Beta
শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

বরগুনা কীভাবে ডেঙ্গুর ‘হটস্পট’ হয়ে উঠল

বরগুনা সদর হাসপাতাল।
বরগুনা সদর হাসপাতাল।
[publishpress_authors_box]

এক দিনে গোটা দেশে শনাক্ত ২৮৮ রোগী, তার মধ্যে ২০২ জনই একটি জেলার! বরগুনা কি ডেঙ্গুর হট স্পট হয়ে উঠছে? প্রশ্নটি করতেই ডা. মুশতাক হোসেন বললেন- “হয়ে উঠবে কী, হয়েই গেছে।”

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক এখন মহামারি ও সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের লড়াইয়ে উপদেষ্টা হিসাবে সরকারি প্রতিষ্ঠানটিকে সহায়তা দিচ্ছেন।

তার ভাষায়, “এক জেলায়, এক হাসপাতালে এক দিনে এত রোগী! এটা ভাবা যাচ্ছে না। নতুন হটস্পট বরগুনা, নিশ্চিতভাবেই।”

বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু আক্রান্তের প্রতিবেদন দেখে ডা. মুশতাকের মতো অনেকের চোখই কপালে উঠেছে।

এইডিস মশাবাহিত এই রোগ ঢাকা ছাড়িয়ে সারাদেশের রোগ হয়ে উঠেছে কয়েক বছর হলো। তাই বলে দক্ষিণাঞ্চলের এক জেলায়ই এত!

পরিসংখ্যান যা দেখাচ্ছে

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিদিনই ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের নিয়ে তথ্য দিয়ে থাকে। বুধবার তাদের দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২৮৮ জন।

এই ২৮৮ জনের মধ্যে বরিশাল বিভাগের হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যাই ২৬১ জন। তাদের মধ্যে ২০২ জনই বরগুনা জেলার।

এই বছর ১১ জুন পর্যন্ত এ জেলায় ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৪০৬ জন। তাদের মধ্যে ১ হাজার ২৭২ জন চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুজনের মৃত্যুও হয়েছে।

গত ২৪ ঘণ্টায় বরিশাল বিভাগ ছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে ১১ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে) একজন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ১২ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে দুজন, রাজশাহী বিভাগে একজন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।

এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ৫ হাজার ৩০৩ জন। এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ২৩ জনের। তাদের মধ্যে নারীর মৃত্যু হার ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ, পুরুষের ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশ।

যে ২৩ জন মারা গেছেন, তাদের ১৩ জন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকার। বাকিদের মধ্যে বরিশাল বিভাগের তিনজন, চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগের দুইজন করে চারজন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকার একজন, ঢাকা বিভাগে একজন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে একজন।

রোগী সামলাতে হিমশিম হাসপাতাল

বরগুনা হাসপাতালে যে দুজনের মৃত্যু হয়েছে, তাদের একজন আজমেরী মোনালিসা নামে এক নারী। গত শুক্রবার বরগুনা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

আজমেরী বরগুনা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত জাফরুল হাসানের ছোট মেয়ে। তার স্বামী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এই দম্পতির দেড় বছরের একটি মেয়ে আছে।

পরিবারের অভিযোগ, হাসপাতালে চিকিৎসায় অবহেলার কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।

৬০ হাজার মানুষের শহর বরগুনার বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেখানে ঘরে ঘরে এখন জ্বরের রোগী। পরীক্ষা করাতে গেলে ডেঙ্গু ধরা পড়েছে।

রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাওয়ার কথা বলছেন বরগুনা সদর হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সরা।

রোগী বাড়তে থাকায় ২৫০ শয্যার বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে ৫০টি শয্যা ডেঙ্গুর জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনেই দেখা যায়, বর্তমানে সেখানে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা তার তিন গুণ।

যে কারণে রোগীদের থাকতে হচ্ছে হাসপাতালের মেঝে, করিডোর, সিঁড়ির পাশে। এই রোগীদের মশারি টানানোর মতো অবস্থাও নেই, যার কারণে রোগীদের সঙ্গে আসা স্বজনসহ অন্যরাও ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছেন।

ডেঙ্গু রোগীদের মশারীর নিচে রাখতে হয়, কিন্তু বরগুনা হাসপাতালে রোগীর চাপে সেই অবস্থা নেই। ফাইল ছবি

বরগুনা সদর হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডের ইনচার্জ আঁখি আকৃতা সকাল সন্ধ্যাকে জানান, কেবল তার ওয়ার্ডেই বুধবার ভর্তি ছিলেন ১২৫ জন রোগী।

“দুপুর ২টা পর্যন্ত আমি ডিউটিতে ছিলাম, তখন পর্যন্ত নতুন করে আরও ভর্তি হয় ১২ থেকে ১৩ জন। এটা অ্যাডাল্ট ওয়ার্ডে, আমি এই ওয়ার্ডের ইনচার্জ। পাশের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছে ৩১ জন। নতুন কিছু রোগীও এসেছে।”

আঁখি বলেন, “এত রোগী যে হাসপাতালে পা ফেলার জায়গা নেই। ফ্লোরে, সিঁড়িতে, বাথরুমের পাশে, ছড়ানো ছিটানো রোগী, পুরাই জগাখিচুড়ির অবস্থা এখানে।”

রোগী অনুপাতে হাসপাতালে জনবল নেই বলে জানান তিনি।

“চিকিৎসক-নার্সসহ জনবল একেবারেই কম এখানে। একেবারে হিমশিম খাবার মতো অবস্থা। যেখানে ১৫০ জন নার্স থাকার কথা, সেখানে কাজ করছি ৭০ জন।”

শঙ্কা ছিল, প্রস্তুতি ছিল না

বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গুর বিস্তারের শঙ্কা আগে থেকেই ছিল বলে জানালেন ডা. মুশতাক।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, আইইডিসিআর প্রাক বর্ষা মৌসুমে যখন এইডিস মশা সর্ম্পকিত জরিপ করে, তখনই বরিশাল অঞ্চলে এই মশার লার্ভা বেশি পাওয়া গিয়েছিল। সেটা পাঠানোও হয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে।

“প্রেজেন্টেশন দেওয়া হয়েছিল মন্ত্রণালয়ে, সেখানে আমিও ছিলাম। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান, স্বাস্থ্য সচিবসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই উপস্থিত ছিলাম। সেদিনই আমরা পরামর্শ দিয়েছিলাম প্রতিরোধ এবং প্রতিকারের জন্য।

“আমরা বলেছিলাম, স্থানীয় সরকার বিভাগ, সিটি কর্পোরেশন এবং স্বাস্থ্য বিভাগকে সমন্বিতভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন কতটুকু হয়েছে সেটা বলতে পারছি না।”

বরগুনায় এত রোগী পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহাসান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কেবল এবছরই নয়, গতবার এবং তার আগের বছরও এই অঞ্চলে রোগী বেশি ছিল। তবে এবারে সেটা আগের বছরগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে।

“এর কারণ মনে হচ্ছে যেহেতু এটা পানিবেষ্টিত এলাকা, পানি জমে থাকে। এজন্য এইডিসের লার্ভা সব সময়ই থাকে। এবার সেটা মাত্রা ছাড়িয়েছে।”

স্বাস্থ্য বিভাগের বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, বরগুনা এখন ‘টপ মোস্ট’ ডেঙ্গু রোগীর শহর। এখানে রোগী আছে, রোগের বাহক এইডিস মশা আছে। সে কারণেই রোগী বেড়ে চলেছে।

বুধবার রাতে যখন তার সঙ্গে কথা হয়, তিনি তখন সবে বরগুনা থেকে বরিশাল ফিরছিলেন বলে জানান।

“আমি বরগুনা থেকে মাত্র বরিশাল এলাম। ওখানে চিকিৎসক, স্থানীয় সরকার, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিকসহ সবার সঙ্গে এ নিয়ে মিটিং করে এলাম। মশা নিধন যাদের দায়িত্ব তারা এখনও যদি তাদের কাজটা করে ঠিকভাবে, তাহলে এখনও কিছু করার থাকবে, নতুবা হাসপাতালের অবস্থা কী হয়, সেটা বলতে পারছি না।”

ডেঙ্গু রোগের বাহক মশা নিধনে বড় ধরনের অভিযান চালানোর পরামর্শ এসেছে।

আইইডিসিআরের প্রতিবেদনটি নিয়ে জানতে চাইলে বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ বলেন, “কীসের প্রেজেন্টেশন?”

প্রাক বর্ষা জরিপে এইডিস মশার লার্ভার কথা জানালে তিনি বলেন, “আমার কাছে আছে কি না, দেখতে হবে।”

পরক্ষণেই তিনি বলেন, “সম্ভবত জমা দেওয়া হয়নি আমার কাছে; জমা দিলে থাকত।”

আইইডিসিআরের জরিপের তথ্য বরিশালের স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে নেই জানানো হলে ডা. মুশতাক বলেন, “খুবই বিস্ময়কর কথা এটা। তাদেরকে আগে জানানো হলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে রোগী সংখ্যা এত বাড়ত না।”

এখন রোগী বেড়ে যাওয়ায় তা সামলানো নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. মঈনুল আহাসান বলেন, কেবল বরগুনাতেই না, পুরো বরিশালেই জনবল কম। তবে এনিয়ে কাজ হচ্ছে।

“বরগুনা জেলার সিভিল সার্জন এটা জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য সচিব সব জানেন। আমরা সবাই অবহিত। কাজ হচ্ছে, ঈদের ছুটি শেষ হলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

এখন করণীয় কী- প্রশ্নে ডা. মুশতাক বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগকে কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে। যেসব অঞ্চলে রোগী বেশি, তাদেরকে স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। সেইসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিভাগকে পরিচ্ছন্নতা অভিযান জোরদার করতে হবে।

“নইলে কিন্তু এটা ভয়ঙ্কর হবে,” হুঁশিয়ার করেন ডা. মুশতাক।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত