যুক্তরাষ্ট্র এই সপ্তাহে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে অর্থনৈতিক আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছে।
বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তার লক্ষ্যে ওয়াশিংটন এই পদক্ষেপ নিয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ব্রিটিশ দৈনিক ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের জেরে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন হয় এবং তিনি ভারতে পালিয়ে যান। এমন বাস্তবতার মধ্যেই আগামী ১৪ ও ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম উচ্চপর্যায়ের অর্থনৈতিক আলোচনা হতে যাচ্ছে।
৮৪ বছর বয়সী নোবেলজয়ী ক্ষুদ্রঋণের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইউনূস গত মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় তার সঙ্গে দেশের অন্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারাও অংশ নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবে দেশটির ট্রেজারি বিভাগ। এই দলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ও বাণিজ্য প্রতিনিধিরা থাকবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের আন্তর্জাতিক অর্থবিষয়ক সহকারী ব্রেন্ট নেইম্যান ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, “আমরা আশাবাদী, প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক দুর্বলতা দূর করে উন্নতি ও সমৃদ্ধির ভিত্তি গড়তে সক্ষম হবে।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশ যদি তার আর্থিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনে, সরকারি আয় বাড়ায় এবং দুর্নীতি কমায়, তাহলে তারা দেশের অর্থনীতি আরও ভালো করতে পারবে। এই কারণে ওয়াশিংটন বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে সাহায্য করবে।”
করোনাভাইরাস ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক বাজারে বড় ধাক্কা লাগে। এক সময়কার আঞ্চলিক অর্থনৈতিক শক্তি বাংলাদেশকেও এর ফলে অনেক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়। বিশেষ করে তেলসহ অন্যান্য জিনিসপত্র কেনার খরচ অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তাই ২০২২ সালে বাংলাদেশকে আইএমএফ থেকে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ধার নিতে হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বাজেট ও মুদ্রানীতি এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও আলোচনায় বসবেন।
কয়েক সপ্তাহের সহিংস বিক্ষোভে প্রায় ৫০০ মানুষ নিহত হওয়ার পর গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়। এই অস্থিরতা দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং এর অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পোশাক খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
বাংলাদেশের এই খাত বিশ্বে চীনের পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং কর্মসংস্থানের একটি প্রধান ক্ষেত্র। এই শিল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা গত মাসে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে জানান, কিছু চেইন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে অর্ডার স্থানান্তর করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে শিল্প খাতে সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছে। এই সংস্কারের মধ্যে রয়েছে ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে অবৈধ ঘোষণার বিধান বাতিল করা।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস গার্মেন্টস শিল্পে শ্রম সংস্কারের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি মনে করেন, এই সংস্কারগুলো গার্মেন্টস শিল্পকে আরও বেশি অর্ডার আনতে সহায়তা করবে।
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস জানিয়েছে, শেখ হাসিনার পতনে বাংলাদেশের বিরোধীরা উল্লাস করেছে। কারণ তারা তাকে একজন অত্যাচারী হিসেবে দেখেছিল। কিন্তু দেশটির শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারতের মোদী সরকারকে এই ঘটনা অস্বস্তিতে ফেলেছে। কারণ বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বাড়লে তা ভারতের স্বার্থ ও প্রভাবকে ক্ষুণ্ন করতে পারে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবহুল পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ভারতের দীর্ঘদিনের অসন্তোষকে ফের জাগিয়ে তুলেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যখন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল, তখন ভারত শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সমর্থন দিয়েছিল।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের হাত আছে, এমন অভিযোগ গত মাসে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর অস্বীকার করে।
তখন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল সাংবাদিকদের বলেন, “শেখ হাসিনার পদত্যাগে যুক্তরাষ্ট্র জড়িত ছিল- এমন যেকোন ইঙ্গিত একেবারেই মিথ্যা।”
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার।
এতে মিলার জানান, বাংলাদেশের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে। এই প্রসঙ্গে রোহিঙ্গা সংকটের কথাও তোলেন তিনি।
মিলার বলেন, “শরণার্থী সংকট মোকাবেলায় ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশকে ২০০ কোটি ডলার সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ২০২৩ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে বাংলাদেশকে ২১ কোটি ডলার সহায়তা দিয়েছে।”
এমন সহায়তা অব্যাহত থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মিলার বলেন, “বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্কের ওপর যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্ব দেয়।”
তথ্যসূত্র : ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস।