সোশাল মিডিয়ার পরিচিত মুখ সৈয়দ সায়েদুল হক (ব্যারিস্টার সুমন) এখন সংসদ সদস্য। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটে হবিগঞ্জ-৪ (চুনারুঘাট-মাধবপুর) আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী তখনকার বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীকে বড় ব্যবধানে হারান।
সুমনের মুখে বরাবরই আওয়ামী লীগের মতাদর্শের কথা। এমপি হিসেবে শপথ গ্রহণের পরদিন গত ১১ জানুয়ারি সকালে গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধে তিনি শ্রদ্ধাও জানান।
তবে এবার দেখছেন মুদ্রার অন্য পিঠ। রবিবার চুনারুঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে তার উপস্থিতি ঘিরে হয় হট্টগোল। সভা আয়োজন নিয়ে প্রশ্ন তোলায় তোপের মুখে পড়েন উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুমন ছিলেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় আইন বিষয়ক সম্পাদক। আওয়ামী লীগের এ সহযোগী সংগঠন থেকে ২০২১ সালে বহিষ্কার করা হয় তাকে। তবে নিজেকে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী বলেই বলে আসছেন ব্যারিস্টার সুমন।
গত ৭ জানুয়ারির ভোটে জেতার পর চুনারুঘাটে বাসার কাছে তাকে ঘিরে ধরেন কর্মী-সমর্থকরা। সুমন তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আমি যেভাবে আগে সফল হয়েছি, একইভাবে এখনও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সফল হব। এছাড়া পরিষ্কার করতে হবে ময়লা আবর্জনা। ময়লা বলতে শুধু পানির মধ্যে না, কিছু মানুষের মধ্যেও ময়লা আছে, তা পরিষ্কার করতে হবে।”
রবিবার চুনারুঘাট উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে উপজেলা আওয়ামী লীগ এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য সুমনকে প্রধান অতিথি করা হয়। উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট আকবর হোসেন জিতুর সভাপতিত্বে বিকেল ৪টায় সভা শুরু হয়।
সভার এক পর্যায়ে সংসদ সদস্যের বক্তব্য দেওয়ার আগ মুহূর্তে উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক সাথী মুক্তাদির চৌধুরী দাঁড়িয়ে সভাপতির উদ্দেশে বলেন, “আজকে সংসদ সদস্যের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের যে মতবিনিময় সভার আহ্বান করা হয়েছে, সেটি দলীয় কোনও সভার সিদ্ধান্ত ছিল কি না? ব্যারিস্টার সুমনকে দল (আওয়ামী লীগ) গ্রহণ করেছে কি না? না হয়ে থাকলে তার সঙ্গে মতবিনিময় কেন?”
এ প্রশ্নের পরপরই নেতাকর্মীরা হট্টগোল শুরু করেন। হট্টগোল শুরুর পর সভাপতি আকবর হোসেন হাতে মাইক নিয়ে নেতাকর্মীদের বোঝানোর চেষ্টা করেন।
তিনি জানান, জেলা আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তে আজকের সভা আহ্বান করা হয়েছে। সংসদ সদস্য নিজেও সবার সঙ্গে মতবিনিময় করতে চেয়েছিলেন।
তবে তখনও নেতাকর্মীরা হট্টগোল থামাননি। এক পর্যায়ে সংসদ সদস্য নিজেই মাইক নিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন।
এমপি সুমন বলেন, “আপনারা সবাই আমার অভিভাবক। এখানে অনেক নেতা আছেন, যাদের রাজনীতির অভিজ্ঞতা আমার বয়সের চেয়ে বেশি।
“আমি স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হলেও আওয়ামী লীগের একজন কর্মী। নেত্রীর (শেখ হাসিনা) কথা অনুযায়ী প্রার্থী হয়েছি। আপনাদের ভোটে নির্বাচিত হয়েছি। এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে আপনাদের সঙ্গে আজ মতবিনিময় করতে এসেছি।”
সুমনের বক্তব্যের সময় নেতাকর্মীরা একে অন্যের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় করতে থাকেন। পরে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
এ নিয়ে কথা হয় উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট এম আকবর হোসেন জিতুর সঙ্গে।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ‘‘আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক চুনারুঘাট আসছেন। নবনির্বাচিত এমপি ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনের আমন্ত্রণেই তিনি আসছেন।
“প্রথমে উক্ত অনুষ্ঠানে আমাদের যাওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল না। কারণ মন্ত্রীর তরফ থেকে আমাদের বিষয়টি জানানো হয়নি। পরবর্তীতে যেহেতু আমাদের দলের প্রতিমন্ত্রী আসছেন, তাই আমরা অনুষ্ঠানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।”
“উক্ত অনুষ্ঠান সফল করতে জেলা আওয়ামী লীগের অনুমতি নিয়ে এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। এতে স্থানীয় সংসদ সদস্য হিসেবে প্রধান অতিথি করা হয় ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনকে”, যোগ করেন তিনি।
জিতু আরও বলেন, “নতুন এমপির উপস্থিতি নিয়ে কোনও বিতর্ক হয়নি। কারণ ব্যানারেই তো প্রধান অতিথি হিসেবে তার নাম ছিল। তাছাড়া যেহেতু প্রতিমন্ত্রী তার আমন্ত্রণেই আসছেন তাই তাকে রেখেই অনুষ্ঠান সফলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
সভায় হট্টগোল হয়েছে কি না- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “সভা শুরু হয়েছে বিকেল থেকে। হট্টগোল হয়েছে রাতে সভার প্রায় শেষ পর্যায়ে। সিনিয়র নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয় এবং শান্তিপূর্ণভাবে সভা সমাপ্ত হয়েছে।”
তবে বিষয়টি ভিন্নভাবে দেখছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন চৌধুরী অসিম। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা এখন অসহায়। যৌক্তিক একটি প্রশ্ন সভায় উত্থাপন করায় উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতাকে অপদস্ত হতে হয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।”
উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সামাদ মাস্টার এ বিষয়ে বলেন, “মতবিনিময় সভায় আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদকের প্রশ্ন করা নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। উত্তেজনা দেখা দেয়।
“মূলত স্বতন্ত্র এমপি ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনকে নিয়ে আওয়ামী লীগ দলীয় মতবিনিময় সভা করায় এ উত্তেজনা দেখা দেয়। পরবর্তীতে দলের সিনিয়র নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।”
এ ব্যাপারে উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক সম্পাদক সাথী মুক্তাদির চৌধুরীর সঙ্গে সোমবার বিকেলে কথা হয়। সভায় এমপির সমালোচনা করেননি, সাংগঠনিক শৃঙ্খলার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন বলে তিনি দাবি করেন।
স্বতন্ত্র এমপিকে নিয়ে আওয়ামী লীগের সভায় প্রশ্ন তোলায় তার গায়ে হাত তোলা হয় অভিযোগ করে তিনি বলেন, “জাতীয় নির্বাচনে যারা নৌকার বিপক্ষে কাজ করেছিলেন, তারাই আমাকে লাঞ্ছিত করেছে। ন্যায়ের পক্ষে, সংগঠনের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় আমাকে অপদস্ত হতে হয়েছে।”
চুনারুঘাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল কাদির লস্করের সঙ্গেও রবিবারের সভা নিয়ে কথা হয়। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “সভায় কথা কাটাকাটি হয়েছে। পরে আমরা এটি মীমাংসা করে দিয়েছি। কাউকে লাঞ্ছিত করার ঘটনা ঘটেনি।”
এ বিষয়ে জানতে এমপি সুমনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।