টেস্ট ক্রিকেটের সেরা রং ছড়ানো দিন গেল চেন্নাইতে। টেস্টের প্রথম দিন শুরুতে পেসাররা দাপট দেখালেন। বিশেষ করে হাসান মাহমুদ। দিনের শেষে ব্যাটাররা জায়গা দখলে নিলেন। রবিচন্দ্রন অশ্বিন ও রবীন্দ্র জাদেজার প্রতিরোধে। লড়াই-পাল্টা লড়াইয়ের পালাবদলে ভারত-বাংলাদেশ প্রথম টেস্টের প্রথম দিন দারুণ উপভোগ্য ছিল।
টেস্টের প্রথম ভারত ৬ উইকেটে ৩৩৯ রানে শেষ করেছে। উইকেটে অপরাজিত আছেন ১০২ রান করা অশ্বিন। অপরপ্রান্তে ৮৬ রানে ব্যাট করছেন জাদেজা। দুজনের ১৯৫ রানের জুটিতে ১৪৪ রানে ৬ উইকেট হারানো ভারত ম্যাচে ফিরেছে দুর্দান্ত ভাবে।
ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ সেঞ্চুরি করেছেন অশ্বিন। দল খাদের কিনারে থাকা অবস্থায় উইকেটে এসেছিলেন। ঠান্ডা মাথায় চাপ সামলেছেন। এরপর অভিজ্ঞতার ঝাঁপি মেলে ধরেছেন। তাতে নিজের জন্ম শহর চেন্নাইতে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি পেয়ে গেলেন অশ্বিন। টানা দ্বিতীয় টেস্টে।
ওদিকে অশ্বিন দুর্দান্ত সমর্থন দিয়েছেন জাদেজা। অশ্বিন ১১২ বলে করেছেন ১০২ রান। জাদেজাও এই গতিতে রান তুলেছেন। ১১৭ বলে করেছেন ৮৬ রানে। দুই অলরাউন্ডারের দৃঢ়তায় শেষ সেশনে কোন উইকেট না হারিয়ে ১৬৪ রান তুলেছে ভারত।
এর আগের দুই সেশন ছিল বাংলাদেশের। আরও ছোট করে বললে হাসান মাহমুদের। দিনটি অবিশ্বাস্য ভালো কেটেছে হাসানের। শুরুতে চিপক শহরের আকাশে হালকা মেঘ এবং লাল মাটির নতুন পিচ পেসারদের কাজ সহজ করে দেয়। সেই সুবিধা নিয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন হাসান।
এক্সপ্রেস বোলার তিনি নন, হাসানের শক্তিটা কবজিতে। বল ছাড়ার সময় কবজির জোড়ে সুইং করাতে পারেন। সেই সঙ্গে অফস্ট্যাম্পের বাইরের জায়গায় বল করে বিভ্রান্ত করেন ব্যাটারদের। বিশ্বের সেরা দুই ব্যাটার রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলি এই ইনিংসে বিভ্রান্ত হলেন। দুজনই হয়েছেন হাসানের শিকার।
এছাড়া শুভমান গিল ও ঋষভ পান্তের উইকেটও নিয়েছেন হাসান। তার বোলিং কারিশমায় রোহিত ৬, শুভমান ০, কোহলি ৬ ও পান্ত ৩৯ রানে ফিরেছেন। আগেই টেস্টেই ৫ উইকেট নেওয়া হাসান তার আত্মবিশ্বাস দিয়েই চেন্নাইয়ে উজ্জ্বল ছিলেন।
হাসানকে সঙ্গ দিয়ে এই টেস্টের আগে আলোচিত নাহিদ রানা ফিরিয়েছেন জশস্বি জয়সওয়ালকে। ১১৮ বলে ৫৬ রান করে আরও একবার ধারাবাহিকতার পরিচয় দিচ্ছিলেন জয়সওয়াল। অফস্ট্যাম্পের বাইরের বলে তাকে ফিরিয়েছেন রানা। আর মিরাজ আউট করেন ১৬ রান করা লোকেশ রাহুলকে।
এরপর এরপর বিরাট অপরাজিত জুটিতে বাংলাদেশকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে ভারত। একটা সময় দুইশোর নিচেই স্বাগতিকদের অলআউট করার সুযোগ ছিল। কিন্তু অশ্বিন-জাদেজার দৃঢ়তায় তা হয়নি।
অশ্বিন-জাদেজা ছাড়িয়ে গেলেন শচিন-জহিরকে
শকে হতাশ করে দেওয়া জুটি এগিয়ে নিচ্ছে ভারতকে। রবীন্দ্র জাদেজা ও রবিচন্দ্রন অশ্বিন মিলে এই এগিয়ে চলায় গড়েছেন নতুন রেকর্ড। বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্টে সপ্তম উইকেট বা তার নিচে সর্বোচ্চ রানের জুটি এখন তাদের।
চেন্নাই টেস্টের প্রথম ইনিংসে তৃতীয় সেশনের পানি পানের বিরতি পর্যন্ত ৬ উইকেটে ২৮৫ রান তুলেছে ভারত। অশ্বিন ব্যাট করছেন ৮০ রানে আর জাদেজা ৫৬ রানে। তাদের জুটি দাঁড়িয়েছে ১৪১ রানের।
২০০৪ সালে বাংলাদেশে জহির খানকে নিয়ে দশম উইকেটে ১৩৩ রানের জুটি গড়েছিলেন শচিন টেন্ডুলকার। জাদেজা ও অশ্বিন ওই জুটির রেকর্ড ছাড়িয়ে গেলেন। বাংলাদেশের বিপক্ষে এখন ভারতের সাত বা তার নিচের যে কোন উইকেটে তাদের বর্তমান জুটিই সর্বোচ্চ।
৫ বলে নেই ২ উইকেট
পন্তের ফেরার পর লোকেশ রাহুলকে নিয়ে ৪৮ রানের জুটি গড়েছিলেন যশস্বী জয়শওয়াল। ৫ বলের ব্যবধানে ২ উইকেট হারিয়ে ভারতকে আবারও ধাক্কা দেয় বাংলাদেশ। ৫৬ করা জয়সওয়ালকে ফেরান শুরুতে বেশ কবার তাকে অস্বস্তি ফেলা নাহিদ রানা।
১৪৮ কিলোমিটার গতির বলটি জয়সয়ালের ব্যাটের কানায় লেগে স্লিপে সাদমানের হাতে জমা পড়ে। ধারাভাষ্যকার রবি শাস্ত্রী বলছিলেন, ‘‘উইকেটটি ডিজার্ভ করে নাহিদ রানা ‘’
অপর ধারাভাষ্যকার তামিম ইকবাল বলছিলেন, ‘‘স্পিনারদের কাছ থেকে উইকেট প্রয়োজন বাংলাদেশের।’’ তখনই মেহেদী হাসান মিরাজ ফেরান ১৬ রান করা লোকেশ রাহুলকে। ৪ উইকেটে ১৪৪ থেকে ৫ বলের ব্যবধানে ৬ উইকেটে ১৪৪-এ পরিণত হয় ভারত।
জয়সওয়ালের রেকর্ড
অভিষেকের পর ঘরের মাঠে টনা ষষ্ঠ টেস্টে অন্তত ৫০ রান করার রেকর্ড গড়লেন যশস্বী জয়সওয়াল ।১৯৪৬ থেকে ১৯৫২ সালের মধ্যে ১০ টেস্ট খেলা রুশি মোদির দখলে এতদিন ছিল কীর্তিটা। অভিষেকের পর থেকে ঘরের মাঠে টানা ৯ টেস্টে অন্তত একবার ৫০ ছাড়ানোর বিশ্বরেকর্ড বাংলাদেশের মুমিনুল হকের।
অশ্বিন-জাদেজার ফিফটি
৬ উইকেটে ১৭৬ রানে চা বিরতিতে যায় ভারত। এরপর ভারতের ইনিংসের হাল ধরেছেন রবীন্দ্র জাদেজা ও রবিচন্দ্রন অশ্বিন। সাধারণত বল হাতে জুটি গড়েই প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করেন দুজন। এবার অষ্টম উইকেটে অবিচ্ছিন্ন থেকে ইনিংসটা বড় করে চলেছেন তারা। তাদের জুটি ছাড়িয়ে গেছে ১০০ রান। অশ্বিন ব্যাট করছিলেন ৮০ আর জাদেজা ৫৬ রানে। ভারতের স্কোর ৭০ ওভারে ৬ উইকেটে ২৮৫।
ক্যাচ মিসের আক্ষেপ নিয়ে লাঞ্চে
চেন্নাই টেস্টে অসাধারণ সেশন কাটালো বাংলাদেশ। হাসান মাহমুদের চমৎকার বোলিংয়ে ভারতকে প্রথম দিন শক্ত চ্যালেঞ্জ উপহার দেওয়া গেছে। লাঞ্চের আগে ভারত ৩ উইকেটে করতে পারে ৮৮ রান। ৩টি উইকেটই নিয়েছিলেন হাসান মাহমুদ।
উইকেটের সংখ্যাটা অনায়াসে ৪ হতে পারতো। ঋষভ পন্ত দুবার আউট হওয়ার মুখ থেকে বেঁচেছেন। দুবারই তাসকিন আহমেদের বলে। একবার ডিপে সাকিব বলের ফ্লাইট ভুল পড়েছেন। আরেকবার স্লিপে সাদমান ও শান্তর ভুল বোঝাবুঝিতে ক্যাচ মিস হয়।
গতির ঝড় তোলা নয়, হাসান তার মায়াবী বোলিংয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। ১৩০-৩৫ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টার বোলিংয়ে আর এখন এক্সপ্রেস বলা যায় না। হাসানের বোলিং গতিটা তেমনই। তবে এই পেসারের আছে অবিশ্বাস্য নিয়ন্ত্রণ।
কব্জির নিয়ন্ত্রণে বলকে কখনও ইনসুইং কখনও আউট সুইংয়ে ঘুরিয়েছেন হাসান। জায়গায় বল করে ব্যাটারদের ড্রাইভ করতে বাধ্য করেন তিনি। তাতে পরাস্ত হয়েছেন রোহিত শর্মা-বিরাট কোহলি। দুজনই হাসানের আউটসুইংয়ে খেলতে গিয়ে ক্যাচ দিয়েছেন উইকেটের পেছনে।
তাই গত ১৫ বছরে প্রথমবার ভারতের শুরুর তিন উইকেট প্রথম ১০ ওভারে কোনও এক বোলারের শিকার হলো। হাসানের সেশনে আরও এক শিকার পেতো বাংলাদেশ। লাঞ্চের ঠিক আগে ৩১ রানে থাকা পন্ত তাসকিনের বলে ক্যাচ দিয়েছিলেন উইকেটের পেছনে। কিন্তু স্লিপে থাকা সাদমান ও শান্ত’র ভুল বোঝাবুঝিতে ক্যাচ মিস হয়।
বিরাট কোহলিকেও ফেরালেন হাসান মাহমুদ
যেকোনও বোলারেরই স্বপ্নের উইকেট হয় সেরা ব্যাটাররা। হাসান মাহমুদ সম্ভবত স্বপ্নের ভেলায় ভাসছেন। প্রথমে রোহিত শর্মা, এরপর বিরাট কোহলি। বিশ্বসেরা ব্যাটারকে নিজের ট্রেডমার্ক অফস্ট্যাম্পের বাইরের ড্রাইভের বলে পরাস্ত করেছেন। ৬ বলে ৬ রানে ফিরলেন কোহলি। ভারত ৩ উইকেট হারিয়ে ৩৪ রান।
বিরাট কোহলি বরাবরই ড্রাইভ করতে পছন্দ করেন। তার ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংসগুলোতে আছে কপিবুক ক্রিকেটের সেরা শট ড্রাইভ। সেই ড্রাইভ করতে গিয়েই আউটসাইড এজ হয়ে লিটন দাসের ক্যাচে পরিণত হলেন।
ওদিকে কব্জির ক্যারিশমায় অবিশ্বাস্য সুইং বল করতে থাকা হাসান পেয়ে গেলেন নিজের তৃতীয় উইকেট। ভারতকে খাদের কিনারায় ফেলেছেন নিজের ৩ ওভারে ৩ উইকেট নিয়ে।
হাসানের জোড়া আঘাত
পরপর ২ ওভারে ২ উইকেট তুলে নিলেন হাসান মাহমুদ। ষষ্ঠ ওভারে রোহিত শর্মাকে আউট করে প্রথম উইকেট এনে দেন দলকে। দলীয় অষ্টম ওভারে ফেরালেন শুবমান গিলকে।
হাসানের লেগ স্টাম্পের বেশ বাইরের বলে গ্লান্স করে চারের আশায় ছিলেন গিল। কিন্তু বল তার ব্যাট ছুঁয়ে চলে যায় লিটন দাসের হাতে। আম্পায়ার একটু ভেবে বাংলাদেশ দলের আবেদনে সাড়া দেন।
এর আগের বলেই হাসানের ইনসুইংগারে পরাস্ত হন গিল। তবে বলে বাউন্স বেশি থাকায় আম্পায়ার আউট দেননি। বাংলাদেশও এ যাত্রা রিভিউ নেয়নি। অবশ্য গিল এক বলের বেশি ছিলেন না। ৮ বলে কোনও রান না করেই ফিরেছেন। ভারত ২ উইকেটে করেছে ৩৪ রান।
রোহিত শর্মাকে ফেরালেন হাসান
বাংলাদেশকে প্রথম উইকেট এনে দিলেন হাসান মাহমুদ। ভারত ওপেনার রোহিত শর্মাকে বেশিক্ষণ টিকতে দেননি তিনি। হাসানের বলে আউটসাইড এজ হয়ে স্লিপে ক্যাচ দিয়েছেন রোহিত। ভারত অধিনায়কের দেওয়া সুযোগ সহজেই লুফে নিয়েছেন দ্বিতীয় স্লিপে দাঁড়ানো নাজমুল হোসেন শান্ত।
১৯ বল খেলে মাত্র ৬ রানে ফিরেছেন রোহিত। অবশ্য আগেই ভারত অধিনায়ককে ফেরাতে পারতেন শান্ত। ভাগ্য সঙ্গ দেয়নি। চতুর্থ ওভারে হাসানের ইনসুইংগারে পরাস্ত হন রোহিত। জোড়ালো আবেদনেও আম্পায়ার সাড়া দেননি। রিভিউ নেয় বাংলাদেশ। রিপ্লেতে দেখা যায় বল বেলে আঘাত করেছে। আম্পায়ার্স কলে এ যাত্রা বেঁচে যান রোহিত।
তবে ষষ্ঠ ওভারের প্রথম বলেই নিজের শিকারকে তুলে নেন হাসান।
টস জিতে বোলিংয়ে বাংলাদেশ
চেন্নাই টেস্টে ভাগ্য পরীক্ষায় জিতলেন নাজমুল হোসেন শান্ত। টস জিতে আগে বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। টেস্টের প্রথম দিন নতুন উইকেট, নতুন বল ও চেন্নাইয়ের মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়ার সুবিধা নিতে চেয়েছে বাংলাদেশ।
এই টেস্টে আগে ব্যাটিং নিয়ে বিরল কীর্তি গড়ল বাংলাদেশ। ১৯৩৪ সাল থেকে চেন্নাইতে হওয়া ৩৫ টেস্টে মাত্র একবার টস জিতে আগে বোলিং নিয়েছিল কোন দল। ১৯৮২ সালে ইংল্যান্ড টস জিতে ভারতকে ব্যাটিংয়ে পাঠায়। ৪২ বছর পর চেন্নাইয়ে আগে ব্যাটিং নেওয়ার প্রথা ভাঙলেন শান্ত।
চেন্নাই টেস্টের জন্য লাল মাটির উইকেট তৈরি করেছে ভারত। তাতে পেসার ও স্পিনাররা ভালো বাউন্স পাবেন। নতুন বলে প্রথম দিনের সকালে সেই বাউন্স কাজে লাগাতে চাইছে বাংলাদেশ। টস জয় শান্তদের পরিকল্পনায় সফল হতে সাহায্য করতে পারে।
টস জিতলে ভারতও আগে বোলিং নিতো বলে জানিয়েছেন অধিনায়ক রোহিত শর্মা। কারণ তাদের দলেও ছিলেন তিন সিমার আকাশ দ্বীপ, জসপ্রিত বুমরাহ ও মোহাম্মদ সিরাজ। আর স্পিনার আছেন দুজন রবিচন্দ্রন অশ্বিন ও রবীন্দ্র জাদেজা।
এদিকে বাংলাদেশও তিন সিমার ও দুই স্পিনার নিয়ে খেলছে। পাকিস্তানের বিপক্ষে রাওয়ালপিন্ডি টেস্টের একাদশই রেখেছে সফরকারীরা।
বাংলাদেশ একাদশ : নাজমুল হোসেন শান্ত (অধিনায়ক), জাকির হাসান, সাদমান ইসলাম, মুমিনুল হক, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, লিটন দাস, মেহেদী হাসান মিরাজ, তাসকিন আহমেদ, হাসান মাহমুদ, নাহিদ রানা।
ভারত একাদশ : রোহিত শর্মা (অধিনায়ক), যশ্বসী জয়সওয়াল, শুবমান গিল, বিরাট কোহলি, লোকেশ রাহুল, ঋষভ পন্ত, রবীন্দ্র জাদেজা, রবিচন্দ্রন অশ্বিন, জসপ্রিত বুমরাহ, আকাশ দ্বীপ, মোহাম্মদ সিরাজ।