গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ভাংচুরের পাশাপাশি আগুন দেওয়া হয়েছিল ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু ভবনে; তারপর ধ্বংসের চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কালের সাক্ষী বাড়িটি। ঠিক ছয় মাস পর ঘোষণা দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো সেই বাড়ি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনা বুধবার ভার্চুয়াল এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেবেন বলে আওয়ামী লীগ জানানোর পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা ‘বুলডোজার মিছিল’র কর্মসূচি ঘোষণা করে।
রাত ৯টায় যখন শেখ হাসিনা ভাষণ শুরু করেন, তার আগে থেকেই সেখানে জড়ো হয়েছিল অভ্যুত্থানের সমর্থকরা। ৯টার দিকে শুরু হয় বাড়িটি ভাঙা; কয়েক ঘণ্টা পর সেখানে আনা হয় এক্সকেভেটর, ক্রেইন; রাতভর চলে ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়ার কাজ।
বৃহস্পতিবার সকাল নাগাদ দেখা যায়, ঐতিহাসিক এই বাড়ির অনেকটাই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। উল্লাস ধ্বনির মধ্যে চলছে ভাঙার কাজ।
যারা এই বাড়ি ভাঙায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন; তারা বলেছেন, ‘ফ্যাসিবাদের শেষ চিহ্ন’ মুছে দিতে তাদের এই কর্মসূচি। তবে অভ্যুত্থানের পক্ষ শক্তির অনেকে এই বাড়ি ভাঙার বিরোধিতায় সরব হয়েছে। তারা বলছে, এটা বাড়ি ভাঙার পেছনে রয়েছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উসকানি।
ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের এই বাড়িটির সঙ্গে শুধু বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিই জড়িত, তা নয়; এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম স্মারক।
৬৬ এর ছয় দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচনসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের প্রতিটি পর্বে জড়িয়ে এই বাড়ি; এই বাড়ি থেকেই এসেছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই বাড়িতেই সপরিবারে হত্যা করা হয় স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ককে। তারপর দেশে গণতন্ত্র ফেরার লড়াইয়ের সাক্ষী হয়েও থেকেছে এই বাড়ি।
১৯৯৪ সালে এই বাড়িটি জাদুঘরে রূপান্তরিত করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তখন এটি বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর নতুন স্থাপনা নির্মাণ করে জাদুঘরটি সম্প্রসারিত করা হয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসন অবসানের পর ক্ষোভ গিয়ে পড়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতেও। সেদিনই হামলা, ভাংচুর চলে এই বাড়িতে। তারপর অনেকটা পরিত্যক্ত হয়েই ছিল বাড়িটি।
অভ্যুত্থানের ছয় মাস পূর্ণ হওয়ার দিন বুধবার আওয়ামী লীগ ঘোষণা দেয়, ভারতে থাকা শেখ হাসিনার রাত ৯টায় লাইভে এসে ভাষণ দেবেন। তখনই প্রতিক্রিয়া জানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
প্ল্যাটফর্মটির আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ এক ফেইসবুক পোস্টে লেখেন- “হাসিনাকে বক্তব্য প্রকাশের সুযোগ দেওয়াকে বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদ-বিরোধী জনগণের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধ হিসেবে দেখি।” এরপর সন্ধ্যায় তিনি আবার লেখেন, “আজ রাতে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমি মুক্ত হবে।”
এরমধ্যে সোশাল মিডিয়ায় ‘বুলডোজার মিছিল’র কার্ড ছড়িয়ে পড়ে; সেখানে বঙ্গবন্ধু ভবন গুঁড়িয়ে দিতে সবাইকে ধানমণ্ডিতে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
রাত ৮টার পরপরই ভবনটিতে ঢুকে শুরু হয় ভাংচুর; ভেঙে পড়া জানালা-দরজার কাঠ নিয়ে যেতেও দেখা যায় কাউকে কাউকে।
শুরুতে সেখানে কয়েকশ লোক ছিল, রাতে সংখ্যাটি বাড়তে বাড়তে কয়েক হাজারে পৌঁছায়। অনেকে আবার কৌতূহল ভরে গিয়ে মোবাইলে ছবি-ভিডিও নিচ্ছিলেন।
কয়েক জজন পুলিশ সেখানে থাকলেও তারা কোনও তৎপরতা দেখায়নি। এক পর্যায়ে একদল সেনা সদস্য সেখানে গেলেও তারাও ছিল তৎপরতাহীন।
ভাঙাভাঙি আর আগুন দেওয়ার মধ্যে রাত সাড়ে ১০টার পর সেখানে নেওয়া হয় বুলডোজার। উল্লাস ধ্বনির মধ্যে শুরু হয় বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার কাজ।
সকালে দেখা যায়, তিন তলা মূল ভবনের সামনের অংশ পুরোটাই মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাকি অংশ গুঁড়িয়ে দেওয়ার কাজ চলছে।
তবে সকালে সেখানে উপস্থিত মানুষের সংখ্যা রাতের তুলনায় অনেক কম দেখা গেছে।
পাকিস্তান আমলে ১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধু যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী থাকা অবস্থায় ধানমণ্ডির এই ১ বিঘা জমি তখনকার ৬ হাজার টাকায় তাকে বরাদ্দ দেয় সরকার। সেই জমিতে দুই কক্ষের একটি একতলা ভবন করে ১৯৬১ সালে পরিবার নিয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। তখন একতলা বাড়ির দুটি কক্ষ মিলিয়ে তার পুরো পরিবার থাকত।
১৯৬৬ সালে দ্বিতীয় তলা নির্মাণ হয়। নিচতলার কক্ষটি বঙ্গবন্ধু গ্রন্থাগার হিসাবে ব্যবহার করতেন। ছোট একটি কক্ষ ব্যবহার হতো ড্রইং রুম হিসাবে। নিচ তলায় আর ছিল একটি রান্নাঘর।
বিশাল এই রাজনীতিকের এই ছোট বাড়িতে যাননি, তখনকার রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন মানুষ খুব কমই আছে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু এই বাড়ি থেকেই গিয়েছিলেন। ৭ মার্চের পর সম্ভাব্য স্বাধীন বাংলাদেশ পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই বাড়িটিই। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এই বাড়ি থেকেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তার আগে আগে এই বাড়ি থেকেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
মুক্তিযদ্ধের পুরোটা সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাড়িটি দখল করে রেখেছিল। বঙ্গবন্ধু পরিবারকে ধানমণ্ডিরই অন্য একটি বাড়িতে বন্দি রেখেছিল। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর পরিবার নিয়ে আবার এই বাড়িতে ওঠেন। প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি সরকারি বাড়িতে ওঠেননি।
ধানমণ্ডির পুরনো ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িটির কাগজে কলমে নম্বর এখন ১০, সড়ক নম্বরও বদলে হয়েছে ১১। তবে এখনও সবাই ৩২ নম্বর বললেই বুঝে নেয় বঙ্গবন্ধুর বাড়ি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে এই বাড়িতেই সেনাবাহিনীর একদল সদস্য ও কর্মকর্তা ঢুকে সপরিবারে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুকে। বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফিরলেও জিয়াউর রহমানের শাসনকালে প্রথমে বাড়িটিতে ঢুকতে পারেননি। কারণ ঋণ নিয়ে বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু; সেই কিস্তি পরিশোধ না হওয়ায় বাড়িটি অধিগ্রহণ করেছিল সামরিক সরকার। সেই ঋণ পরিশোধের পর ওই বছরই বাড়ির মালিকানা ফিরে পান শেখ হাসিনা।
এরপর ওই বাড়িটি রাজনৈতিক কার্যালয় হিসাবেই ব্যবহার করতেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি থাকতেন স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার পাওয়া সরকারি বাড়িতে।
৩২ নম্বরের বাড়িটি ফিরে পাওয়ার পর শেখ হাসিনা একে জাদুঘরে রূপান্তরিত করার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে বাড়িটি জাদুঘর হিসাবে যাত্রা শুরু করে। তখনই এটি বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২০১১ সালে নতুন স্থাপনা নির্মাণ করে জাদুঘরটি সম্প্রসারিত করা হয়।
বুধবার যে ভাষণ দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় বাড়িটিতে হামলা হয়েছে, সেই ভাষণে তা নিয়েও কথা বলেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “বাড়িটার কী অপরাধ? ওই বাড়িটাকে কেন এত ভয়? আমি দেশের মানুষের কাছে আজ বিচার চাই।
“দেশের স্বাধীনতা কয়েকজন বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলবে, এই শক্তি তাদের হয়নি। তারা একটি দালান ভেঙে ফেলতে পারবে, কিন্তু ইতিহাস মুছতে পারবে না। ইতিহাস কিন্তু প্রতিশোধ নেয়।”