একটা প্রশ্ন রেখে শুরু করা যাক, কিলিয়ান এমবাপ্পেকে কি আর দরকার আছে রিয়াল মাদ্রিদের?
শিরোপা অবশ্যই মূখ্য বিষয়। তবে কোনো কোনো ম্যাচ ট্রফির চেয়ে বড়, অহংয়ের লড়াই। এল ক্লাসিকো ঠিক তাই। আর সেই ম্যাচ দিয়ে যদি শিরোপা আসে, তাহলে তো কথাই নেই। রিয়াল মাদ্রিদ দুটোই পেল। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপক্ষে মর্যাদার লড়াই জিতে ঘরে তুলল স্প্যানিশ সুপার কাপের ১৩তম শিরোপা।
সৌদি আরবে মরুর বুকে মাদ্রিদের আভিজাত্য ফুটে উঠল ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের হ্যাটট্রিকে। ৪-১ গোলের জয়ে বার্সেলোনার অহং গুঁড়িয়ে ওড়াল বিজয় নিশান। এ নিয়ে ৯ মাসের মধ্যে দুইবার কাতালানদের জালে জড়াল ৪ গোল। অথচ গোল উৎসবের এই চিত্র একসময় ছিল উল্টো। বার্সেলোনার দাপটে ২০১৫ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত রিয়াল ঘরের মাঠেই তিনবার অন্তত ৪ গোল হজম করেছে!
সময় বদলে গেছে। বদলে গেছে রিয়াল। গত বছরের এপ্রিলে ন্যু ক্যাম্পে ৪-০ গোলের জয়ের পর এবার স্প্যানিশ সুপার কাপের ফাইনালে বড় ব্যবধানে হারাল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের।
বার্সেলোনার ভুল কোথায়?
গত মৌসুমে ফেরা যাক। তিন মৌসুম পর লা লিগার শিরোপা ফিরেছিল ন্যু ক্যাম্পে। জাভির ছোঁয়ায় হয়েছিল নতুন শুরু। বার্সেলোনার এই সাফল্য-যাত্রায় বেশিরভাগ জয়েই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল রক্ষণভাগের। তাদের কার্যকর অফসাইড-ফাঁদে পড়েছিল বেশিরভাগ দল। চলতি মৌসুমেও একই কাজ করছে বার্সেলোনা। রিয়ালের বিপক্ষেও আঁকে একই কৌশল। আর এখানেই ভুলটা করে বসেন জাভি।
মাদ্রিদের ক্লাবের প্রথম দুটো গোলই হয়েছে বার্সার অফসাইড-ফাঁদ তৈরি করার প্রবণতা থেকে। গোললাইন থেকে ডিফেন্স লাইনের দূরত্ব ছিল অনেক। প্রথম গোলে যেমন জুলেস কুন্দে প্রায় মাঝমাঠের কাছাকাছি দূরত্বে ছিলেন। জুড বেলিংহাম যখন বল বাড়ালেন ভিনিসিয়ুসের দিকে, কুন্দে গেলেন ভুল পথে। বল বেরিয়ে এসে বিশাল গ্যাপের সুযোগ কাজে লাগিয়ে সপ্তম মিনিটেই রিয়ালকে এগিয়ে নিলেন ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার।
অফসাইড-ফাঁদ তৈরি করতে গেলে বলের জোগানদাতার ওপর চাপ তৈরি করতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাঝমাঠকে হতে হয় গোছানো। কিন্তু বার্সেলোনা এই কৌশল ব্যবহার করলেও খেলোয়াড়ের ওপর চাপ তৈরি করতে পারেনি।
প্রথম গোলটির দিকে আবার তাকানো যাক। ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং ও সের্গি রবার্তোর কেউই সহজাত ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার নন। ফলে ভুলটা মাঝমাঠেই হয়ে যায়। এই দুই মিডফিল্ডার সেন্টার পিচে চাপ তৈরি করতে পারেননি বেলিংহামের ওপর। যেকারণে অনেকটা এগিয়ে থাকা ডিফেন্স লাইন থেকে আরও ওপরে এসে ইংলিশ মিডফিল্ডারের ওপর চাপ তৈরি করতে চেয়েছিলেন আন্দ্রেয়াস ক্রিস্তেনসেন। ততক্ষণে বেলিংহামের দারুণ পাসে বল ভিনিসিয়ুসের দখলে।
কিছু সময় পর ধরাশয়ী ইকেই গুন্ডোয়ান ও ডি ইয়ং। ফাঁকায় থাকা দানি কারভাহাল অনেকটা সময় পেয়েছেন বড় বাড়ানোর। এই দুই মিডফিল্ডারের কেউই তার ওপর চাপ তৈরি করেননি। সময় নিয়ে বল বাড়ান রোদ্রিগোকে উদ্দেশ্য করে। আরেক দফা বার্সেলোনার অফসাইড-ফাঁদ ভেঙে রিয়ালের গোল।
অর্থাৎ, বার্সেলোনা শুধু অফসাইড-ফাঁদই তৈরি করেছে। কিন্তু সেটি কাজে লাগাতে অন্য কৌশলে জোর দেয়নি। বলের জোগানদাতার ওপর চাপ তৈরি করেনি। যেকারণে ব্যর্থ জাভির ‘দুর্বল’ কৌশল।
কেন জাভির কৌশল ব্যর্থ
গত মৌসুমে যদি জাভির এই কৌশল কাজে লাগে, এবার তাহলে কেন হচ্ছে না? কারণটা সের্হিয়ো বুশকেট ও গাভির না থাকা। গাভি ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার না হয়েও এই ভূমিকায় তিনি কার্যকরী। এই উদ্যোমী মিডফিল্ডার প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের ওপর চাপ তৈরি করতে পারেন। বলের জোগানে বাধা প্রদান করেন।
বুটকেটসের মতো কার্যকর ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের বদলি খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। তিনি শুধু মাঝমাঠই দখলে রাখতেন না, চাপ প্রয়োগ করতে প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকারদের ওপর। স্প্যানিশ তারকা ন্যু ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার পর ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে জিরোনা থেকে ওরিয়োল রোমেউকে কেনে বার্সেলোনা। দারুণ কয়েকটি ম্যাচও উপহার দিয়েছেন তিনি। তবে জাভির আস্থাভাজন হতে পারেননি।
ফলে বার্সেলোনার সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়ে ‘পিওর’ ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার না থাকা। জাভি চার মিডফিল্ডার মাঠে নামিয়ে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কাছে রাখতে চেয়েছেন। কিন্তু বড় দল, বিশেষ করে রিয়াল মাদ্রিদের গতিশীল ফুটবলের বিপক্ষে বল হারালেই যে বিপদ তৈরি হবে, সেটি হয়তো আমলে নেননি।
জাভির ভবিষ্যৎ কী
৯ মাসের মধ্যে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে দুই ম্যাচে ৪টি করে গোল হজম করল বার্সেলোনা। ইতিহাস বলছে, বার্সেলোনার ইতিহাসের অষ্টম কোচ হিসেবে এই লজ্জায় ডুবলেন জাভি। গত বছর কোপা দেল রে’র সেমিফাইনালে রিয়ালের কাছে ৪-০ গোলে হেরেছিল বার্সেলোনা। জাভির আগে সবশেষ এই লজ্জায় পড়েছিলেন ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড (২০০৫ ও ২০০৮)।
লিওনেল মেসি নেই, ওদিকে আর্থিক ঝামেলায় জর্জরিত ক্লাব- এমন একটা সময় নতুন একটা দল গড়ে সাফল্যের খোঁজ শুরু জাভির। শুরুটাও হয়েছিল দারুণ। ২০২৩ সালের স্প্যানিশ সুপার কাপ জিতে নতুন অধ্যায়ের আভাস দেন তিনি। পরে জেতেন লা লিগাও। ধীরে ধীরে তার তরুণ দলটি পরিণত হয়। আশা বাড়তে থাকে কাতালান সমর্থকদের। কিন্তু চলতি মৌসুমে আবার খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে গেছে। সবশেষ রিয়ালের বিপক্ষে লজ্জার হার।
এল ক্লাসিকোতে বাজেভাবে হারায় চাপ তৈরি হয়েছে জাভির ওপর। আলোচনায় তার বার্সা ভবিষ্যৎ। যদিও কাতালান ক্লাবটির বোর্ড সাবেক মিডফিল্ডারের ওপরই আস্থা রাখছে। স্পোর্টিং ডিরেক্টর ডেকো বলেছেন, “কোনো কিছুই বদলাচ্ছে না। এটা স্রেফ একটা হার। এখনও সভাপতি (হোয়ান লাপোর্তা) ও ক্লাবের সবার আস্থা আছে কোচের ওপর।”
আনচেলত্তির ক্যারিশমা
১২ মাস আগে হাত উঁচিয়ে বীরের বেশে ছিলেন জাভি। জিতেছিলেন টানা তিনটি এল ক্লাসিকো। মুখ লুকিয়েছিলেন কার্লো আনচেলত্তি। সেই যন্ত্রণা এবার জাভিকে ফিরিয়ে দিলেন ইতালিয়ান কোচ। তিনিও জিতলেন টানা তিনটি এল ক্লাসিকো। এই সাফল্যের পথে না পরিবর্তন করেছেন ট্যাকটিকস, না ইউরোর ঝনঝনানিতে নামিদামি খেলোয়াড় কিনেছেন আনচেলত্তি। বরং তারুণ্যে জোর দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য গড়েছেন দল। সেই দলের মধ্যে শুধু বুনে দিয়েছেন আত্মবিশ্বাসের বীজ। তাতেই পাল্টে গেছে রিয়ালের ভেতর-বাহির।
রিয়ালের কোচ হিসেবে ২৬৪ ম্যাচে ডাগ আউটে দাঁড়িয়েছিলেন আনচেলত্তি। মাদ্রিদে তার চেয়ে বেশি ম্যাচের দায়িত্ব পালন করা কোচ শুধু মিগুয়েল মুনোজ। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে রিয়ালের ৬০৫ ম্যাচে ডাগ আউটে দাঁড়িয়েছিলেন এই কিংবদন্তি।
রিয়ালের সর্বোচ্চ শিরোপাজয়ী কোচও তিনি। যদিও মুনোজের জেতা ১৪ শিরোপা এখন হুমকির মুখে। স্প্যানিশ সুপার কাপ জিতে রিয়ালে আনচেলত্তির শিরোপা সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১১-তে।
ভিনি-রোদ্রিগোর গতিঝড়
ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো সান্তিয়াগো বার্নাব্যু ছাড়ার পর রিয়ালের প্রাণভোমরা ছিলেন করিম বেনজেমা। এখন রিয়ালের মধ্যমণি কে? না, আনচেলত্তির এই রিয়াল পুরোটাই দলীয় পারফরম্যান্সের ফলস। কখনো আলো টেনে নিচ্ছেন জুড বেলিংহাম, কখনো ভিনিসিয়ুস, কখনো-বা রোদ্রিগো।
স্প্যানিশ সুপার কাপের কথাই ধরা যাক। এক ভিনির কাছেই কুপোকাত বার্সেলোনা। অথচ কী চাপেই না ছিলেন। চোট তার সেরাটা কেড়ে নিয়েছিল। গত নভেম্বরের পর পাননি গোলের দেখা। এল ক্লাসিকোতে তো পারফরম্যান্স আরও খারাপ। আগের ১৫ ম্যাচে গোল ছিল মোটে তিনটি। এবার সুপার কাপের এক ম্যাচেই পেলেন ৩ গোল।
ভিনিসিয়ুসের দ্বিতীয় গোলটির জোগানদাতা রোদ্রিগো। এই ব্রাজিলিয়ান চমৎকার মৌসুম পার করছেন। বার্সেলোনার কফিনে শেষ পেরেকটি মেরেছেন তিনিই। বাঁ পাশে ভিনি আর ডান পাশে রোদ্রিগো- দুজনার গতির সামনে খেই হারিয়েছে বার্সার রক্ষণ। যেখানে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে বার্সেলোনার অফসাইড-ফাঁদ। ডিফেন্স লাইন ওপরে উঠে আসায় যে জায়গা তৈরি হয়েছে, সেখানে নিজেদের গতির পূর্ণ ফায়দা তুলেছেন ভিনি-রোদ্রিগো।
এই দুজনার গতির সঙ্গে আরেক ‘গতিদাবন’ যদি যোগ হন রিয়ালে? শুরুতে যে প্রশ্নটা রাখা হয়েছিল, এমবাপ্পেকে নিয়ে। “আমরা দুই ম্যাচে ৯ গোল দিয়েছি”- উত্তরটা দিয়ে রিয়াল সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ কি এটাই বোঝাতে চাইলেন “এমবাপ্পেকে আর দরকার নেই” রিয়াল মাদ্রিদের?