ঋণের সুদহার বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ায় মে মাস থেকে ব্যাংকগুলোই হার নির্ধারণ করছে। এতে ঋণের সুদহার বেড়ে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এরই মধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউসহ রাজনৈতিক পরিস্থিতি হঠাৎ করে অস্থির হয়ে ওঠায় চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়।
সব মিলিয়ে জুলাইয়ে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতের ঋণের স্থিতি আগের মাস জুনের স্থিতির তুলনায় শূন্য দশমিক ৩২ শতাংশ কমে যায়। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণে ঋণাত্নক প্রবৃদ্ধি হয়।
এই তথ্য ইঙ্গিত করছে, জুলাইয়ে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ কমায় দেশে বিনিয়োগের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর ব্যবসায়ও স্থবিরতা নেমেছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে বেসরকারি খাতে ঋণের স্থিতির পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৪১ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। এর পরের মাস জুলাইয়ে এই ঋণ স্থিতি কমে ১৬ লাখ ৩৫ হাজার ৯১৫ কোটি টাকায় নেমে আসে।
তবে কেবল জুলাই মাসেই নয়, আগস্ট মাসেও ঋণ বিতরণে বড় ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছিল বলে জানিয়েছেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, জুলাই-আগস্ট দুই মাসে স্থবিরতা ছিল। এখনও সেই স্থবিরতা কাটেনি। গার্মেন্ট আমাদের বড় ক্লায়েন্ট। সেখানে শিপমেন্ট বন্ধ ছিল, পণ্য পাঠাতে দেরি হয়েছে। সব মিলিয়ে আমাদের এ খাতে ঋণ বিতরণ কমে এসেছে। তাছাড়া উৎপাদন খাতেও বিনিয়োগ আসছে না। সবাই অপেক্ষা করছে পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক হওয়ার।
কিন্তু এভাবে ঋণ বিতরণ কমে গেলে ব্যাংকগুলো কত দিন চলতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন ঢাকা ও ব্র্যাক ব্যাংকের এমডির দায়িত্ব পালন করে আসা এই শীর্ষ নির্বাহী।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “তিন মাস হতে যাচ্ছে। এভাবে চললে আমাদের ভালো ব্যাংকও ভালো থাকবে না। দেখা যাক। কী হয়। এখন সেনাবাহিনী যেহেতু দুই মাস ম্যাজিস্ট্রেসি দায়িত্ব পেয়েছে, এই সময় গেলে হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হবে। তবে এটা ঠিক, এই বছরের প্রথম ছয় মাসে আমাদের ব্যবসা যা হয়েছে তার থেকে বেশি এ বছর আর হবে না।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুলাইয়ের তুলনায় চলতি বছরের জুলাইয়ে বেসরকারি ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে বেসরকারি খাতের ঋণের স্থিতি ছিল ১৪ লাখ ৮৫ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। আগের মাস জুনে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
গত ৯ মে সুদহার নির্ধারণের সব ধরনের কলাকৌশল তুলে দিয়ে তা ‘বাজারভিত্তিক’ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মাধ্যমে নিজেদের সুবিধামতো সুদহার নির্ধারণের অধিকার ফিরে পায় ব্যাংকগুলো। ফলে সব ধরনের ঋণের ওপর সুদের হার বেড়ে গেছে।
ঋণের সুদহার ‘সম্পূর্ণরূপে বাজারভিত্তিক’ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার নির্ধারণের সর্বশেষ পদ্ধতি স্মার্ট (সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল) বিলুপ্ত করে। ৯ মাস চালু ছিল স্মার্টভিত্তিক সুদ নির্ধারণ।
২০২০ সালের এপ্রিলের আগে ব্যাংকঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক ছিল। তবে এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে এই হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে বেঁধে দিয়েছিল। ওই বছরের এপ্রিল থেকে সরকার ঋণ ও আমানতে নয়-ছয় হারের সীমা দিয়ে দেয়।
এদিকে সুদের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়ায় ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণে আগ্রহ দেখালেও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কারণে সেই আগ্রহে ভাটা পড়ে।
১ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। ওই মাসের শুরু থেকেই বিভিন্ন স্থানে অবরোধ কর্মসূচি পালন করায় রাজধানীতে যানজট লেগে থাকতে দেখা যায়।
৮ জুলাই থেকে দেশব্যাপী ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির ডাক দেয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। ওই আন্দোলন সহিংসতায় জড়ায় ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার মধ্যে দিয়ে।
১৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে ৬ জন শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। ১৮ জুলাই পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর রূপ নিলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ধীরে ধীরে সকল প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এসময় কারফিউ ঘোষণা করা হয়। ২৪ জুলাই থেকে অফিস খুললেও বিক্ষোভসহ বিভিন্ন কর্মসূচির কারণে ওই মাসে ব্যাংকের লেনদেন প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে।
যার ফলশ্রুতিতেই জুলাই মাসে বেসরকারি খাতের ঋণে শূন্য দশমিক ৩২ শতাংশ ঋণাত্নক প্রবৃদ্ধি দেখা দেয়।
ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এরপর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে আর্থিক খাতসহ অনেকগুলো সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তবে ব্যাংক খাত থেকে অনিয়মের মাধ্যমে টাকা বের করার কয়েকটি ঘটনায় ব্যাংক খাত কিছুটা নাজুক হয়ে পড়েছিল। এখন কয়েকটি ব্যাংকের গ্রাহকরা আতঙ্কে টাকা তুলে নিতে শুরু করায় সব ব্যাংক টাকার সংকটে পড়েছে। সেই ব্যাংকগুলো এখন ঋণ বিতরণের কথা ভাবতেও পারছে না।
এদিকে বেসরকারি খাতে ঋণ না বাড়লে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান কমে আসার শঙ্কা থাকে। এমন শঙ্কার মধ্যে বিনিয়োগ পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) পরিচালক অধ্যাপক শাহ মো. আহসান হাবীব।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিনিয়োগের উপযুক্ত সময় এখনও তৈরি হয়নি। এক ধরনের অনিশ্চয়তা আছে। পণ্য উৎপাদন করে ফেলে রাখলে তো উৎপাদক বাঁচবে না। এ কারণেই কোনও উৎপাদক এখন ঋণ নিয়ে ব্যবসা করবে না। আবার ব্যাংকও এই মুহূর্তে অনেক বেশি সতর্কতার সঙ্গে ঋণ বিতরণের চেষ্টা করবে। কারণ আবার কোনও অনিশ্চয়তা তৈরি হলে ঋণের টাকা আদায় করা কঠিন হবে।”
বর্তমানে বেসরকারি খাতে ঋণের ‘ডিমান্ড সাইড’ ও ‘সাপ্লাই সাইড’ উভয় দিক দিয়েই অনাগ্রহ আছে বলে মনে করছেন বিআইবিএম’র এই অধ্যাপক।
বেসরকারি খাতের ঋণের এমন ঋণাত্নক প্রবৃদ্ধি এর আগে দেখা গিয়েছিল করোনা মহামারির শুরুর দিকে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে চীনের উহান প্রদেশে নোভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের প্রভাব দেখা যায়। ওই ঘটনার পরপরই করোনা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে দেশটির সরকার। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে দেশের ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণ কমে যায়।
ওই বছরের জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতে ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ১০ লাখ ৫২ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকায়। এর আগের মাস ডিসেম্বরে (২০১৯) বেসরকারি খাতে বিতরণ করা ঋণের স্থিতি ছিল ১০ লাখ ৫৩ হাজার ১৫১ কোটি টাকা। সেই হিসেবে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে বেসরকারি খাতের ঋণের স্থিতি শূন্য দশমিক ০৬ শতাংশ কমে যায়।
ওই বছর মার্চে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়লে দফায় দফায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। তবে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ করায় বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়তে থাকে।