মেয়র পদ হারালেও বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছেন সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ; এখন তার সেই প্রভাবও ছেঁটে দিতে চাইছেন প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম এবং মেয়র খোকন সেরনিয়াবাত সমর্থকরা।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জয়ী জাহিদ ফারুক পুনরায় পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর তাকে বরিশাল নগরীতে দেওয়া সংবর্ধনা সভায় মহানগর কমিটি ভেঙে দেওয়ার আওয়াজ ওঠে।
বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য জাহিদ ফারুক সেখানে বলেন, “শান্তি-শৃঙ্খলার ব্যত্যয় বরিশালে ঘটবে না। আমি এবং মেয়র ঐক্যবদ্ধ বরিশালের উন্নয়নের জন্য।”
“কোনো চক্রান্তে কাজ হবে না,” বলেন মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ (খোকন সেরনিয়াবাত), যিনি সাদিকের আপন চাচা হলেও তাদের দূরত্ব বরাবরই আলোচিত।
জাহিদ ফারুক গতবারও বরিশাল-৫ আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন, প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। তবে মেয়র সাদিকের দাপটে তিনি ছিলেন কোণঠাসা।
বরিশাল আওয়ামী লীগে সেরনিয়াবাত পরিবারের প্রভাব বহুদিনের। সাদিকের বাবা আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বরিশাল-১ (গৌরনদী) আসনের সংসদ সদস্য তিনি।
বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসাবে জেলার রাজনীতিতে হাসনাত আব্দুল্লাহর একচ্ছত্র প্রভাব থাকলেও মহানগরে তেমনটা ছিল না।
সাদিক ২০১৮ সালে বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র হওয়ার পরের বছর নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হলে নগরেও তার প্রভাব বাড়ে, যাতে কোনঠাসা হয়ে পড়েন অন্যরা।
নানা ঘটনায় বিতর্কিত সাদিক গত বছর সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে আর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। তার বদলে নৌকা প্রতীক পেয়ে মেয়র হন তারই চাচা খোকন সেরনিয়াবাত। তারপর থেকে সাদিকের দাপটে কোনঠাসা নেতারা মাথা জাগাতে থাকেন।
শনিবার বিকালে বরিশাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মেয়র ও প্রতিমন্ত্রী সমর্থকদের মেলবন্ধন দৃশ্যমাণ হয়।
খোকন সেরনিয়াবাতের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডসহ সদর উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়ন থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে নেতা-কর্মীরা জড়ো হন। প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুককে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান মেয়র খোকন।
সভায় বক্তাদের অনেকেই সিটি করপোরেশন এবং সদ্য শেষ হওয়া সংসদ নির্বাচনে দলের মহানগর সভাপতি এ কে এম জাহাঙ্গীর ও সাধারণ সম্পাদক সাদিক আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে মুখ খোলেন।
বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন কলেজ ছাত্র সংসদের (বাকসু) ভিপি মঈন তুষার বলেন, “অস্থির বরিশালে স্বস্তি ফিরে এসেছে মেয়র ও মন্ত্রী মহোদয় জোট বাধায়।
“বিগত দিনে বরিশালে অস্থিতিশীল অবস্থা ছিল। যারা ক্ষমতায় ছিল, তারা আওয়ামী লীগকে বিতর্কিত করেছে। আমরা অবিলম্বে মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটির বিলুপ্তি চাই।”
মেয়র পদ হারানো সাদিক এবার সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে সদর আসনে দলীয় মনোনয়ন চাইলেও পাননি। নৌকার টিকেট পান জাহিদ ফারুক। তখন সাদিক স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চাইলেও মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় তার আর ভোট করা হয়নি।
বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের পদধারী নেতারা ছাড়াও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও কলেজ ছাত্রলীগের কমিটিগুলোর পদে সাদিক সমর্খকদের প্রাধান্য রয়েছে।
যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বরিশাল জেলা বাস মালিক গ্রুপের সভাপতি অসীম দেওয়ান সভায় বলেন, “মহানগর আওয়ামী লীগ বিতর্কিত করে ফেলা হয়েছে। সাধারণ নেতাকর্মীরা মহানগর আওয়ামী লীগের উপর বিরক্ত। জালিমের হাত থেকে দলকে মুক্ত করার দাবি করছি।”
জাহিদ ফারুক এতদিন অভিযোগ করে আসছিলেন, সাদিকের অসহযোগিতায় শহরে কোনও উন্নয়নমূলক কাজ করা যায়নি।
এখন খোকনকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করে যেতে চান তিনি।
সভায় খোকনও বলেন, “১০ বছরে বরিশাল যে পিছিয়ে পড়েছিল, সেই বরিশালকে উন্নয়নে ভরিয়ে দেওয়া হবে।
মেয়র ও প্রতিমন্ত্রী সমর্থকদের নানা অভিযোগ বরাবরই প্রত্যাখ্যান করে আসছেন সাদিক। নতুন করে অভিযোগের বিষয়ে তার কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি, ১৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর গাজী নইমুল হোসেন লিটু সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সাদিক আব্দুল্লাহর আমলে উন্নয়ন হয়নি যারা বলেন, তাদের চোখ অন্ধ। বাংলাদেশে প্রথম ৫ বছরের গ্যারান্টিতে রাস্তা তৈরি করেছেন সাদিক আব্দুল্লাহ। তার আমলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় নতুন মাত্রা এসেছে। সিটি করপোরেশন নিজ আয়ে নগর উন্নয়নে কাজ করেছে।
“এরকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, যা সাদিক আব্দুল্লাহর মেয়াদ কালে হয়েছে। যারা সাদিক আব্দুল্লাহর কাছ থেকে সুবিধা নিতে পারেনি, তারাই গিবত গাইছে।”
কমিটি ভেঙে দেওয়ার দাবির প্রতিক্রিয়ায় মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, নিয়মানুযায়ী সম্মেলন করে আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করা হবে।
“কিছু লোকজন বিভেদ সৃষ্টি করতে চায়, যারা বসন্তের কোকিল। এদের কথায় কোনো কিছু যায় আসে না। আমরা বিশ্বাস করি, মহানগর আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ। ৩০টি ওয়ার্ডে তৃণমূল পর্যায়ে সাদিক আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে দলকে সুসংগঠিত করা হয়েছে।”
সাদিক আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জাহাঙ্গীর বলেন, “সাদিক আব্দুল্লাহর দাপটের কথা যারা বলছেন, তারা তো দলীয় কোনো কর্মসূচিতে অংশ নিতেন না। দলের কার্যালয়েও তাদের দেখা যেত না। যে দল করে না, তার দাপট থাকবে কোন জায়গা থেকে?”
বরিশালে আওয়ামী লীগে নতুন করে বিভেদ জেগে ওঠা নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মোহাম্মদ ইউনুস সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এগুলো কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ দেখবে।”
কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য বলরাম পোদ্দারকে এবিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বরিশালে দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান থাকলেও সবার সমন্বয়ে দ্রুত তা নিরসন করা হবে।”