Beta
রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫
Beta
রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫

নগরের বসন্ত এবার উত্তরায় এল না

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় শুক্রবার জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্‌যাপন পরিষদের ‘বসন্ত উৎসব’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় শুক্রবার জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্‌যাপন পরিষদের ‘বসন্ত উৎসব’।
[publishpress_authors_box]

পহেলা ফাল্গুন, ঋতুরাজ বসন্ত বরণে মাতল সকলে; আয়োজনও ছিল নগরে, কিন্তু উৎসব ঢাকা পড়ল ঢাকার উত্তরায়।

বাধার মুখে সেখানে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্‌যাপন পরিষদের ‘বসন্ত উৎসব’ এবার হতে পারেনি। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলা এবং পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের অনুষ্ঠান ঠিকই হয়েছে।

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর মাজারে হামলা, গানের অনুষ্ঠান বন্ধসহ নানা বিতর্কিত ঘটনার পর এবার বসন্ত উৎসবও রঙ হারাল।

জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্‌যাপন পরিষদ গত ৩১ বছর ধরে রাজধানীর তিনটি স্থানে পহেলা ফাল্গুন অনুষ্ঠান আয়োজন করে আসছে।

স্থান তিনটি হলো চারুকলা অনুষদের বকুলতলা, পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক এবং উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের উন্মুক্ত মঞ্চ।

এবারও তিনটি স্থানেই আয়োজন ছিল। শুক্রবার বকুলতলা ও বাহাদুর শাহ পার্কে উৎসব হলেও উত্তরায় বাধার মুখে তা করা যায়নি বলে জানিয়েছেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট।

তিনি বকুলতলায় ‘বসন্ত উৎসব’র সমাপনী বক্তব্যে বলেন, উত্তরার কিছু মানুষের বাধার মুখে তারা অনুষ্ঠানটি করতে পারেননি।

উত্তরার অনুষ্ঠানের জন্য পুলিশের অনুমোদন নেওয়া, সিটি করপোরেশনে টাকা জমা দেওয়াসহ সব কিছুই সারা হয়েছিল বলে জানান তিনি।

উত্তরায় আয়োজনে কারা বাধা দিয়েছিল, তাদের নাম বলেননি মানজার।

তিনি বলেন, “শুধু একটি ফুল দিয়ে বাগান সাজালে সেটি বাগান হয় না। বাগানে শত ফুল ফুটতে দিতে হবে। এই ফোটার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।”

জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্‌যাপন পরিষদের সহসভাপতি কাজল দেবনাথ সমাপনী অনুষ্ঠানে বলেন, “কোকিল সবার জন্য গান করে, ফুল সবার জন্য ফোটে। পাহাড়ি, বাঙালি, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, বিভিন্ন ভাষাভাষী—সবাই মিলে শান্তিতে বাংলাদেশে বাস করতে হবে। সাম্য যেন অধরা না থাকে। বাংলাদেশ হোক সবার জন্য।”

উত্তরায় অনুষ্ঠান আয়োজনে বাধা পাওয়ার খবর আয়োজকরা পুলিশকে জানাননি বলে প্রথম আলোকে জানান উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি মো. হাফিজুর রহমান।

তিনি বলেন, পুলিশ অনুষ্ঠানে নিরাপত্তা দিতে হাজির হয়েছিল। কিন্তু আয়োজকরা আসেনি। বাধা দেওয়ার কথাও জানায়নি।

আয়োজকদের একটি সূত্রের বরাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানিয়েছে, আয়োজনে যুক্ত একজনকে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ হিসাবে চিহ্নিত করে বাধা দিয়েছিল স্থানীয়দের একটি দল।

বাধাদানকারীদের নেতা হিসাবে ইমন রহমান ফরহাদ নামের একজনের নাম আসে; যিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তুরাগ থানার মুখপাত্র।

ইমন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় বলেন, “এই উৎসব আয়োজনে উত্তরায় উনাদের যে প্রতিনিধি, তিনি আওয়ামী লীগের দোসর।”

তিনি কে? নাম জানতে চাইলে ইমন আবার বলেন, “উনার নামটা জানি না।”

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানেই গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। দলটিতে পুনরায় রাজনীতিতে ফিরতে না দেওয়ার ঘোষণা রয়েছে অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের।

বাধা দেওয়ার আরেকটি কারণ দেখিয়ে ইমন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আয়োজকেরা মঞ্চটির সঠিক নাম ব্যানারে ব্যবহার করছিল না।

“আমরা ৫ অগাস্টের পর এই মঞ্চটিকে ‘মীর মুগ্ধ মঞ্চ’ নাম দিয়েছি। কিন্তু বসন্ত উৎসবের লোকজন সব জায়গায় এটিকে উন্মুক্ত মঞ্চ বলে পরিচয় দিচ্ছে।”

সিটি করপোরেশন থেকে মঞ্চটির নাম কি ‘মীর মুগ্ধ মঞ্চ করা হয়েছে? উত্তরে তিনি বলেন, “আমরা সিটি করপোরেশনে বলেছি। একজন কর্মকর্তা এসে জায়গাটা দেখে গেছেন। এটা করা হবে।”

সিটি করপোরেশন থেকে বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদকে যে অনুমতিপত্র দেওয়া হয়েছে, সেই চিঠির অনুলিপি দেখে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম লিখেছে, “তাতে বলা হয়েছে, সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের রবীন্দ্র সরণি সংলগ্ন উন্মুক্ত মঞ্চ বসন্ত উৎসবের জন্য বরাদ্দ দেয়া হলো।”

ইমন দাবি করেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্য থেকে গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটি উত্তরার অনুষ্ঠানটি বাতিল করেছে।

বিষয়টি নিয়ে জানতে জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ন আহ্বায়ক সারোয়ার তুষারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। তিনি বলেন, “এ বিষয়ে আমরা এখনও কিছু জানতে পারিনি। বিষয়টা খোঁজ নিয়ে দেখব।”

পরে নাগরিক কমিটির উত্তরা জোনের পক্ষে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সদস্য সৈয়দ হাসান ইমতিয়াজ একটি লিখিত বক্তব্য পাঠান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে।

সেখানে তিনি বলেন, “সকল ধরনের নাগরিক সংগঠন, যার মধ্যে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও পড়ে, আমরা তাদের সব ধরনের সাহায্য করার ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিই। যে সাংস্কৃতিক স্থিরাবস্থা বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে, সকল স্তরের জনগণকে নিয়ে আমরা সেটা আবার গতিশীল করতে চাই।”

উত্তরার অনুষ্ঠানের বিষয়ে হাসান ইমতিয়াজ বলেন, “গতকাল, ১৩ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টায়, সেক্টর ৭ এর একদল ছেলে উত্তরা ওয়েলফেয়ার সোসাইটির ইমন নামের একজনকে অবহিত করে যে উত্তরায় বসন্তবরণ উৎসবে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন পতিত স্বৈরাচারী দল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। “পরবর্তীতে জাতীয় নাগরিক কমিটি উত্তরার দুজন সদস্যকে আমরা তাদেরকে আরো ভালোভাবে খতিয়ে দেখে প্রমাণ সহকারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কাছে জানাতে বলি। এরপরে এই বিষয়ে আমাদের সাথে আর যোগাযোগ করা হয়নি। আমরা আজকে সকালে জানতে পারি যে উত্তরা ওয়েলফেয়ার সোসাইটি স্থানীয় প্রতিবাদের কথা জানিয়ে উপসচিবের কাছে পরামর্শ চাইলে তিনি প্রোগ্রামটি স্থগিত করতে বলেন।”

এদিকে উত্তরায় উৎসব বন্ধে হতাশা প্রকাশ করে মানজার চৌধুরী বকুলতলার অনুষ্ঠানে বলেন, “যখন দেখা যায় জয়পুরহাটে মেয়েদের খেলা বন্ধ হয়ে যায়, সাতক্ষীরায় উদীচীর স্টল পুড়িয়ে দেওয়া হয়, টাঙ্গাইলের মধুপুরে লালনের উৎসব বন্ধ হয়ে যায়, তখন মনটা ব্যথিত হয়।

“এই সংস্কৃতি আজকের নয়, হাজার বছর লালন করে দেশবাসী এখানে নিয়ে এসেছে। এই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে মুক্তিযুদ্ধের জন্য, বাংলাদেশের জন্য।”

উদীচীর প্রতিবাদ সমাবেশ

উত্তরায় বসন্ত উৎসবে বাধা দেওয়া, সাতক্ষীরায় বইমেলায় উদীচীর স্টল ভাংচুর করে ব্যানার পোড়ানো, ঢাকায় অমর একুশে বইমেলায় ‘সব্যসাচী’র স্টলে হামলা এবং টাঙ্গাইলে হেফাজতে ইসলামের বাধার মুখে লালন স্মরণোৎসব স্থগিতের প্রতিবাদ জানিয়েছে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।

শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মিছিল-সমাবেশে বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন এই সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা বলেন, ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের সমস্ত অর্জন ধূলিস্যাৎ করে নতুন কোনও ফ্যাসিস্ট অপশক্তি যেন জন্ম না নিতে পারে, সেদিকে সবাইকে দৃষ্টি দিতে হবে।

সমাবেশে উদীচী নেতা অমিত রঞ্জন দে বলেন, “আওয়ামী লীগের পুরো শাসনামলজুড়েই নানা অবিচার, অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল উদীচী। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরোধিতা, সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার দাবি, হত্যা-সন্ত্রাস বন্ধ করা, পাঠ্যপুস্তককে সাম্প্রদায়িকীকরণসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বারবারই রাজপথে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে উদীচী। এমনকি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনেও শুরু থেকেই মাঠে ছিলেন উদীচীর শিল্পী-কর্মীরা।

“এত কিছুর পরও উদীচীর নামে নানা অপপ্রচার চালিয়ে উদীচীর কর্মকাণ্ডে বাধা সৃষ্টি করার অপচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। সাতক্ষীরায় উদীচীর স্টলে হামলা যার সবশেষ উদাহরণ। কিন্তু, যত বাধাই আসুক, সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রাম থেকে উদীচীকে কখনোই বিচ্যুত করা যাবে না।”

সমাবেশে বক্তারা বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই একটি চিহ্নিত গোষ্ঠী একের পর এক ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্পী, সংস্কৃতি ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। মাজার ভাঙা হচ্ছে, ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা করা হচ্ছে, বাউল গানের আসরসহ লোক সংস্কৃতি চর্চার সকল আয়োজনে বাধা দেওয়া হচ্ছে।

সমাবেশে উদীচীর পক্ষ থেকে বলা হয়, এক ফ্যাসিবাদী অপশক্তির বিদায় হয়েছে, নতুন করে যেন আর কোনও ফ্যাসিস্টের জন্ম না হয়।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত