বাংলাদেশি পর্যটকদের অভাবে কয়েক মাস ধরে বড় ধরনের লোকসান গুনছে কলকাতার বিভিন্ন হোটেল ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ের পর আর এমন দশায় পড়তে হয়নি তাদের।
কলকাতার কেন্দ্রে দুই বর্গকিলোমিটারজুড়ে রয়েছে শতাধিক হোটেল এবং তিন হাজারের বেশি দোকান। পর্যটকনির্ভর ওই বাণিজ্যিক এলাকা মিনি বাংলাদেশ নামে পরিচিত। সেই এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যই মূলত বেশি সংকটে পড়েছে।
গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে ভারতীয় ভিসা কার্যক্রমের ছন্দপতন ঘটে। সীমিত পরিসরে এই কার্যক্রম শুরু হলেও ভারত জানিয়ে দিয়েছে যে, চিকিৎসার জন্য ও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া অন্যান্য ভিসা তারা ইস্যু করবে না।
এর ফলে বাংলাদেশিদের কলকাতা ভ্রমণ ব্যাপক হারে কমে যায়, এতে সেখানকার মিনি বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্য ধস নামে।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রেতার অভাবে কলকাতার মিনি বাংলাদেশ এলাকার বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড প্রায় ৭০ শতাংশ কমে গেছে। বর্তমানে মারকুইস স্ট্রিট, সাডার স্ট্রিট, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, রফি আহমেদ কিদওয়াই রোড, রয়ড স্ট্রিট এবং এলিয়ট রোডের ১২০টি হোটেলের মাত্র ১০-১৫ শতাংশ কক্ষে অতিথি আছে। অথচ গত বছর এই সময়ে হোটেলগুলোর ৮০ শতাংশ কক্ষ ভরা ছিল।
কলকাতা হোটেল ও রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মনোতোষ সরকার বলেন, “জুলাই থেকে মারকুইস স্ট্রিটে আমার হোটেলের ৩০টি কক্ষের মধ্যে মাত্র চার বা পাঁচটি কক্ষ বাংলাদেশি অতিথিদের দখলে আছে। ছাত্রদের আন্দোলন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের আগে সেখানে ২৬-২৮টি কক্ষেই বাংলাদেশি অতিথিরা ছিলেন।”
ছোট কয়েকটি হোটেল সাময়িকভাবে বন্ধও হয়ে গেছে, কারণ তারা মাত্র এক বা দুইজনের বেশি অতিথি পাচ্ছিল না।
মনোতোষ সরকার বলেন, “২০২১ সালে করোনা মহামারীর সময় লকডাউনের কারণে আমরা যে অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলাম, এখন সেরকম পরিস্থিতিই তৈরি হয়েছে।”
প্রায় নির্জন একটি হোটেলে অবস্থান করা চট্টগ্রামের রেজেন বিশ্বাস বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর ভারত সরকারের নতুন ভিসা নিষেধাজ্ঞার কারণে কলকাতায় বাংলাদেশিদের আগমন ব্যাপকহারে কমে গেছে। আগে এই হোটেলের কক্ষগুলোও বাংলাদেশিদের আনাগোনা এবং আড্ডায় সরগরম থাকত।
রেজেন বিশ্বাস বলেন, “আমার আগে থেকেই ভিসা ছিল, তাই আমি কলকাতায় আসত পেরেছি। কিন্তু এখন যারা আবেদন করছেন, তাদের জরুরি চিকিৎসাগত প্রয়োজন ছাড়া ভিসা দেওয়া হচ্ছে না। সম্ভবত বাংলাদেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে, যা ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে এত কঠোর হতে বাধ্য করেছে। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে বর্তমান ভিসাগুলোর বৈধতা শেষ হয়ে গেলে এখন যে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ অতিথি পাচ্ছে কলতাকাতা, তাও আর পাবে না।”
নিউমার্কেটের দোকানদাররা, যারা সাধারণত কলকাতার বিভিন্ন অংশের তুলনায় বাংলাদেশ থেকে বেশি ক্রেতা পান, তারাও হতাশ। তারা আশঙ্কা করছেন, বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা চলতে থাকলে এবং ভারতও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে থাকলে কলকাতার ওই অঞ্চলের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে।
নিউ মার্কেটের চকো নাট নামের একটি দোকান কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের বিক্রি দিনে ৩৫ হাজার থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা কমে গেছে। তারা চকলেট, বাদাম, মশলা ও প্রসাধনী বিক্রি করে এবং একচেটিয়াভাবে বাংলাদেশি গ্রাহকদের জন্য সরবরাহ করত।
দোকানটির মালিক মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, “শুধু মেডিকেল ভিসায় আসা কয়েকজন গ্রাহকই এখন আমাদের দোকানে আসেন। কিন্তু ভ্রমণকারী বা যারা নিউমার্কেট থেকে পণ্য কিনে ঢাকায় বিক্রি করতেন, তাদের আগমন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।”
১২৪ বছরের পুরনো প্রসাধনীর দোকান রয়্যাল স্টোরের পঞ্চম প্রজন্মের মালিক অজয় শ বলেন, “পরিস্থিতি শুধু আমাদের দোকানের জন্য নয়, পুরো বাজারের জন্যই ভয়াবহ। ২০০৮-০৯ সালের দিকে স্থানীয় গ্রাহক কমে যাওয়ায় এই বাজারের চেহারা বদলে গিয়েছিল।
“এরপর থেকে নিউমার্কেট বাংলাদেশিদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং প্রায় সব দোকানই তাদের চাহিদা ও রুচি পূরণ করতে শুরু করে। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট এবং ভিসা ইস্যুতে গ্রাহকের সংখ্যা কমে গেছে।”
“আমরা আগে প্রতিদিন ১৫ হাজার টাকা করে কেনাকাটা করা ২৫-৩০ জন বাংলাদেশি ক্রেতা পেতাম। কিন্তু এখন আমরা দিনে মাত্র পাঁচজন বাংলাদেশি ক্রেতা পাচ্ছি। আর তাদের কেনাকাটার হারও অনেক কমে গেছে। এখন একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ মাত্র ১০ হাজার টাকা খরচ করেন” যোগ করেন অজয়।