জুলাইয়ে বাংলাদেশের গণভ্যুত্থানের মোটিফ পোশাকে তুলে ফ্যাশন উইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন ডিজাইনার তাসমিত আফিয়াত আর্নি।
চীনে গত ২৭ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে ১ অক্টোবর শেষ হয় ওয়ার্ল্ড ফ্যাশন উইক, সাংহাই। এতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন এ তরুণ শিল্পী।
২০০১ সাল থেকে যাত্রা শুরু করে ওয়ার্ল্ড ফ্যাশন উইক, সাংহাই। প্রতি বছর দুবার বসে এই আয়োজন। ফ্যাশন উইকের এবারের থিম ছিল ‘সাসটেইনেবল হাইফ্যাশন’।
যারা স্থানীয় উপাদানে তৈরি টেকসই ফ্যাশনকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরেছেন, তাদের নিয়েই এবারের আয়োজন।
এসব মাথায় রেখেই জামদানি, নকশি কাঁথা, গামছা, খাদি, রাজশাহী সিল্কেই আর্নি তৈরি করেন তার সংগ্রহ। এতে জায়গা পেয়েছে রিকশা পেইন্টের নানা মোটিফও।
এই ডিজাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের আভিজাত্যময় টেকসই ফ্যাশনকে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন, বলে জানালেন আর্নি।
বাংলাদেশের রিকশা পেইন্টিংয়ের ঢঙে লেখা ‘মায়ের দোয়া’, গণ আন্দোলনের চেতনায় ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’, কিংবা মুগ্ধর ‘পানি লাগবে’ লেখা তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন সুঁই-সুতার কারুকাজে।
এ প্রসঙ্গে আর্নি বলেন, ”দীর্ঘদিন ধরে আমি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে কাজ করছি। এছাড়া এটা ছিল আমার তৃতীয় আন্তর্জাতিক আসরে অংশগ্রহণ।
“আমার সৃজনশীলতা নিয়ে অবহিত ছিলেন ওয়ার্ল্ড ফ্যাশন এক্সিবিশন সাংহাইয়ের প্রধান নির্বাহী প্যাকো ডি জেমিস। তিনি দেখেছেন আমার সাসটেইনেবল লাক্সারিয়াস ফ্যাশন সংগ্রহ। ফলে তিনি আমার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে আমাকে মেইল করেন এই আসরে অংশগ্রহণ নিতে।”
“তারা আমার সাসটেইনেবল কালেকশন উপস্থাপন করতে চান বলেও জানান। কারণ তারা এই আসরের মাধ্যমে টেকসই বিলাসী ফ্যাশনকে তুলে ধরতে চান।”
এবারের ফ্যাশন উইকে অংশ নিয়েছিলেন ৯০ দেশের ফ্যাশন ডিজাইনাররা।
সেখান থেকে মাত্র ১০ জন বিশেষ ডিজাইনার সুযোগ পান ফ্যাশন শোতে; আর্নি তাদের মধ্যে একজন। সাংহাই ছাড়াও তার সংগ্রহ আরও একাধিক শহরে প্রদর্শিত হয়েছে।
আর্নির কালেকশনের একটি লাইন ছিল ‘মায়ের দোয়া’। এখানে তিনি বাংলাদেশের প্রথাগত রিকশা আর্ট অনুসরণ করে রাজশাহী সিল্ক ও সুতির মিশ্রণে তৈরি কাপড়ে কল্কা ও ফুলেল প্রিন্ট করেন সোনালি রঙে।
খাদি কাপড়ে ডিজিটাল প্রিন্টে করেছেন জুলাই আন্দোলনে শহীদদের মুখের ইলাস্ট্রেশন। এভাবেই তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই এই প্রিন্ট করা কাপড় দিয়ে পোশাক তৈরি করেছেন।
জামদানি দিয়ে তৈরি পোশাকের সঙ্গে পরানো হয়েছে মেটালের পিস। যেটাতে সোনালি রঙে লেখা: ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। জামদানিতে যে সোনালি রং রয়েছে, তাকে সমন্বয় করে এই গয়নাকে অ্যাটাচড জুয়েলারি হিসেবে সংযুক্ত করা হয়েছে।
খাদি খুবই পরিবেশবান্ধব কাপড়। বিশ্বজুড়ে সমাদৃতও। এই খাদি কাপড়ের টপসে জুলাই আন্দোলনের প্রকাশিত সংবাদ প্রিন্ট করা। আর স্কার্টের প্রিন্ট করা হয়েছে আন্দোলনে নিহত মুগ্ধের বলা কথা: ‘পানি লাগবে’।
একাত্তরের শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের শ্রদ্ধা জানাতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার প্রেরণায় পোশাকের নকশা করা হয়েছে। পোশাকে বিদ্রোহী কবির ছবি আর কবিতার লাইন প্রিন্ট করে বসানো হয়েছে।
আর্নি বলেন, সাংহাইয়ে ফ্যাশন উইকের এই প্লাটফর্ম তিনি এবং নির্বাচিত ডিজাইনারদের সঙ্গে ১০ বছরের চুক্তি করেছে।
টেকসই বিলাসী ফ্যাশনের বাজার বিস্তারের জন্য চীনের বিনিয়োগকারীরাও তার কাজে মুগ্ধ হয়ে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে।
“আমার সব পোশাকই ছিল টেকসই অথচ ট্রেন্ডি।”
এজন্য বায়াররাও তার সংগ্রহ পছন্দ করেছে।
চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে ফ্যাশনের মাধ্যমে বন্ধুত্বকের সেতু রচনা করতে আগ্রহী আর্নি।
এই আসরের পর পেরু, জিম্বাবুইয়ে, ইন্দোনেশিয়া এবং একাধিক দেশে প্রদর্শনীর আমন্ত্রণ পেয়েছেন তিনি।
তরুণ এই ফ্যাশন ডিজাইনার বলেন, কাতার ফাউন্ডেশন এবং ইউএস এয়ারফোর্সের পৃষ্ঠপোষকতায় দুটি ফ্যাশন শো তিনি করেছেন কাতারে।
চলতি মাসেই মায়ামিতে তার পরের শো হতে যাচ্ছে।
গত জুনের আর্কা ফ্যাশন উইকে স্ট্রাইড ফ্যাশনওয়্যারের ডিজাইন করা পোশাক খুবই প্রশংসিত হয়। তাসমিত আফিয়াত আর্নি এতে সিগনেচার রিকশা পেইন্ট ইলাস্ট্রেশনকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে পোশাকে ফুটিয়ে তোলেন।
ওই সংগ্রহে ছিল মেয়েদের বিভিন্ন ডিজাইনের মিনি স্কার্ট, ক্রপ টপ, প্যান্ট, রিকশা মোটিফ ইমপ্রিন্টেড গাউন ও ছেলেদের শার্ট, প্যান্ট, কোট, এমনকি লুঙ্গিও। আরও ছিল রিকশা পেইন্ট করা ছোট লোহার ট্রাংক।
ফ্যাশনিস্তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তেই আর্নি নিজস্ব ফ্যাশন ব্র্যান্ড স্ট্রাইড ফ্যাশনওয়্যার যাত্রা শুরু করে ২০১৩ সালে। প্রথম দিকে শুধু মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের জন্য ডিজাইন করলেও এখন সবার জন্যই পোশাক ডিজাইন করছে স্ট্রাইড ফ্যাশনওয়্যার। এই ফ্যাশন হাউজের আছে নিজস্ব মেজারম্যান্ট চার্ট; যে কারণে যে কোনো মাপের পোশাক ক্রেতাদের জন্য বানিয়ে দিতে পারে তারা।
২০১৮ সালে মিস ল্যান্ডস্কেপ ইন্টারন্যাশনালে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী তার নকশার পোশাক পরে ‘সেরা ন্যাশনাল কস্টিউম’ পুরস্কার জেতেন। একই বছর যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ায় অনুষ্ঠিত ‘মিস ইউনিভার্স’ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী শিরীন আক্তার শিলা চূড়ান্ত পর্বে তার ডিজাইনের পোশাক পরে যা বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন।
নিজের বিয়েতেও রিকশা পেইন্টের পোশাক ও ব্যতিক্রমধর্মী গয়নায় নজর কেড়েছেন এই ডিজাইনার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে গ্রাফিক ডিজাইনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন আর্নি। এ কারণেই নিরীক্ষাধর্মী জ্যামিতিক নকশা, উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার দেখা যায় তার ডিজাইনে।