Beta
শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫

বাংলাদেশ রাষ্ট্রই এখনও গঠিত হয়নি

ফরহাদ মজহার

ফরহাদ মজহার, প্রথাগত কোনও রাজনৈতিক দলে নেই; কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক সব সময়ই। চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ থেকে যে আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলো, তাতে এই চিন্তাবিদের নাম আবার এল সামনে। আন্দোলনে নেতৃত্বদাতা কয়েকজনকে তার চিন্তায় প্রভাবিত বলে মনে করা হয়। এই আন্দোলনের বিজয় বাংলাদেশকে একটি যুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বলে মনে করেন তিনি। এখন জনমানসে যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তা কীভাবে পূরণ হতে পারে, সকাল সন্ধ্যাকে দেওয়া দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকারে সবিস্তারে বলেছেন তিনি। ফরহাদ মজহারের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তন্ময় ইমরান, অনিক রায় ও আতিউর রহমান

বাংলাদেশ রাষ্ট্রই এখনও গঠিত হয়নি

ফরহাদ মজহার

ফরহাদ মজহার, প্রথাগত কোনও রাজনৈতিক দলে নেই; কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক সব সময়ই। চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ থেকে যে আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলো, তাতে এই চিন্তাবিদের নাম আবার এল সামনে। আন্দোলনে নেতৃত্বদাতা কয়েকজনকে তার চিন্তায় প্রভাবিত বলে মনে করা হয়। এই আন্দোলনের বিজয় বাংলাদেশকে একটি যুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বলে মনে করেন তিনি। এখন জনমানসে যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তা কীভাবে পূরণ হতে পারে, সকাল সন্ধ্যাকে দেওয়া দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকারে সবিস্তারে বলেছেন তিনি। ফরহাদ মজহারের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তন্ময় ইমরান, অনিক রায় ও আতিউর রহমান

সকাল সন্ধ্যা: দেশ তো একটি বিমূর্ত ব্যাপার। একেক মানুষের কাছে দেশের ছবি একেক রকম। আপনি যে বাংলাদেশ দেখেন, তার মূর্ত রূপ কী?

ফরহাদ মজহার: আমরা এখনও পলিটিক্যালি বা রাজনৈতিকভাবে ভাবতে শিখিনি। রাজনৈতিকভাবে আলোচনা করলে আমরা বুঝব দেশ আমাদের ইমাজিনেশান বা কল্পনার সীমা ও সামর্থ্যের সঙ্গে জড়িত। ‘দেশ’ সংক্রান্ত ধারণা গড়ে ওঠার সঙ্গে একটি জনগোষ্ঠীর কল্পনা করার আকাঙক্ষা, শক্তি ও শক্তির মাত্রা জড়িত। রাষ্ট্রচিন্তা দানা বাঁধবার আগে দেশের কল্পনা আমাদের মধ্যে দানা বাঁধে, যা রাজনৈতিক রূপ বা রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা হিসাবে হাজির হয়। এজন্যই ‘দেশ’ জিনিসটা ভূগোলকেন্দ্রিক। আপনার প্রশ্নটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ জনগণের কাছে দেশ এবং রাষ্ট্রের ভেতরের পার্থক্য পরিষ্কার না। কাউকে যদি আপনি প্রশ্ন করেন, ১৯৭১ সালে আমরা কিসের জন্য লড়াই করেছিলাম? সে বলবে দেশ রক্ষা করার জন্য করেছিলাম। এটা সত্যি। তার মানে দেশ একাত্তরে আমাদের কল্পনায় ও রাজনীতিতে প্রধানত ভূগোল? এটা সত্য। কিন্তু তাহলে বাহাত্তরে আমরা রাষ্ট্র গঠন করতে পারি নাই কেন? কারণ রাষ্ট্র গঠন করা আর দেশ স্বাধীন করা দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন কাজ।

ফলে, দেশ একটি প্রয়োজনীয় ইমাজিনেশন বা কল্পনা। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হয়ে ওঠার জন্য দেশ-কল্পনাটা দরকার, সেটা খুবই জরুরি। আমার নদী, আকাশ কিংবা ডি এল রায়, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও আরও অনেককে নিয়ে দেশ ধারণাটা গড়ে উঠেছে। দেশচিন্তার সাথে জাতিবাদটাও জরুরি। ফলে জাতিবাদের যুগে দেশকে কেন্দ্র করে আমাদের মধ্যে জাতিবাদও গড়ে উঠেছে।

কিন্তু রাষ্ট্র ধারণা সম্পূর্ণ আলাদা। সেটা স্রেফ দেশ স্বাধীন করা, পতাকা তৈরি কিংবা জাতিসংঘে একটি আসন পাওয়া না। বাংলাদেশে রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা প্রবলভাবে কোনোদিন ছিল না। ১৯৭২ সালে যখন আমরা সংবিধান রচনা করি, তখন বাইরে থেকে নেওয়া একটি উকিলি সংবিধান আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাইরে থেকে যারা চাপিয়ে দিয়েছে, তারা কিন্তু পাকিস্তানের জন্য নির্বাচিত ছিলেন। নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন জনগণের অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়নি। পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের জন্য যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন, তারাই স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের সংবিধান লিখেছে। এটা তো হতে পারে না। স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দায়টা বোঝা উচিৎ ছিল। সেটা যারা বুঝেছিলেন,  যেমন ভাসানী, তারা প্রতিবাদ করেছিলেন। (অথচ) ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে তারা একটি ‘সংবিধান’ লিখে ফেললেন!

৭২ এর সংবিধান যেটা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, বাংলাদেশের জনগণ ওইটা প্রণয়ন করেনি। এই সংবিধানকে অবশ্যই ফেলে দিতে হবে। এটা নেগোশিয়েবল না।

এখনও দেখেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি নতুন গণ-অভ্যুত্থানের সরকার গঠন করেছেন। উনিও কিন্তু শ্রদ্ধা দিতে গেছেন ড. কামাল হোসেনকে। এটা কিন্তু স্রেফ সৌজন্য সাক্ষাৎকার না, এটা আমাদের রাষ্ট্র নিয়ে চিন্তার প্রতিফলন। উনি ভাবছেন যে রাষ্ট্র গঠন করতে আইনজ্ঞ লাগবে। আইনজ্ঞের কিছুই করার নেই রাষ্ট্র কিংবা সংবিধান নিয়ে। ফলে, কামাল হোসেনদের যখন রাষ্ট্র গঠন সম্পর্কে রাজনৈতিক অস্পষ্টতা থাকে, তখন তারা নিজেরা সংবিধান লিখে দাবি করেন, এটাই বুঝি জনগণের সংবিধান।

আমাদের এজন্য মনে রাখতে হবে যে ’৭১ সালে আমরা স্বাধীনতার জন্য লড়েছি এবং স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু আমরা রাষ্ট্র গঠন করতে পারি নাই। ফলে ’৭২ এর সংবিধান যেটা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, বাংলাদেশের জনগণ সেটা প্রণয়ন করেনি। এই সংবিধানকে অবশ্যই ফেলে দিতে হবে। এটা নেগোশিয়েবল না। পরে এটাতেও মেলা কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। আর এসব কাটাছেঁড়ার সংস্কারের ইতিহাস থাকার পরও যারা এখনও সংবিধান সংস্কারের কথা বলেন, তাদের কথাও ঠিক না। কারণ যে কোনও জনগোষ্ঠীর নিজেদের গঠন করার অধিকার রয়েছে। জনগণের অধিকার রয়েছে, তারা যে ধরনের রাষ্ট্র চায়, তা কায়েম করবার। তাদের অভিপ্রায় মূর্ত করে তোলাই গণতন্ত্র। জনগণ কী ধরনের রাষ্ট্র চায়, সেটা জনগণকে বলতে দিতে হবে। আপনি একজন উকিলের সাথে বসে যা বানালেন, তাকে রাষ্ট্র বলে না।

তাহলে এখন কী করতে হবে? একটি জাতীয় গঠনতান্ত্রিক কাউন্সিল করা দরকার। সমাজের বিভিন্ন স্তরে গ্রাম, উপজেলার স্তরে জনগণ কী ধরনের গঠনতন্ত্র চায়, কী ধরনের রাষ্ট্রে তারা বাস করতে চায়, সেটা তাদের বলতে দিতে হবে। আপনি যেমন মিডিয়া, তেমনি আপনাদেরও উচিৎ আমার মতসহ সবার কথা সামনে নিয়ে আসা। যারা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ আছেন, তাদের রাষ্ট্র নিয়ে চিন্তা প্রকাশ করতে হবে। এরকম সকল চিন্তা মিলিয়েই সমাজের সকল স্তরের মানুষদের অভিপ্রায় হাজির করা এবং আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়েই নতুন গঠনতন্ত্রের রূপরেখার খসড়া তৈরি করতে হবে। আমাদের সংবিধানেই তো আছে, সংবিধান ‘জনগণের পরম অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি’। তাহলে সেই পরম অভিপ্রায়টা কী, সেটা সকলে মিলেই স্থির করতে হবে। আপনি আমার কাছে এই ভোরবেলা ছুটে এসেছেন। এটাও কিন্তু রাষ্ট্র গঠনের জন্য কাজ। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু আমাদের লোকের ধারণা হলো, শুধু উকিল এসে একটি সংবিধান ঠিক করে দিবে— ব্যস দেশ হয়ে গেল!

সকাল সন্ধ্যা: জুলাইয়ে যে আন্দোলন হলো এবং যার ফলাফল সরকার পতন। আপনি এই আন্দোলন নিয়ে ঠিক কবে থেকে গভীর মনোযোগ দেওয়া শুরু করেছেন?

ফরহাদ মজহার: এই যে একটু আগে আমি বললাম, আমরা রাষ্ট্র গঠন করতে পারি নাই। আমার মধ্যে এই অভাব দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। কিন্তু যে রাষ্ট্র গড়তে পারলাম না, সেই রাষ্ট্র আপনি কী করে গঠন করবেন? যেমন, আমার প্রথম যেই বইটা প্রকাশিত হয়েছিল, সেটা হলো ‘সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থান এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উত্থান প্রসঙ্গে ’ (১৯৮৫)। এটা খুবই ছোট একটি বই বা পুস্তিকা। কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওটা মূলত যখন এরশাদবিরোধী আন্দোলন হচ্ছে, তখন আমি লিখেছিলাম, আমার কমরেডরা প্রচার করেছিলেন। বলেছিলাম, শুধু এরশাদকে সরিয়ে যদি গণবিরোধী ও গণতন্ত্রবিরোধী রাষ্ট্র রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বানিয়ে একটি ইলেকশন করেন, সেটা বাংলাদেশের সমস্যা দূর করবে না। আমাদের রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে হবে। তখন আমি বামপন্থীদের উদ্দেশে বলেছিলাম, তারা আসলে জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। কারণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের কর্তব্যটা বামপন্থীদের কাছে পরিষ্কার থাকা দরকার ছিল। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আমাদের যে প্রধান প্রতিপাদ্য, সেটা ছিল আমরা রাষ্ট্র গঠন করতে পারি নাই। একটু ভাবুন,  এরশাদের মতো একটি লোক যে যুদ্ধের সময় পাকিস্তানে ছিল, সে বাংলাদেশে এসে অতি দ্রুত সেনাবাহিনীর প্রধান হয়েছে। এটা তো গ্রহণ করা যায় না। তিনি একটি সেনাঅভ্যুত্থান করেছেন। এই সেনাঅভ্যুত্থান কীভাবে একটি দেশে টিকে গেল? টিকে গেল এই কারণে যে আমাদের মধ্যে রাষ্ট্র ধারণাটা নেই। অনুপস্থিত। যদি থাকত তাহলে আমাদের ভুল পদক্ষেপের কারণে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক ও অফিসারদের ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হোত না। আমরা আমাদের মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকদের একদিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছি, অন্যদিকে পাকিস্তানি এরশাদকে প্রেসিডেন্ট বানিয়েছি। পরিবর্তে কী হলো? এরশাদকে বদলাবার জন্য একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বানানো হলো। ফলে রাষ্ট্র যা আছে, তা থাকলোই। বাহাত্তরের পর থেকে আমাদের সংবিধানের ইতিহাস চরম কলঙ্কজনক ইতিহাস, এর হাত থেকে অবশ্যই আমাদের মুক্ত হতে হবে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তি যেমন আছে, সেকুলার ফ্যাসিস্ট শক্তি, একই সাথে ইসলামী ফ্যাসিস্ট শক্তিও আছে।

এর পরে আমি যে বই লিখি, তা হলো ‘সংবিধান ও গণতন্ত্র’। রাষ্ট্র গঠন সংক্রান্ত চিন্তা তখন আমার মাথায় শক্তভাবে আসে। তখন থেকেই লিখছি। বিভিন্ন সময় ধরেই আমি বলছি, আমাদের একটি রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। এসব নিয়ে সম্প্রতি আমার একটি নতুন বই বের হয়। এটা একটা অদ্ভুত ইতিহাসের মিল। ২০২৩ সালের ৫ আগস্ট আমার বইটি বের হয়, নাম: ‘গণ-অভ্যুত্থান এবং গঠন’। এবং মজা হলো ২০২৪ সালের এই ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানটি ঠিকই ঘটে গেল। তরুণরা এই ঘটনা ঘটাতে পেরেছে। বোঝা যাচ্ছে, তারা এই চিন্তাটিকে ধারণ করে। তাদের ভাষায় তারা বলেছে ‘নতুন বাংলাদেশ গঠন’ করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে ‘গঠন’ কথাটার গভীরতা ও ব্যাপ্তিও সমানভাবে আমাদের রাজনৈতিক সাহিত্যে হাজির হয়েছে। দেখবেন, তরুণদের চিন্তার মধ্যে এসব গোড়ার কাজের দিকগুলো এসে গিয়েছে। শুধু তারা না, যেই বামরা আমাকে অধিকাংশ সময় ভুল বুঝেছে, তাদের তরুণদেরও একটি অংশ মনে করে গণ-অভ্যুত্থান ও গঠন নিয়ে আমার কথা সঠিক। আমাদের নতুন করে বাংলাদেশ গঠন করতে হবে, যেখানে সকলকে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে, শুধু ফ্যাসিস্টরা ছাড়া। নানা রকম ফ্যাসিস্ট আছে, যারা আমাদের উপর তাদের মত ও পথ আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়। যেমন বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তি, সেকুলার ফ্যাসিস্ট শক্তি, একই সাথে ইসলামী ফ্যাসিস্ট শক্তিও আছে। এই ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলো বারবারই বিভিন্ন দিক থেকে মানুষের রাষ্ট্র গঠনের অধিকার অস্বীকার করেছে, গণতন্ত্র কায়েমে বাধা দিয়েছে। কিন্তু এবার আমাদের সবাইকে এই বাধা দেবার রাস্তা বন্ধ করতে হবে। আমাদের সকলকে রাষ্ট্র গঠনের কাজে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এই কাজটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ড. ইউনূসকে সহায়তা করতে হবে।

সকাল সন্ধ্যা: বাংলাদেশে বড় যে রাজনৈতিক দলগুলো আছে, তাদের একটি জামায়াতে ইসলামী— যাদের বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগও এখন ‘গণহত্যা’র অভিযোগে বিদ্ধ। জাতীয় পার্টি আগেই স্বৈরাচার হিসাবে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা থেকে নেমেছে এবং বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা ক্যান্টনমেন্টের দল। তো বিপুল যে জনগোষ্ঠী এদের সমর্থক এবং এখন তো আর দেশে সাংস্কৃতিক বিপ্লব হয়নি— ফলে যে অরাজকতা দেখা দিচ্ছে, এ পরিস্থিতির মোকাবেলা কীভাবে সম্ভব?

ফরহাদ মজহার: প্রথমে আমাদের যেটা বুঝতে হবে, আমরা স্বাধীনতার সময় থেকেই যেহেতু রাষ্ট্র গঠন করতে পারি নাই এবং আমাদের মধ্যে রাষ্ট্র চিন্তাও দুর্বল, কিংবা অনুপস্থিত, ফলে বাস্তবে আমাদের কোনও রাজনৈতিক দলও নাই। আসলে রাজনীতি ও রাষ্ট্র সম্বন্ধে চিন্তার অভাবের কারণে রাজনৈতিক দল থাকবে, এটাও আশা করা যায় না। কারণ আমরা কোনও কার্যকর রাজনৈতিক পরিসর গড়ে তুলতে পারিনি। দল নামে যেগুলো আছে, সেগুলো সবই ক্লাব। ক্লাবগুলোর লক্ষ্য কী? ক্লাবগুলোর কাছে রাষ্ট্র একটি ইনভেস্টিং বা বিনিয়োগের সেক্টর। আপনি এখানে বিনিয়োগ করবেন, এখান থেকে প্রফিট আদায় করবেন। বড় বড় প্রজেক্ট নেবেন, সেখান থেকে টাকা সরাবেন, লুট করবেন, তা দিয়ে পার্টি চালাবেন। খেয়াল করুন, যারা পার্টির কর্মী, যারা এসব দল করেন, তারা কেউ কোনওদিন এমপি হতে পারবে না। সেটা রেয়ার, অকস্মাৎ। এমপি তারাই হতে পারবে, যার দুই কোটি টাকা আছে। যে পার্টিকে চাঁদা দিতে পারবে। ফলে আপনারা যাদের পার্টি বলছেন, তারা তো এখানে গড়ে উঠতে পারেনি। আসলে আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণেই এখানে কখনও রাজনৈতিক পার্টি গড়ে উঠতে পারেনি।

একটা স্বাধীন দেশে ‘জামায়াতে ইসলামী’ নামটা কীভাবে টিকে থাকল? কারণ দিল্লি চেয়েছে, জামায়াত যদি থাকে, তাহলে আওয়ামী লীগ থাকবে।

আপনি রাজনৈতিক দল হিসেবে একমাত্র জামায়াতকে চিন্তা করতে পারেন। কারণ জামায়াত আদর্শভিত্তিক দল। কিন্তু জামায়াত কি টিকতে পারছে? বা পারা কি উচিৎ? পারছে না কিন্তু। জামায়াতের কি সংগঠন আছে? হ্যাঁ, আছে। ওদের কি মতাদর্শ আছে? হ্যাঁ, আছে। কিন্তু জামায়াতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, একটা স্বাধীন দেশের আবির্ভাবের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী ভূমিকা রেখেছে। এখন ‘জামায়াতে ইসলামী’ নামটা নিয়ে ভাবুন, যে নামের অধীনে এই দেশের জনগণের বিরুদ্ধে জামায়াত যুদ্ধ করেছে। তাহলে তারা কীভাবে লক্ষ শহীদের বিনিময়ে জন্ম লাভ করা এই দেশে টিকে থাকে! জামায়াত নামটা কিভাবে টিকে থাকল? এই নাম তো জামায়াত একলা টিকিয়ে রাখে নাই। আপনারা সকলেই এই নামটা টিকিয়ে রেখেছেন। এই নামটি টিকিয়ে রাখার জন্য দিল্লির খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। কারণ দিল্লি চেয়েছে, জামায়াত যদি থাকে, তাহলে আওয়ামী লীগ থাকবে। জামায়াত থাকা মানে আওয়ামী লীগ থাকা। জামায়াত নাম এবং বিশেষ ইসলামি ধারার রাজনীতিকে আপনি আওয়ামী লীগ থেকে আলাদা করতে পারবেন না। ইসলামি জাতিবাদ যদি থাকে, তাহলে বাঙালি জাতিবাদও থাকবে। রাজনীতির এই অতি গোড়ার কথা ভুলে গেলে চলবে না। তাহলে বোঝা যায়, জামায়াতে ইসলামী নামের ইসলামি রাজনীতি আসলে দিল্লি ও আওয়ামী লীগই টিকিয়ে রেখেছে। কই আমরা কি কখনও এর বিরুদ্ধে কথা বলেছি?

কলোনিয়াল আমলেই ইসলামি জাতিবাদী রাজনীতি বা মুসলিম জাতিবাদী রাজনীতি গড়ে উঠেছে। মুসলিম জাতিবাদের অবশ্যই এন্টি কলোনিয়াল এবং সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। ইসলামি রাজনীতি বিকাশের দিক থেকে মওদুদীর (জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদী) ভূমিকা আপনি উপেক্ষা করতে পারবেন না। এমনকি বিভিন্ন সময়ে জামায়াতের ইতিবাচক রাজনীতির ভূমিকাও অস্বীকার করতে পারবেন না। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে ‘জামায়াতে ইসলামী’ নাম নিয়ে রাজনীতি করতে তো আমরা তাদের দিয়েছি। বাঙালি জাতিবাদীরা এর পূর্ণ সুবিধা নিয়েছে। তারা জামায়াত বিরোধিতা করার নামে ইসলামের বিরোধিতা করেছে। বাঙালি জাতিবাদ ও মুসলিম জাতিবাদ পরস্পরের যমজ ভাই। একটাকে আপনি আরেকটি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবেন না। রাজনৈতিক মতাদর্শের পরিসরে এই গভীর সঙ্কট রয়ে গেছে। তাহলে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে আমাদের গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ইসলামের ইতিবাচক ভূমিকা কী হতে পারে, তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। আমি ভাববার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সেই ভাবনা-চিন্তা করতে হবে বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতির জমিনে দাঁড়িয়ে। কারণ আমরা আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে বাস করি। কিন্তু এই ভাবে রাজনৈতিক সঙ্কট চিহ্নিত করা ও মীমাংসার কোনও ঐতিহ্য আমাদের দেশে আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। তাই আমরা লুটপাটের ক্লাব পেয়েছি, রাজনৈতিক দল পাইনি। ইসলাম অস্বীকার করে যেমন বাংলাদেশ ভাবা যায় না, তেমনি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিলোপ করে দিয়ে আরবি সংস্কৃতি দিয়ে বাংলাদেশ গঠন করা যাবে না। এই কাণ্ডজ্ঞান আমরা যত দ্রুত অর্জন করব, ততই তা আমাদের জন্য মঙ্গল।

জামায়াত নিজে একটি আদর্শভিত্তিক রাজনীতি করতে চেয়েছে। ঠিক আছে। তো যখন জামায়াত নির্বাচনী বিধি মেনে নির্বাচন করল, তখন তাদের আদর্শ কোথায় ছিল? তখন কী তারা বলেছে, তারা ইসলাম কায়েম করতে চায়, গণতন্ত্র নয়, পশ্চিমা গণতন্ত্র নয়। তাহলে বিধি মানা হত না। ফলে, জামায়াত কি একটি পিওর মতাদর্শিক দল? আমাকে প্রশ্ন করেন, তাহলে এর উত্তরে আমি বলব, আমি তা মনে করি না।

জামায়াতের লোকজন সৎ যদি ধরেও নিই, তারা তাদের মোরাল নীতি মেনে চলে বলে দাবিও করতে পারে, আমি যদি সেটা মেনেও নিই, কিন্তু এই মোরাল নীতি আর রাজনীতি এক না। নীতি-নৈতিকতা আর রাষ্ট্র পরিচালনা এক না। সবচেয়ে সৎ লোকটাকেও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিলেও শুধু নীতি-নৈতিকতা দিয়ে রাষ্ট্র শাসন করা যায় না। রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত। সেখানে ধর্ম যেমন আছে, সমান মাত্রায় এবং সমানভাবে- হয়তো অনেক সময় অনেক বেশি— ভাষা এবং সংস্কৃতিও আছে। কোনও রাজনৈতিক দলকে তো রাষ্ট্র গঠন নিয়ে ভাবতে দেখিনি, ক্ষমতার লোভ দেখেছি।

এখন দেখেন, বিএনপির কথা যদি বলি। তাদের মধ্যে রাষ্ট্রচিন্তাটা আছে। কীভাবে আছে, তাও বলি। জিয়াউর রহমান যখন এলেন, ৭ই নভেম্বরে (১৯৭৫ সালের)। তিনি এসেছেন কীভাবে? জনতা এবং সৈনিকের মৈত্রীর মাধ্যমে। পিপল এবং সোলজারের মৈত্রী বা সৈনিক জনতার মৈত্রীর তিনি ফল। তাই কিন্তু তিনি টিকে গেলেন। জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে মানুষ কিন্তু রাষ্ট্রচিন্তার ইচ্ছাটি আবার প্রকাশ করেছিল। তার পেছনে গিয়ে মানুষ সমবেত হয়েছিল নানান কারণে। এখন এই কথা বললে হয়ত আমার বিএনপি বন্ধুরা রাগ হবে— আপনি যদি বিএনপির কোনও নেতাকে প্রশ্ন করেন যে জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা কী ছিল— তারা কি বলতে পারবে? বিএনপির কোনও রাজনৈতিক কর্মীকে জিজ্ঞেস করলে কি তারা ১৯ দফার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে পারবে? যদি প্রশ্ন করেন, জিয়া খাল কেন কাটলেন? খাল কেটে উনি কী করতে চেয়েছিলেন? কেউ বলতে পারবে? বলতে পারবে না। জিয়াউর রহমান ইসলামিস্ট দল এবং সেকুলার দল নিয়ে একটি দল করতে চেয়েছে, এমনকি শেখ হাসিনাকেও বাংলাদেশে ফেরত এনেছেন। তার আসলে পলিটিক্যাল ভিশনটা কী ছিল? বলতে পারবে বিএনপির লোকজন? বলতে পারবে না। যদি এসব না বলতে পারে তাহলে তো বিএনপি কোনও রাজনৈতিক দল না। জিয়াউর রহমান একটি হিস্টোরিকাল পারপাস সার্ভ করতে এসেছিলেন। তাই মানুষ তার পেছনে দাঁড়িয়েছিল। আমি জিয়াউর রহমানের ভক্ত। এর কারণ আমরা যেই রাষ্ট্র গঠন করতে চাই, তাতে জনতা আর সৈনিকের মৈত্রী খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

খেয়াল করে দেখবেন, এবারও যখন আমাদের সৈনিকেরা গুলি করবার আদেশ মানতে অস্বীকার করেছে, তখনই কিন্তু বিজয় এসেছে। কেউ কিন্তু একবারও সৈনিকের কথা বলছে না। ছাত্র-জনতা বলছে। ছাত্র-জনতা এই বিপ্লব করে নাই। এখানে সৈনিকদের অবদান রয়েছে। প্রথমে কিছু জায়গায় গুলি হয়েছে, কিন্তু পরে যখন একসাথে সৈনিকরা মিটিংয়ে বসেছে, তখন কিন্তু বলেছে আমরা জনগণের দিকে আর গুলি চালাব না। কোরান থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে— এটা ইসলামবিরোধী। এই যে সৈনিকের ভূমিকা, তা তো কেউ মুছে ফেলতে পারবে না। সৈনিক তো নাগরিক। নাগরিকতার বাইরে তো তিনি কেউ না। সৈনিকের একটি মর্যাদা আছে। তা আপনি ক্ষুণ্ণ করেছেন। কারণ আপনি তাকে র‍্যাবে এনেছেন। এর মাধ্যমে সৈনিকের হাতে নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে, গুম করা হয়েছে। আপনি আপনার পার্সোনাল স্বার্থে সৈনিককে ব্যবহার করেছেন। এত বড় অপমান সৈনিকতার আর কেউ করতে পারেনি। আজকে ড. ইউনুসের প্রথম দরকার ছিল, আয়নাঘর কোথায় তা দেখতে যাওয়া, যেখানে মানুষ আটকে ছিল। তিনি সৈনিকদের বলতে পারেন যে এটা তোমাদের সম্মানের জন্য হানিকর। কিন্তু আমরা কী দেখছি? যারা আয়নাঘরের সাথে যুক্ত, তারা কিন্তু এখনও আছে সরকারের ভেতরে।

কেউ কিন্তু এবারও সৈনিকের কথা বলছে না। ছাত্র-জনতা বলছে। ছাত্র-জনতা এই বিপ্লব করে নাই। এখানে সৈনিকদের অবদান রয়েছে।

তাহলে দেখুন রাষ্ট্র গঠনের চিন্তাটি নীতি-নৈতিকতা, মানবাধিকারের সাথে যুক্ত। আপনি যদি একটি নতুন রাষ্ট্র গঠন করতে চান, তার তো একটি হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন লাগবে। বলতে হবে রাষ্ট্র যে কাউকে দমন করবে না, ব্যক্তিকে গুম করতে পারবে না, অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করতে পারবে না, বিচারবহির্ভূত হত্যা করতে পারবে না। এটা তো বেসিক অধিকারের ব্যাপার— ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখা। আজকে দেখেন কতদিন হলো, কিন্তু এ ধরনের কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আমরা তো শুনি নাই যে র‍্যাব বিলুপ্ত করা হয়েছে। এর ফলে বোঝা যাচ্ছে, আমরা যেমন রাষ্ট্র কী বুঝি না; তেমনি এমন কিছু শক্তি রয়েছে, যারা আমাদের রাষ্ট্র গঠন করতে দিতে চায় না। তারা আমাদের প্রভু, এরা সরকারে আছে। ড. ইউনুস যতই সৎ হন না কেন, তার সরকারেই তারা আছে। আশেপাশেই আছে, দূরে কেউ নাই। তিনি কার অধীন? তিনি চুপ্পুর (রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন) অধীন। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার প্রেসিডেন্ট। তিনি (ড. ইউনূস) চুপ্পুর অধীনে শপথ নিয়ে বলেছেন, তিনি সংবিধান রক্ষা করবেন। সংবিধানের মধ্যে যা আছে তা কী গণতান্ত্রিক সংবিধান? তা তো না। তাহলে উনি শপথ পড়লেন কী জন্য? তিনি কি সংবিধান পড়তে পারেন না? উনি তো পড়তে পারেন। ফলে আমি শুরু থেকেই বলেছিলাম, তাকে ঘোষণা দিয়ে বলতে হবে, আমি গণ-অভ্যুত্থানের অভিপ্রায়ের প্রতিনিধি, আমি এখন থেকে রাষ্ট্রপ্রধান এবং আজ থেকে সকল সংবিধান বাতিল। সংবিধান বাতিল করতে না চাইলে তিনি বলতে পারতেন, আমাদের সংবিধানের মধ্যেই আছে সংবিধান মানে জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি। ফলে সেই জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি হিসাবেই আমি রাষ্ট্রপ্রধান। এখন থেকে আমার আইনই আইন।

ড. ইউনূস বলতে পারতেন, আজ থেকে সকল সংবিধান বাতিল। এখন থেকে আমার কথাই আইন।

এখন আপনি বলতে পারেন এটা কীভাবে হয়? এখন যদি একটা সামরিক অভ্যুত্থান হত, তাহলে আপনি সামরিক ফরমান মানতেন না? মানতেন তো। আর এখন গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবেন না কেন? যারা এটা মানতে রাজি না, তারা কারা? এরা তো ফ্যাসিস্ট শক্তি। ফ্যাসিজম তো আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়ে গেছে। আমাদের রক্তে রয়ে গেছে। আমরা আইনের কথা বলি বারবার, আইন আর মানুষ তো এক না। আইন তো মানুষ তৈরি করে। তাহলে আমি মানুষ হিসেবে যখন নতুন আইন তৈরি করব, তখন ফ্যাসিজম বলে তুমি এটা করতে পারবা না। এটা তো হয় না। ফলে, আমাদের অবশ্যই এই ফ্যাসিজমকে মোকাবেলা করতে হবে। অবশ্যই বাংলাদেশকে নতুনভাবে গঠন করতে হবে।

সকাল সন্ধ্যা: এখন অনেকে আশঙ্কা করছে ‘ইসলামি উগ্রপন্থা’র উত্থান হবে। আপনি কী মনে করেন?

ফরহাদ মজহার: এই যে আমরা ‘উগ্রপন্থা’ শব্দটা ব্যবহার করলাম, এইটা কিন্তু ওয়েস্টার্ন সংযোজন। উগ্রপন্থাটা কী? ইসলাম? তাহলে আওয়ামী লীগ কি উগ্রপন্থী না? তো তাকে উগ্রপন্থা বলেন না কেন? আমরা যখনই ইসলামি ফ্যাসিজমের কথা বলি, তখনই ফ্যাসিজমকে জাস্টিফাই করার জন্য কথাটা বলি। আওয়ামী উগ্রপন্থীকে জাস্টিফাই করার জন্য বলি। আওয়ামী লীগ যে ফ্যাসিস্ট স্টেট তৈরি করেছে, তাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য আমরা এই কথা বলি। কেন শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র বৈধতা? কারণ, তার (আওয়ামী লীগ) কাজ হচ্ছে ইসলামি উগ্রপন্থাকে দমন করা। উগ্রপন্থী হিসেবে যদি আমরা কাউকে চিহ্নিত করি, তাহলে এক নাম্বারে আসবে আওয়ামী লীগ আর দুই নাম্বারে আসবে বিএনপি। যারা আমাদের রাজনীতিতে দলীয় সন্ত্রাস ও বলপ্রয়োগ ঢুকিয়েছে। এইসব গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। এই দুইটা পলিটিক্যাল পার্টি দলীয় বল প্রয়োগে বিশ্বাস করে। ইসলামের একটা নৈতিক ভিত্তি আছে, আপনি চাইলেই তাকে জিহাদের কাজে উগ্রপন্থার দিকে নিতে পারবেন না। কিন্তু আপনি সন্ত্রাসী বলে মুসলমানদের হত্যা করবেন, যুদ্ধ করবেন, গাজার মতো প্রকাশ্যে গণহত্যা চালাবেন, কিন্তু আশা করবেন মুসলমান শান্ত থাকবে, তা তো হয় না। বাংলাদেশের সব থেকে বড় আলেম-ওলামাদের আমি চিনি। তাদের সাথে আমার সম্পর্ক-মহব্বত আছে। তারা প্রত্যেকে এই জিনিস ব্যাখ্যা করেছেন। তারা উগ্রতা, সন্ত্রাস ও সহিংসতার বিরোধী। আমি তো আমার বই ‘ক্রুসেড, জিহাদ ও শ্রেণি সংগ্রামে’ দীর্ঘদিন ধরে এসব বলে আসছি। একদিক থেকে ইসলামিক জিহাদের আরেক নামই সমাজতন্ত্র। যার মানে ব্যাক্তির চেয়ে সমাজ বড়। ব্যক্তির স্বার্থের চেয়ে সমাজের স্বার্থ আগে। এই আদর্শ পুঁজিতান্ত্রিক ব্যক্তিস্বার্থের বিপরীত। ইসলামি আলেমরা তো আর কার্ল মার্ক্সের নাম বলবে না। কিন্তু  আমার চেষ্টা এই মিলগুলো দেখিয়ে দেওয়া। যেন পাশ্চাত্য শক্তি আমাদের বিভক্ত করতে না পারে। নিজেকে নাফসানিয়াতের বিপরীতে রুহানিয়াতের পথে নিয়ে যাওয়াই ব্যক্তি ও সমাজের কার্যকর বিকাশ। নিজেকে বদলে ফেলা। নিজেকে যত্ন করা। এটা তো জিহাদের প্রথম কাজ। জিহাদের দ্বিতীয় কাজ হলো, কেউ যদি তোমাকে আঘাত করে, তার বিরুদ্ধে নিজের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা। জিহাদ শব্দটাকে আমরা নৈতিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক জায়গা থেকে জনগণের কাছে স্পষ্ট করতে পারি। যেন হিংসা, সন্ত্রাস ও উগ্রপন্থার কোনও সুযোগ কেউ না পায়। 

সকাল সন্ধ্যা: আলেম স্থানীয়রা মন্দির বা মূর্তি ভাঙার বিরুদ্ধে থাকলেও মাঠ পর্যায়ে তো তার প্রতিফলন নেই। আলেমরা তো আর মাঠেও থাকেন না?

ফরহাদ মজহার: মন্দির কারা ভাঙছে, তা দেখতে আমরা যাই তাহলে। গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক (বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব) তো বলছেন— এখন মন্দির তো আওয়ামী লীগ ভাঙছে। সম্পত্তি যা দখল হয়েছে, তা তো আওয়ামী লীগ করছে। তো তার কথা শুনছেন না কেন? উনি তো বলেছেন, পরিষ্কার করে আওয়ামী লীগ হিন্দু কার্ড খেলে, দেশ অস্থিতিশীল করে তোলে। আমাদের হিন্দুদের ব্যবহার করে ওরা। একটা ভুল ন্যারেটিভ দ্বারা আমরা বন্দি হয়ে গিয়েছি। অথচ যারা এর প্রতিবাদ করছে, তাদের কথা আমরা শুনছি না।

আমাদের সনাতন বা ভিন্ন ধর্মালম্বীদের যে ভয় আছে, তা তো অধিকাংশ সময় ভুল প্রচারের জন্য। আর ভয় তো থাকবেই, কারণ আপনি তো তাদেরকেও রাষ্ট্র গঠন করতে দেন নাই, তারাও তো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অংশীদার। রাষ্ট্র যদি গঠন করতেন, তাহলে তো হিন্দুও পার্টিসিপেট করবে, এটা তারই রাষ্ট্র হবে। নাগরিক হিসাবে আমাদের সাথে সাথে বাংলাদেশ তারাও রক্ষা করবে। রাষ্ট্র গঠন করতে না দিয়ে আওয়ামী লীগের বয়ানটা আপনি চাপিয়ে দিয়েছেন জনগণের ওপর। আপনি ধর্ম নিরপেক্ষতা চান, আপনার ধর্ম নিরপেক্ষতা কি ইসলাম নির্মূল করা? আপনি কি উপমহাদেশ থেকে ইসলাম নির্মূল করতে চান দিল্লির পলিসি অনুযায়ী, ইন দ্য নেম অফ সেকুলারিজম?

প্রশ্ন করেন, জসীম উদ্দিন রাহমানীকে ছাড়লা, তাহলে এখন ছাড়লা কেন? আর তখন ধরছিলা কেন? জঙ্গি কার্ডটা খেলবেন না। এই কার্ডটা বিজেপি খেলে।

আপনি তো সেকুলার স্টেট চান নাই। তাহলে গণতন্ত্রই যথেষ্ট। একে তো সেকুলারিজম, তার সাথে আপনি যুক্ত করেছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এভাবে মতাদর্শিকভাবে ইসলাম নির্মূল করতে চাইলে কি ইসলামিস্টরা বসে থাকবে? আপনি কী আশা করেন? কিন্তু এই রাজনৈতিক বাস্তবতার তুলনায় কি এমন জঙ্গি ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে, বলেন? প্রত্যেকটি জঙ্গি ঘটনার পেছনে আজকে মনিরুল ইসলামকে (পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম-সিটিটিসির প্রধান ছিলেন। পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় বর্তমান সরকার তাকে বাধ্যতামূলকভাবে অবসরে পাঠায়) গ্রেপ্তার করেন। তাকে নিয়ে কথা বলেন, কিভাবে সে দলগুলো বানিয়েছে? এই যে রাহমানীকে (মুফতি জসীমউদ্দীন রাহমানী) ধরছেন, তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ? লেটস গো ইনসাইড। এইটা তো সাংবাদিকদের কাজ। ওদের প্রশ্ন করেন, তাকে ছাড়লা, তাহলে এখন ছাড়লা কেন? আর যখন ধরছ, তখন ধরছিলা কেন? এটা ক্লিয়ার করা তো আপনাদের কাজ। জঙ্গি কার্ডটা খেলবেন না। এই কার্ডটা বিজেপি খেলে। এটা খেলতে দেবেন না বাংলাদেশে। এখানে সমস্যা আছে। এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা সেকুলার জঙ্গিদের নিয়ে। এদের বিষয়ে কথা বলেন। যারা কথায় কথায় ইসলামবিরোধী কথা বলে, অথচ সকলেই আমাদেরই ভাই-বোন। ওদের সাথে একসাথে বাস করি না আমরা।

আপনি বিএনপির আমলে দেখেন। জেএমবিকে যদি আমরা ধরি, জেএমবি তৈরি করেছে কে? বিএনপি। জামায়াত কিন্তু তৈরি করেনি। জামায়াতকে জামায়াতের দোষের জন্য দোষী করেন। জামায়াত বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায় নাই। তাদের কিছু কিছু লোক মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। সেটা আরেক বিষয়।

জঙ্গি শব্দটা আন্তর্জাতিকভাবে দেখেন। ইজরায়েল হামাসকে তো জঙ্গি বলে চালাতে চাচ্ছে। তাই বলে কি তা হচ্ছে? হামাস কি জঙ্গি সংগঠন? না। কারণ নিপীড়কের বিরুদ্ধে নিপীড়িত জনগোষ্ঠির লড়বার অধিকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। সারা পৃথিবী আজ ফিলিস্তিনের পক্ষে। আপনার জনগোষ্ঠীকে যদি কেউ আঘাত করে, অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার অধিকার আপনার আছে। এখন দেখেন পাকিস্তানও কিন্তু আমাদের সকলকে ‘জঙ্গি’ বলত। আপনি কি মনে করেন, একাত্তরে আমরা সবাই জঙ্গি ছিলাম? এখন এসব শব্দ কোনও প্রকার ক্রিটিক্যাল অ্যানালাইসিস না করে যখন আমরা ব্যবহার করি, বিশেষ করে গণঅভ্যুত্থানের পরে, তা খুবই মারাত্মক ভূল হবে। যারা জঙ্গি, তারাই এই শব্দ ব্যবহার করে। রাষ্ট্র যদি সন্ত্রাসী হয়, তাহলে তো সমাজে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন গড়ে উঠবেই। রাষ্ট্র যদি ফ্যসিস্ট হয়, তাহলে তো রাষ্ট্রে এন্টি ফ্যাসিস্ট লড়াই গড়ে উঠবে। আপনি কথা বলতে দিচ্ছেন না, সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছেন না, কথায় কথায় গুলি মারছেন— তাহলে কি বাকিরা বসে থাকবে? তাই আমরা বলব যে চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কিংবা বিবেকের স্বাধীনতার কোনও বিকল্প নাই। সামনের দিনে যে গঠনতন্ত্র হবে, সেখানে পরিষ্কার করে লেখা থাকবে— মত প্রকাশের অধিকার, চিন্তার অধিকার, বিবেকের অধিকার রাষ্ট্র কোনওভাবেই হরণ করতে পারবে না।

সকাল সন্ধ্যা: ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যারা ক্ষমতায় এসেছেন তারা কি পথ হারাচ্ছেন?

ফরহাদ মজহার: এখন পর্যন্ত প্রথম দিন থেকে আমি যা বলেছি, তা হলো তারা তো পথ হারিয়েছে। এই প্রশ্ন তো এখন করা উচিৎ না। কারণ তারা শপথ নিয়েছে কোথায়? পুরাতন শেখ হাসিনার সংবিধানের অধীনে। তারা তো হারিয়েই গিয়েছে। এখন আপনি বরং আমাকে প্রশ্ন করেন— এখান থেকে বের হওয়ার উপায় কী? পথ যে হারিয়েছে, তা নিয়ে কোনও প্রকার কনফিউশন থাকা উচিৎ না।

প্রথমত, বাংলাদেশের তথাকথিত সংবিধান অনুযায়ী এই সরকার অবৈধ। এখান থেকে কনফিউশনের কিছু নাই। আপনি তাকে শপথ পড়িয়েছেন বাংলাদেশের এই সংবিধানের অধীনে। সংবিধানের কোথায় লেখা আছে যে আপনি গণঅভ্যুত্থান করতে পারবেন? নির্বাচিত সরকার আপনি উৎখাত করতে পারবেন, কোথায় লেখা আছে? সংবিধানে কোথায় লেখা আছে যে আপনি অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠন করতে পারবেন? তাহলে তো আপনি একটি অবৈধ সরকার। তাহলে প্রথম কাজ হলো, অবৈধ সরকারকে বৈধ করা। তাই প্রথমেই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে হাজির হওয়া শক্তিকে বৈধ প্রমাণ করাই সবচেয়ে জরুরি কাজ ছিল। ড. ইউনূসকে বলতে হতো— জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি হিসাবে আমি রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করলাম। জনগণের তরফে আমি যা বলি, তাই এখন আদেশ।

ড. ইউনূসকে যদি আপনি ‘কলাগাছ’ও মনে করেন, তিনি অবশ্যই জনগণের অভিব্যক্তির প্রতিনিধি। কারণ তার পেছনে জনগণের আত্মত্যাগ আছে, লাশ আছে; তার পেছনে রক্ত আছে।


এটা শুনলে অনেকেই বলেন এটা কীভাবে হয়? তাহলে আপনি এরশাদের সময় কি এরশাদকে মানেন নাই। তিনি এসে সংবিধান স্থগিত করেছেন, ফরমান দিয়ে দেশ চালিয়েছেন। এতে অসুবিধা কী? লিগ্যালি এবং পলিটিক্যালি এটা বৈধ। যদি জনগণ মানে, তাহলেই এটা বৈধ। কারণ সবকিছুর ভিত্তিই জনগণ। আইন কিন্তু বৈধতার ভিত্তি না। আইনের বৈধতার ভিত্তি জনগণ। পিপলস সভরেইন পাওয়ারই হচ্ছে লেজিটেমিসির ফাউন্ডেশন। এই জায়গা থেকেই আপনি যাকেই বসান, সে যদি কলাগাছও হয়, তাও সেই প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রেসিডেন্ট বৈধ। ফলে ড. ইউনূসকে যদি আপনি ‘কলাগাছ’ও মনে করেন, তিনি অবশ্যই জনগণের অভিব্যক্তির প্রতিনিধি। কারণ তার পেছনে জনগণের আত্মত্যাগ আছে, লাশ আছে; তার পেছনে রক্ত আছে। তার পেছনে বহু পঙ্গু মানুষ আছে। হি রিপ্রেজেন্ট দ্য রেভুলেশন।

কিন্তু তাকে আপনারা কী করলেন? চুপ্পুর অধীনে শপথ নেওয়ালেন। কেন? কোনও যুক্তি নাই। অলরেডি মারাত্মক ক্ষতি হয়ে গেছে। এখান থেকে মুক্তির উপায় কী? এর থেকে মুক্তির উপায় দ্রুতবেগে জনগণের পরম অভিব্যক্তি হিসেবে গণঅভ্যুত্থানকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার। সংবিধান বাতিল করতে হবে। ইউনূসকে প্রেসিডেন্ট বা প্রধান হিসাবে ঘোষণা দিতে হবে। তারপর জনগণের আকাঙ্ক্ষার পরম অভিব্যক্তির লিখিত রূপ দাঁড় করাতে হবে। লিখতে হবে, অর্থাৎ নতুন গঠনতন্ত্র (Constitution) প্রণয়ন করতে হবে। অলিখিত অভিপ্রায় লেখার জন্য যে সময়, সেই সময়টাই অন্তর্বর্তীকালীন সময়। তিনি (ড. ইউনূস) যা বলবেন, তা হলো, যে সকল আইন আছে সেগুলো চলবে। আর যেসব আইন আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সাংঘর্ষিক, তা বাতিল হয়ে যাবে যাবে। এই তো দুটো লাইন। আর তো কিছু লাগে না। এরপর তিনি ফরমান বা আদেশ দেবেন। এভাবেই চলবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি নতুন গঠনতন্ত্র তৈরি করছেন। আমি আইনজীবীদের চ্যালেঞ্জ করতেছি— এখানে কী অসুবিধা? নতুন বিচারপতি হয়েছেন। উনি তো বিদেশে পড়াশোনা করেছেন। উনাকে জিজ্ঞেস করেন, আমি কি ভুল বলছি? আমি কি এখন রিট করব? কিন্তু আমি রিট করে তাকে বিব্রত করতে চাই না।

তারা মনে হয় আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার আনতে চাচ্ছেন। তারা কি করে একে বৈধ করবেন? এর তো কোনও বৈধতা নাই। এবং প্রধানমন্ত্রী যদি পদত্যাগও করেন, পরের প্রধানমন্ত্রী আসা পর্যন্ত শেখ হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী থেকে গেলেন বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী। কেন আপনারা দেশটাকে সাংবিধানিক জটিলতার মধ্যে ঢুকালেন? এর জবাবদিহি কে করবে আপনাদের? আমি তো বার বার এই এক কথাই বলে যাচ্ছি।

সকাল সন্ধ্যা: আপনি বলছেন, ড. ইউনূসকে প্রচলিত সংবিধান বাতিল করতে হবে। জোর দিচ্ছেন নতুন সংবিধান করায়। আপাতত ড. ইউনূসের মুখের কথাকেই আইন বলছেন। স্বৈরাচারের প্রথম ধাপ তো একনায়কতন্ত্র থেকেই শুরু হয়। আপনি কি মনে করেন না এটি একনায়কতন্ত্র কায়েম করতে পারে কিংবা তা স্বৈরাচারের রূপ নিতে পারে?

ফরহাদ মজহার: এটা ফাঁপা তর্ক। কারণ এর দ্বারা আপনি জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়কে একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরাচার দাবি করছেন। জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা আর একনায়কতন্ত্র এক না। কারণ একনায়কতন্ত্র জনগণের অভিপ্রায়বিরোধী বলেই সেটা একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরাচার। যেহেতু ‘জনগণ’, ‘রাষ্ট্র’, ‘সার্বভৌমত্ব’ ইত্যাদি সম্পর্কে আমদের সমাজের ধ্যান-ধারণা অতিশয় পশ্চাৎপদ, তাই আমরা ফাঁপা তর্ক করি। একটি দেশ বাহাত্তর সাল থেকে ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীনে থেকেছে। সেই দেশে একনায়কতন্ত্র, স্বৈরাচার ইত্যাদি ধারণা অস্পষ্ট এবং ফাঁপা।

তারপরও আমি প্রস্তাব দিয়েছি, সম্ভাব্য বিপদ এড়াবার জন্য আমরা ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন অ্যান্ড রিনকন্সট্রাকশন কাউন্সিল’ করতে পারি। এই কাউন্সিলে কারা থাকত? বিভিন্ন দলের প্রতিনিধি। এই গণ-অভ্যুত্থানে যারা অংশগ্রহণ করেছেন, তারাও কিন্তু ক্ষমতার অংশীদার। এই কাউন্সিলের বাংলা একটা নাম দিতে হোত। আমার এই মুহূর্তে কোনও বাংলা নাম মনে পড়ছে না। জাতীয় কাউন্সিল বা যে কোনও নাম দেওয়া যেত। সেখানে তাদের কাজ কী? এক নাম্বার কাজ হচ্ছে প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্র প্রধান যাতে স্বৈরাচারী না হয়ে যায়, সেটা রোধ করা। একটি নতুন গঠনতন্ত্র তৈরির প্রক্রিয়া যেন ঠিক মতো অনুসরণ করে, সেই দিকে নজর রাখা। দ্রুত সেটা করতে পারা। দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে, মন্ত্রণালয়গুলো রক্ষা করা। এখন যেভাবে দখল আর পাল্টা দখল চলছে, তা আটকে দেওয়া। তিন নাম্বার কাজ দুর্নীতি বন্ধ এবং শৃঙ্খলা রক্ষা করা। আমাদের সবার আগে রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। তারপর বাকি সব।

সকাল সন্ধ্যা: নতুন সংবিধানে ৭২ এর সংবিধান থেকে কী রাখা যেতে পারে বলে মনে করেন? কী বাদ যেতে পারে, নতুন কী যুক্ত হতে পারে?

ফরহাদ মজহার: ’৭২ এর সংবিধান তো একটা ফ্যাসিস্ট সংবিধান। সেখান থেকে প্রিএম্বেল (ঘোষণাপত্র) বাদে আর তো কিছু রাখার নাই। আর এটাতে কী রাখব, কী রাখব না— এটা আমি বলার চেয়ে জনগণই বলবে। আপনি বিভিন্ন সভা করবেন। ইউনিয়নে, উপজেলায় এসব সভাকে বলা হবে ‘গঠনতান্ত্রিক কাউন্সিল’। অর্থাৎ গঠনতন্ত্র প্রণয়নের কাউন্সিল। আপনি যে আমার সাক্ষাৎকারটা করছেন, সেটাও গঠনতান্ত্রিক কাউন্সিলে সাবমিট করতে পারবেন। কারণ এখানে আমরা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছি। মিডিয়ার খুব গুরুত্বপূর্ণ রোল এখানে আছে। ফলে, জনগণ কী চায়, তা আপনি মিডিয়া থেকে পেতে পারেন। এখন এইসব ছোট ছোট সভা করতে হবে। যখনই আপনি এসব সভা করবেন, তখনই তো পিপল এডুকেটেড হয়ে যাবে। লোকে তো বুঝবে, রাষ্ট্র গঠনের কাজ চলছে। সে উৎসাহী হয়ে এখানে পার্টিসিপেট করবে। এটা তো ভোটের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি তাকে ইনভলভ করছেন তার নিজের রাষ্ট্র নিজে গঠনের জন্য। এটাই তো পথ। এর বাইরে তো কিছু নাই।

সকাল সন্ধ্যা: ড. ইউনূস সাম্রাজ্যবাদী বিভিন্ন কোম্পানিকে দেশে এনেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আপনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন করেছেন। কেন তাকে প্রধান উপদেষ্টার পদে আপনার জায়গা থেকে যৌক্তিক মনে করছেন?

ফরহাদ মজহার: আমি তো তাকে এখানে বসাই নাই। আপনি যদি তার থেকে ভালো কোনও নাম দিতে পারতেন, তিনিই থাকতেন। আমি কি ড. ইউনূসের নাম বলেছি? গণঅভ্যুত্থান যদি কলাগাছকেও বসায়, কালাগাছও বৈধ। ফলে, ইউনূস এখানে অপ্রাসঙ্গিক। ইউনূসের চেয়ে ভালো কেউ নাই।

ড. ইউনূস সাম্রাজ্যবাদী কি না, আমাকে যদি প্রশ্ন করেন, তাহলে আমি হাম্বলি আপনার সাথে ডিফার করব। আমি সাম্রাজ্যবাদ মার্ক্সের-লেনিনের লেখা দিয়ে বুঝি, গালি হিসেবে বুঝি না। মাইক্রোক্রেডিট ছিল ‘নিউ লিবারেল ইকোনমির সেলফ এক্সটেনশন’র কৌশল। এটা তো আপনার রাষ্ট্রই মেনে চলে। রাষ্ট্রই তো কাছা খোলা মুক্ত বাজার নীতি ফলো করছে। রাষ্ট্রকে সাম্রাজ্যবাদী বলছেন না কেন? ইউনূসকে কেন বলছেন?

ড. ইউনূসের চেয়ে বেটার অপশন তো আমাদের কাছে নাই। এ জায়গা থেকেই বুঝবেন কেন ছেলেরা তাকে পছন্দ করল, কেন তাকে নির্বাচিত করল?

যদি আপনার রাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবিরোধী অবস্থান থাকত, তাহলে আপনি বলতে পারতেন ইউনূস রাষ্ট্রের সাথে বিরোধিতা করছে। সে তো রাষ্ট্রের পলিসিই ফলো করেছে। আপনারা সাংবাদিকরাও তো এই রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেন নাই। এটাকে তো বাড়তে দিছেন। লুটপাট মাফিয়া যা আসছে, তা তো রাষ্ট্রের কারণে আসছে। এরা তো ইউনুসের কারণে আসে নাই। ইউনূস তো মাফিয়াদের সাথে হাত মেলায় নাই।

তাছাড়া উনি তো তার অবস্থান বদলেছেন। বিজনেসের একটা পজিটিভ দিক আছে, তিনি ওইটা দেখাতে চেয়েছেন। নাথিং রঙ। কার্ল মার্ক্সও কিন্তু এভাবেই বলতেন। কমিউনিস্ট ইশতেহারে দেখেন, মার্ক্স কিন্তু বলেছেন, পুঁজিতন্ত্র নিত্যদিন বৈপ্লবিক পরিবর্তন ব্যতীত টিকে থাকতে পারে না। পুঁজিতন্ত্রের তাহলে বৈপ্লবিক দিকও আছে। ইউনূস তো সেই কাজই করছে। ক্যাপিটালিজম আমি চাই, কিন্তু মুনাফা আমি চাই না— এটা তার সোশাল বিজনেসের সিম্পল একটি মর্ম কথা। তিনি বলছেন, ক্যাপিটালিজম পসিবল, প্রফিটিয়ারিং বাদে। তার তো আসল টার্গেট মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশনগুলো। ওদের হাতে টাকা আছে। আমার আপনার হাতে তো পুঁজি নাই। তিনি (ড. ইউনুস) আমাদের হাতে পুঁজি তৈরি করার একটা বিকল্প পুঁজিতান্ত্রিক মডেল তৈরি করতে চেয়েছেন। তিনি আরও বলছেন, জিরো এমিশন। আপনি কি চান না বাতাসে আমরা গ্রিন হাউস গ্যাস কম ছড়াই, পরিবেশ নষ্ট না করি? তিনি একটা ইকোলজিক্যাল বিপ্লবের কথা বলছেন। এমন একটা সমাজ চান, যেখানে আমরা কার্বন-ডাই অক্সাইড ছাড়ব না বাতাসে। আমরা পরিবেশ ঠিক রাখব। তাহলে আমাদের অবশ্যই তাকে সাপোর্ট করতে হবে। তিন নম্বর তিনি বলছেন, জিরো পোভার্টি। এটা কি আপনি সাপোর্ট করবেন না! তিনি চান কেউ দরিদ্র না থাকুক। তাহলে অসুবিধা কী?

এই তিনটি নীতির ভিত্তিতে যদি সরকার চলে, আপনার তো তাতে খুশি হওয়া উচিৎ। তাই এসব শব্দ যেন আমরা ক্যাটাগরিক্যালি ব্যবহার করি। অর্থাৎ বুঝে-শুনে ব্যবহার করি। সাম্রাজ্যবাদী হলো একটি ব্যবস্থা যেটা আপনাকে বিনিয়োগ করতে দেয় না। সেই হিসেবে তো শেখ হাসিনা সাম্রাজ্যবাদী, কিন্তু ইউনুস তো সাম্রাজ্যবাদী না। অন্তত সেটা তিনি হতে চান না। তবে ইউনূস প্রো-ক্যাপিটালিস্ট। দুটো কিন্তু আলাদা জিনিস। শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক পুঁজিকে সমর্থন দিয়েছে, কিন্তু ইউনূস তা করে নাই। আপনি সেই জায়গা থেকে ড. ইউনূসের সমালোচনা করেন। এটা উচিৎ। তিনি হয়ত মনে করেছেন, সমাজতন্ত্র পসিবল না। ইউনূস কি কোনওদিন দাবি করেছেন যে তিনি সমাজতন্ত্রী? তা তো তিনি কোনওদিন করেন নাই। অসুবিধা কী? আর লেনিন যখন বলশেভিক বিপ্লবটি করেন, তখন তিনি কী বলেছিলেন? বলেছিলেন, গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অর্থনৈতিক মর্ম হলো উৎপাদন শক্তির বিকাশ ত্বরান্বিত করা। পুঁজিতন্ত্র দ্রুত ত্বরান্বিত করা। আমি লেনিনের সাথে এগ্রি করি। কারণ, পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশ চাই কি না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ তর্ক। কী সম্ভব আর কী সম্ভব না, সেটা তো ভিন্ন তর্ক। কিন্তু আমরা তো গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পূর্ণ বিজয় ঘটাতে পারি নাই। ইউনূসের থেকে বেটার অপশন তো আমাদের কাছে নাই। এ জায়গা থেকেই বুঝবেন কেন ছেলেরা তাকে পছন্দ করল, কেন তাকে নির্বাচিত করল?

সকাল সন্ধ্যা: গত দেড়-দুই দশকে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি ঢুকেছে, বিশেষত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য ধরন- এটাকে যখন সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, তখন আসলে কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন হবে বলে আপনি মনে করেন?

ফরহাদ মজহার: আমরা পার্থক্য করি। একটা হলো রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন, আরেকটি হলো সংস্কার। সংস্কার বিভিন্ন ক্ষেত্রে হতে পারে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার হতে পারে। আমি মনে করি শিক্ষাটা ইন্টারেস্টিং। কারণ শিক্ষা রাষ্ট্র গঠনের সাথে যুক্ত। আপনি কী শিক্ষা দিচ্ছেন? ইসলামি শিক্ষা যারা নিয়েছেন, তাদের যদি জিজ্ঞেস করেন, তারা বলবে শিক্ষা বলতে সেই শিক্ষাই বোঝায়, যা আমার মনের যত্ন করে, আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি করে। আর আমরা যাকে শিক্ষা বলি, যেমন— বুয়েট। এটা শিক্ষা না। এটা হচ্ছে স্কিল লার্নিং। স্কিল লার্নিংয়ের সবচেয়ে ভালো জায়গা হচ্ছে কারখানা। তাহলে বাংলাদেশের বড় বড় কারখানাগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়ে ফেলেন। সেটাই উত্তম হবে। একই সঙ্গে থিওরি ও ব্যবহারিক প্রয়োগ। স্কিল লার্নিং তো শিক্ষা না। শিক্ষা তো আসলেই মনের যত্ন নেওয়ার ব্যাপার। এই যে আপনি আমার দিকে ক্যামেরাটি তাক করে রেখেছেন। এই ক্যামেরা দিয়ে তো আপনি পর্নগ্রাফিও করতে পারেন। করছে না কিছু লোক? এখন আপনি এই কাজ করবেন না, আপনার মন ভিন্ন। এটাই কিন্তু আপনার মনের যত্ন। শিক্ষায় যদি এখন আপনি রূপান্তর চান, তাহলে আলেমদেরকেও আপনার আনতে হবে তর্কে। শিক্ষা বলতে শুধু মডার্ন শিক্ষার কথা বললে হবে না। একজন শিক্ষাবিদ এবং সায়েন্টিস্ট আমাকে বলেছেন— আমরা দ্রুত ও অতি সহজে ৫ বছরের মধ্যে কয়েক লক্ষ সায়েন্টিস্ট তৈরি করতে পারব। এই সরকার যদি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে, নর্থ আমেরিকার সাথে বসতে পারে— আমরা তাদের বলব, আমরা তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক পাঠাব। আমাদের লোকজন তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তাদের কারখানায় কাজ করে দক্ষতা ও শিক্ষা অর্জন করতে পারে। কিন্তু ওরা তোমার দেশে থাকবে না, তোমাদের নাগরিক হবে না। তারা আবার দেশে ফেরত আসবে। আমি এই দায় নিচ্ছি।

পাশ্চাত্য এখন মাইগ্রেশনবিরোধী। আমরা বলব মাইগ্রেশন আমরাও চাই না। আসো, আমরা তোমাদের অর্থনৈতিক বিকাশে সহযোগিতা করি, আর বিপরীতে তোমরা দক্ষ মানব সম্পদ বিকাশ ও টেকনলজি ট্রান্সফারে আমাদের সহায়তা করো।

তবে এই সরকারের প্রধান কাজ নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন। সংস্কার করা তার কাজ না। সংস্কার প্রতিটি সরকারেরই একটি ধারাবাহিক কাজ। ফলে, এখন আমাদের স্টেট প্রব্লেম নিয়েই ফোকাস থাকা দরকার।

সকাল সন্ধ্যা: ব্রিটিশ ভারতে কমিউনিস্টরা ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিত, এরপর ভারত ও পাকিস্তানেও তা আমরা দেখি। উর্দু এই শব্দটি এখন স্লোগান হিসাবে আপনি ব্যবহার করছেন। বাংলায় বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক— এটা লেখার পাশাপাশি ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান আপনার দেওয়ার কারণ কী?

ফরহাদ মজহার: আমি ইনকিলাব জিন্দাবাদ পছন্দ করি। বাংলায় বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক, সেই কথাটাও আমি লিখি। এর পেছনে পলিটিক্যাল কারণ আছে। আমরা এন্টি কলোনিয়াল লড়াইটা শেষ করি নাই। আমাদের এই লড়াই শুরু হয়েছে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের মাধ্যমে। পরবর্তীকালে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ যিনি প্রথম বলেছেন, তিনি একজন উর্দু কবি। এই ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানটা বামরা গ্রহণ করে, ভগত সিং পর্যন্ত। হিন্দু-মুসলমান ইউনিটির স্লোগান এটি, প্রথমত। দ্বিতীয়ত, এন্টি কলোনিয়াল স্ট্রাগল, যেটা আমরা কমপ্লিট করতে পারি নাই, এটা তার স্লোগান। ১৯৪৭ এ আমরা কেন এটা শেষ করতে পারি নাই। কারণ মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসের কাছে যে স্বাধীনতা এসেছে, তা নেগোসিয়েশনের স্বাধীনতা। এই নেগোসিয়েশনের ফলে রাষ্ট্রের যে আইন রয়ে গেছে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, আমাদের মন মানসিকতা, সবই কিন্তু কলোনিয়াল। ফলে ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানটা একদিকে এন্টি কলোনিয়াল স্ট্রাগলকে পূর্ণ করা। শুধু বাংলাদেশ না, পুরো উপমহাদেশকে মুক্ত করা। চিন্তা চেতনা, হিন্দু-মুসলমান বিভক্তি, এই সব কিছু থেকে মুক্ত করা।

যদি বাংলাদেশ স্ট্যাবল হয়, তাহলে এর যে তুফান, তা পশ্চিম বাংলায় কিংবা নর্থ ইস্টে যাবেই। সেটাই দিল্লির সবচেয়ে বড় চিন্তা।

এই স্লোগান আমার একার স্লোগান না। এটা বামদের স্লোগান, সবার স্লোগান। এটা র‌্যাডিক্যাল লেফট বামদের প্রিয় স্লোগান। এটি দ্বারা তারা উপমহাদেশের ইউনিটি উপলব্ধি করে। আমার দেশে গরিব আছে, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কায় সবখানেই গরিব আছে। এই যে উপমহাদেশের গরিব মেহনতি মানুষ, যাদের তথাকথিত জাতির নামে ভাগ করেছেন, তার ওপর যখন সে চাকরি করতে যায়, তখন আপনি ফেলানির মতো করে ঝুলিয়ে রাখেন কাঁটাতারে— তাই ফেলানিকে স্মরণ করে এই স্লোগান। আমরা আবার একটা ইতিহাস লিখব, যা মেহনতি মানুষের ইতিহাস, যা এই মানচিত্র বা কলোনিয়াল চিন্তাকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যাবে। এটা আমি নিশ্চিত। আমি বেঁচে থাকব কি না, জানি না, কিন্তু আমাদের এই আন্দোলন ভারতকে বদলে দেবে। আমরা যদি এখানে সফল হতে পারি তাহলে বাংলাদেশ পৃথিবীকে বদলে দেবে। আর যদি বাংলাদেশ স্ট্যাবল হয়, তাহলে এর যে তুফান, তা পশ্চিম বাংলায় কিংবা নর্থ ইস্টে যাবেই। সেটাই দিল্লির সবচেয়ে বড় চিন্তা। তারা এসে বাংলাদেশে আক্রমণ করবে— এটা চিন্তা করা বোগাস। কিন্তু তারা বলছে, যুদ্ধের জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। আজকে যদি বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে নিজের মর্যাদা নিয়ে শক্ত ভাবে দাঁড়াতে পারে, আপনি কাহাতক পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের আটকিয়ে রাখবেন। আপনি তো ’৪৭ থেকে অনেক কথা বলেছেন, সেগুলো বলেই তো ভাগ করেছেন। কই সুলতানদের আমলে কি পুরো দেশ একত্র ছিল না? ছিল তো। বাংলা ভাষা কে শিখিয়েছে? সুলতানরা শিখিয়েছে। এই সুলতানরা কে ছিল? তারা ছিল নেশন বিল্ডার। মুঘলরাই তো হিন্দুস্থান বানিয়েছে। হিন্দু বলতে তো কোনও শব্দ ছিল না। সিন্ধুকে ‘হিন্দু’ পারসিকরাই বলত।

এর কারণে ইনকিলাব স্লোগানটা সেই স্লোগান, যা আমাদের ইতিহাসকে রিভিজিট করতে উৎসাহী করে, অনুপ্রাণিত করে। উপমহাদেশের যে ক্ষতগুলো রয়েছে, ঐতিহাসিক যে ভুলগুলো রয়েছে, সেগুলোকে কাটিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, চীনের যে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ ইত্যাদি মোকাবেলা করবার শক্তি জোগায়। এশিয়াকে যেন নতুন এশিয়া রূপে আমরা তৈরি করতে পারি। তার জন্যই ইনকিলাব জিন্দাবাদ। সেখানে সার কথা, বাংলাদেশ এশীয়ার রূপান্তরে নেতৃত্ব দেবে।

সকাল সন্ধ্যা: সামনের দিনে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা কেমন দাঁড়াতে পারে বলে মনে করেন?

ফরহাদ মজহার: ভূ-রাজনীতির চিন্তা করলে শুধু উপমহাদেশের কথা চিন্তা করলে হবে না। প্রথমত, দ্বন্দ্ব এবং ভারসাম্য একসাথে আছে। চীনের সাথে কিন্তু ভারতের দ্বন্দ্ব আছে, পরিষ্কার। আবার ভারসাম্যও কিন্তু আছে। চীন বা ভারত এরা কেউই কিন্তু এমন কিছু করতে চায় না, যাতে তাদের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চীন এবং ভারত উভয়ের দিক থেকেই আমেরিকা একটা সমস্যা। কারণ আমেরিকা একটি ক্ষয়িষ্ণু শক্তি। তাই আমেরিকা এমন কিছু জায়গা দখল করে রাখতে চাইবে, যাতে তার সমুদ্রের উপর যে আধিপত্য মোটামুটি বজায় থাকে। সে জায়গা থেকে ‘আমেরিকা ইজ অলওয়েজ অ্যাক্টিভ’ বাংলাদেশে। ফলে, হাসিনাকে সরাবার চেষ্টা মার্কিনিদের সব সময়ই ছিল। এটা নতুন কিছু না। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, সেন্ট মার্টিনস দিলেই শেখ হাসিনাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকতে দিত। শেখ হাসিনা নিজেই সেন্ট মার্টিনস দেওয়ার প্রস্তাব যে  করে নাই, সেটা আমি-আপনি কিভাবে জানি? শেখ হাসিনা নিজেই মার্কিনিদের হাতে সেন্ট মার্টিনস তুলে দেওয়ার জন্য নেগোসিয়েট করে নাই, এটা কি আমি-আপনি জানি? ফলে একপক্ষ নিয়ে কথা বলাটা ঠিক না। এখন বাংলাদেশের উপর মার্কিনিদের আধিপত্য নিশ্চিত করা গেলে তো সেন্ট মার্টিনস দরকার নাই।

আমেরিকার মূল কনর্সানটা— আমি যতটুকু বুঝি— তা হলো বাংলাদেশের আর্মি ‘চৈনিক’ হয়ে যাবে, এটা তারা হতে দেবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন বিশ্ব শক্তি হিসাবে পতনের মুখে। তারা চাইবে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে স্বার্থের জায়গায় বন্ধুত্ব। কিন্ত এমন কিছু করবে না, যাতে দিল্লির সঙ্গে তাদের বিরোধ তৈরি হয়। এখন আমাদের নেতৃত্বে যদি ত্রিপুরা এক হয়ে যায়, নর্থ ইস্ট যদি এক হয়ে যায়— এটা ভারতের জন্য বড় সমস্যা। এটা তো নরমালি হবে। এটাতে মার্কিনিদের লাগবে না। হবে অবশ্যই যদি এরই মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে আমরা দাঁড়িয়ে যেতে পারি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটলে আপনি কি ত্রিপুরাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন? আসামকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন? ওরা মোংলা, চট্টগ্রামে পোর্ট ব্যবহার করত, আসা-যাওয়া থাকত। আমরা যদি গান গাওয়ার জন্য পাপনকে (অংগরাগ মহন্ত, ভারতের আসামের একজন কণ্ঠশিল্পী) আনতে পারি, তাহলে বাঙালি কালচার আর আসামি কালচারে কী তফাৎ? ওটা তো বাঙালি কালচারের এক্সটেনশন। উড়িয়া কালচারও একই রকম। তাহলে বৃহত্তর বাংলার সংস্কৃতি গড়ে উঠত এখানে। এটা যদি গড়ে ওঠে দিল্লি তো সেটা কন্ট্রোল করতে পারবে না। সম্ভবও না। তাহলে স্বাভাবিক গতিতে যেটা ঘটবে, তা তো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লোক নিজের থেকেই বুঝবে। তাই দিল্লি চায়, আমরা যাতে মেরুদণ্ড নিয়ে দাঁড়াতে না পারি। এটাই তো আসল ইস্যু। তাই আমাদের জন্য সবচেয়ে শোষণকারী দেশ হচ্ছে ভারত ও চাইনিজরা। কিন্তু চাইনিজদের একটা বিষয় হচ্ছে ওরা ‘নেসেসারি’, যেমন চীন আপনাকে কাঁচামাল, মেশিন দেয়, কিন্তু ভারত আপনাকে কনজিউমার পণ্য বিক্রি করে। আমরা স্রেফ ভারতের বাজার, কিন্তু চীনের সঙ্গে সম্পর্ক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করা যায়। ভারতের সঙ্গে সম্ভব না।

বন্ধু রাষ্ট্র বলতে কিছু নাই। এভাবে আমরা আলাপ করব না। আমাদের সম্পর্ক হবে নেগোসিয়েশনের ভিত্তিতে। চীনের সাথে কিন্তু ট্রেড ওপেন করা সম্ভব। কিন্তু ভারত আপনার সাথে ট্রেড ওপেন করবে না। ভারত কী চায়? কানেক্টিভিটি চায়, কিন্তু পয়সা দিতে চায় না। এটা তো হতে পারে না। এটা থামাতে হবে। দেশের মধ্যে দিয়ে ট্রেন নেবে, কিন্তু কোনও পয়সা দেবে না, এটা কি হতে পারে? ভারত অবশ্যই আমাদের মিত্র নয় এবং রাষ্ট্রচিন্তার তত্ত্বানুযায়ী ‘বন্ধু রাষ্ট্র’ নামে কোনও রাষ্ট্র থাকতে পারে না। সেটা সরকারের নীতি হতে পারে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের দিক থেকে সকল রাষ্ট্রই তার শত্রু। বন্ধু হলে তো আলাদা রাষ্ট্র গঠনের দরকার হতো না। রাষ্ট্র থাকা মানেই সব রাষ্ট্র আপনার শত্রু। এখানে সম্পর্ক হতে হবে পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে। একটি রাষ্ট্র আমার মিত্র হতে পারে, যদি সে আমার স্বার্থ দেখে। বিপরীতে আমরা তাদের স্বার্থ দেখব। দিল্লি আমাদের স্বার্থ কখনই দেখে নাই, দেখবেও না। তাই দিল্লির সাথে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হতেই হবে। দিল্লি যদি পাল্টায়, তাহলে আমি খুব খুশি হব। দিল্লি যদি এটা রিয়েলাইজ না করে, বাংলাদেশ ভারতের জন্য বড় সিকিউরিটি প্রব্লেম এবং বাংলাদেশের সঙ্গে সু সম্পর্কই তার একমাত্র সমাধান, তাহলে এটা দিল্লির জন্য মারাত্মক আত্মঘাতী হবে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দিল্লি এখন যা প্রচার করছে, তা মারাত্মক ভুল। দিল্লির প্রহসনটা খেয়াল করেন। আওয়ামী লীগ তাদের সবচেয়ে বড় মিত্র। কিন্তু আওয়ামী লীগের লোকজন যখন ভারতে যেতে চায়, তখন তারা আটকিয়ে দেয়। মানিকের (সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক) মতো লোক ধরা পড়ে এবং করুণ পরিণতি হয়। ছাত্রলীগের ছেলেপেলে পালাতে গেছে, বন্দুক হাতে ওদের আটকায় রাখছে। কারণ দিল্লি থেকে পারমিশন আসতে হবে। আর যখন মমতা (পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) বলল— আমি রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক বুঝি, কিন্তু যদি কেউ আমার দরজায় এসে ঠক ঠক করে, তাহলে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে তাকে আমি জায়গা দেব। এরপরেই কিন্তু মমতার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। সেই ক্ষেত্রে মমতার ভুল আছে। কিন্তু ভুলের সুযোগে বিজেপি তাকে উৎখাত করতে পাগল হয়ে গেছে।

শেখ হাসিনাকে সেন্ট মার্টিনস দেওয়ার যে প্রস্তাব করে নাই— সেটা আমি আপনি কীভাবে জানি? শেখ হাসিনা যে এই কথা বলছে, সে নিজেই যে এটা মার্কিনিদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য নেগোসিয়েট করে নাই, এটা কি আমি-আপনি জানি?

তাই পরিষ্কার থাকা ভালো, দিল্লির সাথে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার কোনও বাস্তবতা নাই। চীনের সাথে আমাদের ট্রেড ডেফিসিট কমানোর বাস্তবতা আছে। মাতারবাড়ীতে ওদের যে কয়লার কারখানা, এটা তো চীনের প্রস্তাব না, শেখ হাসিনার প্রস্তাব ছিল। এখন আপনি যদি চীনকে বলেন এই মাতারবাড়ী কারখানার জন্য আমাদের একটা এনভায়রমেন্টাল ও ইকোলজিক্যাল সুরক্ষা ব্যবস্থা দাঁড় করাতে হবে, চীন কিন্তু তার বিরোধিতা করবে না। কিন্তু সেটা আপনি কিন্তু রামপালে পারবেন না। বুঝছেন না, বিষয়টা। এর ফলে কান্ট্রি টু কান্ট্রি আমাদের আলাদা আলাদাভাবে ডিল করতে হবে।

সকাল সন্ধ্যা: প্রাণপ্রকৃতি নিয়ে আপনি দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। দেশীয় প্রজাতি রক্ষা ও প্রাণীকূল নিয়ে আপনার কাজ রয়েছে নয়াকৃষি। নতুন করে যদি সংবিধান লেখা হয় এ ব্যাপারে কী থাকতে পারে?

ফরহাদ মজহার: এটা হবে এক লাইনে। রাষ্ট্রের কোনও অধিকার থাকবে না প্রাণ, প্রকৃতি এবং প্রাণ বৈচিত্র্যের ক্ষতি করে, এমন কোনও নীতি, আইন বা ব্যবস্থা গ্রহণ করবার। জীবন ব্যবস্থার ধ্বংস করে বা প্রাণ বৈচিত্র্য ধ্বংস করা যাবে না। ব্যস। প্রাণ-প্রকৃতি নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলা তো সহজ কাজ। গঠনতন্ত্রে এরকম দু-এক লাইন থাকবে। যাতে বোঝা যাবে রাষ্ট্রের কী কাজ এবং নাগরিকের কী কাজ?

এটা এখনকার সংবিধানে তো পরিষ্কার না। রাষ্ট্র এমন কোনও কাজ করতে পারবে না, যাতে কেউ নির্বিচারে বিষ ব্যবহার করতে পারে। এটা তো জেনারেল আইডিয়া। সংবিধান তো জেনারেল আইডিয়ার উপরই হওয়া উচিৎ। এটার পলিসি ঠিক হবে গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে। এখন তো পলিসি যেমন, তেমনভাবে আইন করা। কিন্তু তখন তো আপনি তা পারবেন না। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। মিষ্টি পানি আমাদের সম্পদ। ফলে এমন কিছু করা যাবে না যাতে এই মিষ্টি পানি নষ্ট হয়। এ ধরনের কোনও কিছু কি আমাদের সংবিধানে আছে? নাই তো। আছে কোথায়? নেপালে। তাহলে এগুলো তো আমরা নিতে পারি, গ্রহণ করতে পারি। নতুন বাংলাদেশ বানাতে পারি। সেই বাংলাদেশ ইউরোপের মতো জায়গায় পৌঁছাতে পারে। আমি এই কথা বললে মানুষ হাসে। কিন্তু বাংলাদেশকে ইউরোপের মতো গড়তে ম্যাক্সিমাম পাঁচ বছর লাগবে। আপনি দেখেছেন কীভাবে আমাদের বিদেশি ভাইয়েরা রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে। আমাদের কত মানুষ কত জায়গায় ছড়িয়ে আছে, ওরাই আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে ফেলবে। ডেফিনেটলি আমরা এটা করতে পারব।

সকাল সন্ধ্যা: এই অন্তবর্তীকালীন সরকারকে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে কতটা সময় দেওয়া যৌক্তিক মনে করেন?

ফরহাদ মজহার: এটা তো নেগোসিয়েশনের পার্ট। আমি যেটা বলব, রাজনৈতিক দলগুলোকে এখনই রাষ্ট্র গঠনের কাজে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে। আমি সকলকে বলেছি, দেখেন আমরা যদি রিকনসিলিয়েশন এবং রিকনস্ট্রাকশনের কাউন্সিল করতে পারি, তাহলে যারা ফ্যাসিজম এবং এই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, রাষ্ট্র ক্ষমতাটা তাদের সকলের হবে। এরা একত্র হয়ে মনিটর করতে পারে এই সরকারকে। এতে তখন তাড়াহুড়া করার কিছু থাকবে না।

এই সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে সংবিধান তৈরি করা। সংস্কার করা তার কাজ না।

আমাদের কাজ হচ্ছে দুটি। একটা হচ্ছে সবার সাথে কথা বলে একটা ভালো গঠনতন্ত্র  তৈরি করা। দ্বিতীয়ত, যাতে আমরা আমাদের অর্থনীতিকে তাড়াতাড়ি বিল্ড করতে পারি। প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা করতে পারি, তার চেষ্টা করা। আর তৃতীয়ত, যাতে যাদের পুঁজি কম তাদের সহযোগিতা করে একটা উদ্যোক্তা শ্রেণী যেন আমরা দ্রুত গড়ে তুলতে পারি। আমরা ড্রাস্টিক পরিবর্তন শিক্ষা ব্যবস্থায় করতে পারি। আমরা একটা রোবাস্ট হেলথ সিস্টেম গড়ে তুলতে পারি, যা মানব সম্পদ সুস্থ রাখবে। এটা যখন আপনাকে করতে হবে, তখন বিএনপিকে ছাড়া তো তা করতে পারবেন না। প্রত্যেকটি পলিটিক্যাল পার্টিকে আপনার লাগবে। এই সময় প্রশাসনিক এবং পলিসি সংস্কারে সকল রাজনৈতিক দলকে ভূমিকা রাখবার সুযোগ করে দিতে হবে।

আমরা কী পারি, ইতোমধ্যেই দেখিয়েছি। ফলে আগামীতে কী পারব, তা অবশ্যই বুদ্ধিমানেরা আন্দাজ করতে পারছেন। বাংলাদেশ শক্ত জমিনের ওপর দাঁড়িয়ে যাবে।

সকাল সন্ধ্যা: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ দীর্ঘ সময় দেওয়ার জন্য।
ফরহাদ মজহার: আপনাদেরও ধন্যবাদ।

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত