চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোটর দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। তবে অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক মূল্যস্ফীতির পারদ ঊর্ধ্বমুখীই থাকবে বলে জানিয়েছে ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থাটি।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক (এডিও) জুলাই ২০২৪ প্রতিবেদনে এই পূর্বাভাস দিয়েছে এডিবি। বুধবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস সামান্য কমানো হয়েছে। আগে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে বলে আভাস দেওয়া হয়েছিল। এখন তা সংশোধন করে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।
মূলত শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির ধীরগতির কারণে এই সংশোধন আনা হয়েছে বলে জানিয়েছে এডিবি।
গত ১১ এপ্রিল প্রকাশিত ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক, এপ্রিল ২০২৪’ প্রতিবেদনে ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের ৬ দশমিক ১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা বেড়ে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে বলা হয়েছিল।
সম্প্রতি বিশ্ব আর্থিক খাতের মোড়ল সংস্থা বিশ্বব্যাংক আভাস দেয়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের ৫ দশমিক ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে। আর ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি খানিকটা বেড়ে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে।
গত ১২ জুলাই প্রকাশিত ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই পূর্বাভাস দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক।
বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ অর্জিত হবে বলে লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সাত মাসের (জুলাই-জানুয়ারি) হিসাব কষে বলেছে, গত অর্থবছরে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।
আড়াই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এখনও পড়ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। মধ্যপাচ্যের যুদ্ধের ধাক্কাও কমবেশি লাগছে। ডলারের দর বেড়েই চলেছে; ৮৬ টাকার ডলার এখন ১১৮ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ডলারের এই উল্লম্ফনের নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতির সব খাতেই পড়ছে। দিন যতো যাচ্ছে, সংকট ততই বাড়ছে।
এমন একটি কঠিন পরিস্থিতিতে গত ৬ জুন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। ৩০ জুন সেই বাজেট পাস হয়েছে।
এই বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭৫ অর্জিত হবে বলে লক্ষ্য ধরেছেন অর্থমন্ত্রী। আর সেই লক্ষ্য অনুযায়ী এবার জিডিপির মোট আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ লাখ ২৮ হাজার ৬৫ কোটি টাকা।
আওয়ামী লীগ সরকার তাদের গৌরবের অর্জন হিসেবে জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে বরাবরই দেখিয়ে আসছে।
করোনা মহামারির আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ধারাবাহিক অগ্রগতির পথ ধরে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ (ভিত্তি বছর পরিবর্তনের পর যা ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ) প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বাংলাদেশ, যা ছিল দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি।
তার পরের বছর কোভিড মহামারির ধাক্কায় তা ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে নেমে আসে। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা আবার বেড়ে ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশে উঠেছিল। পরের বছর ৭ শতাংশ ছাড়ালেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে আবার ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশে নেমে আসে।
২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও তছনছ হয়ে যায়; পাল্টে যায় সব হিসাব-নিকাশ। তার পরও ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে আগেরবারের (২০১৯-২০) মতো ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির বড় লক্ষ্য ধরেছিল সরকার।
করোনার ধাক্কায় ওই অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে নেমে আসে, যা ছিল তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম।
মহামারির কারণে বিশ্বের প্রায় সব দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছিল। কোনও কোনও দেশে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলেও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল বাংলাদেশ।
মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী থাকবে
বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মতো নতুন অর্থবছরেও মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী থাকবে বলে এডিবি প্রকাশিত এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক (এডিও) জুলাই ২০২৪ প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতি কমাতে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়ার পরও গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১১ মাসে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের (ডাবল ডিজিট) কাছাকাছি ছিল। খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে আগামী দিনগুলোতেও এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকতে পারে।
বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। বাজারে সব ধরনের জিনিপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় পরে তা সংশোধন করে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়। তবে সেই লক্ষ্যও পূরণ হয়নি।
৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ গড় মূল্যস্ফীতি নিয়ে ৩০ জুন শেষ হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থবছর। আগের অর্থবছরে (২০২২-২৩) এই হার ছিল ৯ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত ৭ জুলাই মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছরের শেষ মাস জুনে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ, যা আগের মে মাসের চেয়ে কিছুটা কম; মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
জুনে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৪২ শতাংশ। খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ১৫ শতাংশ। মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ১৯ শতাংশ।
জুনে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ সার্বিক মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো– গত বছরের জুন মাসে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, এই বছরের জুনে সেই পণ্য বা সেবা পেতে ১০৯ টাকা ৭২ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
গত ৬ জুন বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, “মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে এবং রাজস্বনীতিতেও সহায়ক নীতিকৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিতে ফ্যামিলি কার্ড, ওএমএস ইত্যাদি কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।”
তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, সরকারের আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন ছিল। পদক্ষেপ নিতে দেরি করায় এখন মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে বেগ পেতে হচ্ছে।
বিদায়ী অর্থবছরের মতো নতুন অর্থবছরেও মূল্যস্ফীতি বাজেটের লক্ষ্যের চেয়ে বেশি থাকবে বলে বাজেট ঘোষণার পর থেকেই বলে আসছেন অর্থনীতিবিদরা।