চারজনের প্রাণহানির পর নিজেদের পুরনো এবং ঝুঁকিপূর্ণ ট্যাংকারে জ্বালানি তেল পরিবহনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এল বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি)।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) সরকারিভাবে যে জ্বালানি তেল আনে, তা কুতুবদিয়া সাগর এলাকা থেকে পতেঙ্গা ডিপো পর্যন্ত পৌঁছতে ‘বাংলার জ্যোতি’ ও ‘বাংলার সৌরভ’ জাহাজ দুটি ব্যবহৃত হতো। কিন্তু জাহাজগুলো ছিল ৩৮ বছরের পুরনো; ফলে বিশেষ অনুমোদন নিয়ে শর্তসাপেক্ষেই এই তেল পরিবহন করছিল বিএসসি।
এর আগে তেল পরিবহন করতে গিয়ে একাধিক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল। সর্বশেষ ৩০ সেপ্টেম্বর আগুন লাগে ‘বাংলার জ্যোতি’ জাহাজে; যখন জাহাজটি পতেঙ্গা জেটিতে এসে তেল খালাস করছিল। এই সময় বিস্ফোরণে তিনজন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।
এরপর ৪ অক্টোবর রাতে সাগরে থাকা ‘বাংলার সৌরভ’এ আগুন লাগে। নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড মিলিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলেও আগুন থেকে বাঁচতে লাফ দিয়ে একজন মারা যান।
পরপর দুটি জাহাজে আগুন লাগার ঘটনাকে বিএসসি নাশকতা হিসাবেই দেখছিল। গঠন করেছিল তদন্ত কমিটি। সেই কমিটির প্রতিবেদন এখনও আসেনি। তার মধ্যেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে বিএসসি।
বিএসসি ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কমডোর মাহমুদুল মালেক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বাংলার সৌরভ ও বাংলার জ্যোতি আর সমুদ্রে জ্বালানি তেল পরিবহনে কাজ করবে না। দুটি জাহাজই পুরাতন জাহাজ ভাঙ্গার ইয়ার্ডে ভেঙে ফেলা হবে। এজন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি চাওয়া হয়েছে।”
নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন রবিবার সকালে পতেঙ্গা ডিপো পরিদর্শনের পর সাংবাদিকদের বলেন, “দুর্ঘটনা ঘটার পর একটি জাহাজ বিদেশ থেকে ভাড়ায় আনা হচ্ছে। সেটি সোমবারই চট্টগ্রাম পৌঁছবে। আপাতত সেই ট্যাংকার জাহাজ দিয়েই জ্বালানি তেল বহির্নোঙর থেকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ডিপো পর্যন্ত আনা হবে।”
বিএসসির এমডি মালেক বলেন, ৩০ হাজার টন সক্ষমতার একটি ট্যাংকার ভাড়ায় বিদেশ থেকে আনা হচ্ছে।
“এখন আমাদের দুটি ট্যাংকার দিয়ে মোট ২০ হাজার টন পরিবহন করা যেত। ভাড়া করা জাহাজে একসাথেই ৩০ হাজার টন পরিবহন করা যাবে। ফলে আগের চেয়ে পরিবহন দ্রুত হবে বলে আশা করছি।”
জাহাজ দুটির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্নে তিনি বলেন, “মন্ত্রনালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তারা রিপোর্ট দিলেই সিদ্ধান্ত হবে।”
এই জাহাজ দুটি ডেনমার্ক থেকে ১৯৮৭ সালে কেনা হয়েছিল।
পুরনো জাহাজে তেল পরিবহন কেন হচ্ছিল?
পুরনো জাহাজ দুটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত আগেও একবার নিয়েছিল বিএসসি। কিন্তু পরে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছিল। জাহাজ যদি ভাড়া করতেই হয় তাহলে আগে কেন করা হয়নি, সেই প্রশ্নও উঠেছে।
মেরিনার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দুটি পৃথক ঘটনায় চারজনের মৃত্যুর পর জাহাজ দুটি পরিত্যক্ত হচ্ছে। এক প্রকার মানুষের জীবনের বিনিময়ে জাহাজ দুটি ফেইজ আউট করা হচ্ছে। এটি খুবই দুঃখজনক।”
বিএসসি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুলত পুরনো এ দুই জাহাজে শুধু মেইনটেন্যান্স করতেই বছরে খরচ হয় ৩০ কোটি টাকা। এই বিপুল অর্থ খরচ করতেই বিএসসির এক শ্রেণীর কর্মকর্তার ব্যক্তিগত লাভ হতো। তাই ঝুঁকি বিবেচনায় একবছর আগে জাহাজ দুটি স্ক্র্যাপ বা ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত হলেও বিএসসি সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।
বিএসসির জাহাজে কাজ করেছেন, এমন একজন মাস্টার মেরিনার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “২৫ বছরের পুরনো জাহাজ দিয়ে তো তেল পরিবহন করা যায় না। এখন ৩৮ বছরের পুরনো জাহাজ বিশেষ অনুমতি নিয়ে চালাচ্ছিল; ফলে দুর্ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক কিছুই নয়। কিন্তু তারা সেটিকে পাত্তা দেয়নি।”
তিনি আরও বললেন, বাংলার জ্যোতিতে ৩০ হাজার টন তেল পরিবহন করা যায়, কিন্তু ঝুঁকি বিবেচনায় মাত্র ১০ হাজার টন পরিবহন হতো। আর জাহাজটি এতটাই ঝুঁকিতে ছিল সেটি বাংলাদেশ সুমদ্রসীমা পার হওয়ার অনুমতি পর্যন্ত ছিল না। মুলত মুনাফা হাতছাড়া করতে না চাওয়াই প্রাণহানির মূল কারণ। প্রশ্ন হচ্ছে, জাহাজ এখন ভাড়া করতে পারলে আগে কেন করেননি।”
২০১৭ সাল থেকে গত সাত বছরে ‘বাংলার জ্যোতি’ ও ‘বাংলার সৌরভ’ এই দুই জাহাজ মেরামত করতেই ২১০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এই টাকায় একটি নতুন জাহাজই কিনতে পারত বিএসসি।
বিএসসির এমডি মালেক বলছেন, সরকারের জ্বালানি তেল পরিবহন যাতে ঝুঁকিতে না পড়ে, সেজন্যই বিশেষ অনুমতি নিয়েই পুরনো জাহাজ দুটি চলছিল।
পাইপলাইনে মহেশখালী থেকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা পর্যন্ত জ্বালানি তেল আনার একটি পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। সেই পাইপলাইন গত বছর পরীক্ষামূলকভাবে চালুও হয়েছিল। তবে ত্রুটির কারণে তেল পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। পাইপলাইন চালু হলে জাহাজের প্রয়োজন আর থাকছে না বলে জানান মালেক।
নাশকতা?
‘বাংলার সৌরভ’ জাহাজে শনিবার অগ্নিকাণ্ড ‘নাশকতা’ হতে পারে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন বিএসসির এমডি কমডোর মালেক।
তিনি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, “বাংলার সৌরভ জাহাজের সম্মুখ অংশ থেকে একই সঙ্গে চার জায়গায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। অথচ জাহাজে কোনও বিস্ফোরণ হয়নি।
“যখন জাহাজে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে, ঠিক একইসময়ে পাশ দিয়ে একটি স্পিডবোটও যায়। যেহেতু গ্যাস ফর্ম কিংবা অন্য কোনও কারণে আগুন লাগার ঘটেনি। তাই আমরা ধারণা করছি, এটি নাশকতামূলক অগ্নিকাণ্ড হতে পারে।”
নাশকতার অভিযোগের বিষয়ে নৌ পরিবহন উপদেষ্টা সাখাওয়াত সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসায় বলেন, “যেহেতু তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, তাই এবিষয়ে মন্তব্য করাটা সমীচীন হবে না।”
বিএসসির এমডি মালেকও নাশকতার সন্দেহ নিয়ে নতুন করে কিছু বলতে চাননি।