম্পিক দুটো আলাদা সংগঠন। কেউ দেখতে পারছেন না, অন্ধ। চলতে পারছেন না। হাত নেই, এক পা নেই- তবে বুদ্ধি স্বাভাবিক মানুষের মতো। তারা স্পেশাল অলিম্পিকসে অংশ নিতে পারবেন না। স্পেশাল অলম্পিকসে অংশ নিবেন শুধু বুদ্ধি প্রতিবন্ধীরা।
ওয়েক্সলার ইন্টেলিজেন্স স্কেল অনুযায়ী আইকিউ টেস্টে যাদের নম্বর ৭০ বা তার কম, তারাই বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। তাদের হাত পা থাকতে পারে, না-ও পারে। স্পেশাল অলিম্পিকস বাংলাদেশের পরিচালক ও ঢাকা মেডিক্যালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান জানালেন, ‘‘অনেক অভিভাবক হাত-পা না থাকা বাচ্চাদের নিয়ে আসেন আমাদের কাছে। অথচ তাদের বুদ্ধি স্বাভাবিক। তাই আমরা নিতে পারি না, এ নিয়ে মনোমালিন্যও হয় অভিভাবকদের সঙ্গে।’’
বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বেশি উত্তরবঙ্গে
বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের লুকিয়ে রাখার প্রবণতা আছে বাংলাদেশের সমাজে। আছে ধর্মীয় গোঁড়ামি আর নানা কুসংস্কার। শহরের মানুষ তুলনামূলক বেশি শিক্ষিত ও সচেতন হওয়ায় রাজধানী বা বিভাগীয় শহর থেকে বেশি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী পাওয়ার আশা ছিল স্পেশাল অলিম্পিকস বাংলাদেশের কর্তাদের। কিন্তু হয়েছে উল্টো। তাঁরা বেশি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী পেয়েছেন গ্রামাঞ্চলে, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে।
স্পেশাল অলিম্পিকস বাংলাদেশের পরিচালক ও ঢাকা মেডিক্যালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান এর ব্যাখ্যায় জানালেন, ‘‘শহর থেকে বেশিজন পাওয়ার প্রত্যাশা থাকলেও উত্তরবঙ্গেই সর্বোচ্চ বুদ্ধি প্রতিবন্ধী পেয়েছি আমরা। এই এলাকায় অভাব, মঙ্গা কিংবা আয়োডিনের কমতির জন্য এটা হতে পারে। এ নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত। ধর্মীয় গোঁড়ামি বড় একটা সমস্যা। তবে তুলনায় হিন্দুরা অনেক সচেতন। আমাদের ২০ শতাংশ খেলোয়াড় হিন্দু। আসলে সচেতনতা বাড়িয়ে সমাজ পরিবর্তন করতে সময় লাগবে অনেক।’’
ছয় কোটি টাকায় বদলে যাওয়া
দুই থেকে আট বছর বয়সী শিশুদের বলা হয় ইয়াং অ্যাথলেট। স্পেশাল অলিম্পিকস ইন্টারন্যাশনাল (এসওআই) তিন বছর মেয়াদি বিশেষ প্রোগ্রাম নিয়েছিল বাংলাদেশি এই তরুণ অ্যাথলেটদের নিয়ে। ‘ইয়াং অ্যাথলেট প্রজেক্ট’ নামে ২০১৬, ১০১৭ ও ২০১৮ সালে একটা প্রকল্পের জন্য তারা অনুদান দেয় ৬ কোটি টাকা।
সেই তহবিল থেকে ১০৬জন শিক্ষক নিয়োগ দেয় স্পেশাল অলিম্পিকস বাংলাদেশ। তাঁরা বিভিন্ন জেলার শিক্ষক ও ট্রেনার। তাঁদের বেতন দেওয়া হত মাসে ৫ হাজার টাকা। সেই শিক্ষকরা বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের। একজন শিক্ষক প্রতি বছর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন অন্তত ১০০ ছাত্র-ছাত্রীকে। তাতে তিন বছরে প্রশিক্ষণ পায় ৩০ হাজারের বেশি জন।
সব ছাত্র-ছাত্রীর নাম রেজিস্ট্রেশন করা আছে, ছবিসহ সংরক্ষিতও আছে ডাটাবেজে। সবমিলিয়ে ৩০ বছরে স্পেশাল অলিম্পিকস বাংলাদেশ প্রশিক্ষণ দিয়েছে ৭০ হাজারের মত বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীকে, এর অর্ধেকের কিছু কম সেই তিন বছরে। এজন্য বিশেষ স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ দুই মাস আগে পেয়েছে ‘শোকেস’ অ্যাওয়ার্ড।
সিঙ্গাপুরে এ অ্যাওয়ার্ড নিতে গিয়েছিলেন জাতীয় পরিচালক ফারুকুল ইসলাম ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মশিউর রহমান। সেখানেই লক্ষ্য দেওয়া হয় দুই লাখ খেলোয়াড় নিবন্ধন করার। কিন্তু বাংলাদেশ জানায় অপারগতা। এর কারণ হিসাবে মশিউর রহমান জানালেন, ‘‘আমাদের টাকার অভাব আছে। ভারত নিজেদের সরকারের কাছ থেকে বছরে ১০০ কোটি রুপির বেশি বাজেট পায়। ইন্দোনেশিয়াও বড় অঙ্কের বাজেট পায়। কিন্তু আমাদের জন্য এক টাকাও সরকারি বাজেট নেই। এসওআই আগের মত ফান্ডিং করলে ২ লাখ অ্যাথলেট নিবন্ধন সম্ভব। দেখা যাক ওরা আমাদের অনুদান দেয় কিনা।’’
গাজীপুরে স্পোর্টস কমপ্লেক্সের স্বপ্ন
নিজেদের স্পোর্টস কমপ্লেক্সের জন্য ১০ বছর আগে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছিল স্পেশাল অলিম্পিকস বাংলাদেশ। নানা তদবিরের পর সেই আবেদন আলোর মুখ দেখেছে মাস খানেক আগে। তবে শুধু বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নয়, সব প্রতিবন্ধীদের নিয়েই গত নভেম্বরে সাভারে স্পোর্টস কমপ্লেক্স করার অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন।
স্পেশাল অলিম্পিকস বাংলাদেশের কর্তারা তাতে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন। কারণ তারা শুধু নিজেদের জন্য চেয়েছিলেন আলাদা একটা স্পোর্টস কমপ্লেক্স। সেই স্বপ্নও পূরণ হতে পারে তাদের। গাজীপুরে আলাদাভাবেই হতে পারে প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা। এ নিয়ে স্পেশাল অলিম্পিকস বাংলাদেশের জাতীয় পরিচালক ফারুকুল ইসলাম জানালেন, ‘‘প্যারাগন গ্রুপের কর্ণধার মশিউর রহমান আমাদের কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান। তিনি গাজীপুরে আমাদের ২০ বিঘা জমি কিনে দিবেন। আশা করছি এরপর দ্রুতই আমরা স্পোর্টস কমপ্লেক্সের কাজ শুরু করতে পারব।’’
বিশ্বসংস্থায় থাকলেও স্পেশাল অলিম্পিকসে নেই সায়মা ওয়াজেদ
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা ড. সায়মা ওয়াজেদ কিছুদিন আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অ্যাডভাইসরি প্যানেলের বিশেষজ্ঞও তিনি। বাংলাদেশের অটিজম-বিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি আর সূচনা ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন তিনি।
গুরুত্বপূর্ণ এত পদে থাকলেও বিস্ময়করভাবে স্পেশাল অলিম্পিকসের সঙ্গে সরাসরি কাজ করেননি সায়মা ওয়াজেদ। এ নিয়ে আক্ষেপ আছে সংস্থাটির কর্তাদের। পাশাপাশি আছে সায়মা ওয়াজেদকে নিজেদের কার্যক্রমে যুক্ত করার চেষ্টাও। জাতীয় পরিচালক ফারুকুল ইসলাম জানালেন, ‘‘বুদ্ধি প্রতিবন্ধীর অনেকগুলো শাখা আছে, অটিজম এর একটি। সায়মা ওয়াজেদের আসল কাজ অটিজম নিয়ে। আমরা নিজেদের দুটি অনুষ্ঠানে তাকে প্রধান অতিথি হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু সময় দেননি তিনি। সায়মা ওয়াজেদ সময় দিলে আন্তর্জাতিকভাবে লাভবান হতে পারতাম। আমরা চেষ্টা করছি তাকে সম্পৃক্ত করার।’’
তাহলে নতুন দিগন্তে পৌঁছানোটা আরও সহজ হতে পারে স্পেশাল অলিম্পিকস বাংলাদেশের।