২০২১ সালে সাভারের নবীনগরের বগাবাড়ি এলাকায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় ডান পা ভেঙে যায় পিকআপ ভ্যানচালক মো. সবুজ শেখের। এরপর টানা চিকিৎসায়ও সেই পা ঠিক হয়নি তার। পায়ের মধ্যে স্টিলের পাত লাগানো থাকায় পা ভাঁজ করতে পারেন না সবুজ। পা সোজা করে রাখতে হয়। এই অবস্থায় ভারি কাজ করা তো দূরে থাক, সবুজকে হাঁটতেও হয় স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে।
পিকআপ ভ্যানচালক সবুজ শেখ স্ক্র্যাচে ভর দিয়েই সোমবার রাজধানী ঢাকার আগারগাঁও মোড়ে এসেছিলেন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নিতে। কারণ তিন বছরের আগের দুর্ঘটনার পর অটোরিকশা চালিয়েই নিজের চিকিৎসা খরচসহ পরিবারের ভরণপোষণ চালাতে হচ্ছে তাকে।
এদিকে ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধ বা বিধিনিষেধ আরোপে হাই কোর্টের দেওয়া আদেশের ওপর সোমবারই স্থিতাবস্থা দিয়েছে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। এর ফলে এ ধরনের রিকশা চলায় আইনগত বাধা আপাতত কেটেছে।
চেম্বার আদালতের এ আদেশের আগে আগারগাঁও মোড়ে সড়ক বিভাজকে বসে কথা হয় সবুজ শেখে সঙ্গে। তিনি জানান, তার বাড়ি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলার আওরাকান্দি গ্রামে। দুই মেয়ে, এক ছেলে ও স্ত্রী রোজিনা বেগমকে নিয়ে আগারগাঁওয়ের আরমিরটেক এলাকার ভুইয়াগলিতে ভাড়া বাসায় থাকেন তিনি।
অটোরিকশা বন্ধ হলে কী করবেন? এই প্রশ্নে যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তার।
সবুজ শেখ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “গ্রামে কোনও জমিজমা নাই। এই পা নিয়ে অন্যের জমিতে ধানও লাগাইতে পারুম না, মাটিও কাটতে পারুম না। অ্যাক্সিডেন্টের পর অটোই আমার ভরসা। এখন সরকার যদি অটোরিকশা বন্ধ করে দেয় তাইলে আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনও উপায় নাই আমার।”
নিজের জন্য প্রতিদিন ৩০০ টাকার ওষুধ লাগে জানিয়ে সবুজ শেখ বলেন, “এরপর বাসাভাড়া লাগে মাসে ৪ হাজার টাকা, বাজার খরচ আছে। পোলাপানগুলা ছোট। বউ মানুষের বাড়িতে কাজ করে কিছু কামাই করে। আর বাকিডা আমি কামাই। এখন অটো বন্ধ করলে তো আমার কামাইও বন্ধ হয়া যাইবো।”
আগারগাঁও মোড়েই কথা হয় আরেক অটোরিকশা চালক চাঁন মিয়ার সঙ্গে। তার বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার চাঁনপুর গ্রামে।
৫৫ বছর বয়সী চাঁন মিয়া ৪ মাস আগেও প্যাডেলচালিত রিকশা চালিয়ে জীবন চালাতেন। কিন্তু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।
চাঁন মিয়া জানান, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের চিকিৎসকরা তার হার্টে ব্লক ধরা পড়ার কথা বলেছেন। বেশি পরিশ্রমের কাজ আর করতে পারবেন না। এরপর প্যাডেলচালিত রিকশা ছেড়ে দেন। চড়া সুদে ৭০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে অটোরিকশা কেনেন।
চাঁন মিয়া সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কিস্তিতে ৭০ হাজার টাকা নিয়া অটো কিনছিলাম। দেওয়া লাগবে ৯১ হাজার টাকা। সেই ঋণের জন্য প্রতিদিন কিস্তি দেওয়া লাগে ৪০০ টাকা। তাছাড়া আমার প্রতিদিন ওষুধ খাইতে হয় ১৯৫ টাকার। এখন সরকার অটো বন্ধ করলে কিস্তি শোধ করমু কীভাবে, আর ওষুধ কিনমু কী দিয়া? এছাড়া প্রতিমাসে আরেকটা ওষুধ কিনা লাগে।”
৬ মেয়ের মধ্যে ৪ জনকে বিয়ে দিয়েছেন চাঁন মিয়া। এখন দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে আগারগাঁওয়ের তালতলা এলাকার কবরস্থান গলিতে একটি বাসায় ভাড়া থাকেন তিনি। প্রতিমাসে ৮ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিতে হয় তাকে। ছোট দুই মেয়ে মাদ্রাসায় পড়ে।
চাঁন মিয়া বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দীর ডাক্তাররা কইছে আমার অপারেশন করতে দেড় লাখ টাকা লাগবে। যতদিন অপারেশন করমু না ততদিন ওষুধ খাওয়া লাগবে। অটো কেনার ঋণ বাকি আছে ৩০ হাজার টাকার বেশি। এই অবস্থায় অটো বন্ধ হলে ভিক্ষায় নামা ছাড়া উপায় নাই। ভিক্ষা যাতে না করা লাগে সেই জন্য অসুস্থ শরীর নিয়াই আন্দোলনে আইলাম।”
চাঁন মিয়ার মতোই চড়া সুদে ঋণ নিয়ে অটোরিকশা কিনেছেন মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার পূর্ব মির্জারচর গ্রামের মো. লতিফ। আগে তীর কোম্পানির মালবাহী ভ্যান টানতেন তিনি। মাসে বেতন পেতেন ১২ হাজার টাকা। সেই টাকায় ৯ সদস্যের পরিবার চালানো সম্ভব না হওয়ায় অটোরিকশা কেনেন তিনি।
মো. লতিফ বলেন, “আমার নিজের ৪ মেয়ে। আছে স্ত্রী ও মা। ২ বছর আগে ছোটভাইটা আত্মহত্যা করে। সেই থেকে তার ৩ ছেলেকেও আমার দেখতে হয়। কোম্পানির বেতনে এত বড় সংসার চলে না দেখে কিস্তিতে ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে অটো কিনেছি। অটো কেনার পর ৩ মাসও হয়নি। মাসে ঋণের জন্য ৮ হাজার ৬শ টাকা কিস্তি দেওয়া লাগে।”
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকার কইছিল অটোরিকশা চলবে। সেই কথা শুনে অটো কিনছি। এখন হুট করে এই সরকার কইছে অটো চালাইতে পারমু না। অটো বন্ধ হইলে আমি কিস্তি দিমু ক্যামনে, আর সংসার চালামু ক্যামনে। সরকার কী সেই কথা ভাবছে?
মো. লতিফ তার পরিবার নিয়ে তালতলার বড়মসজিদ এলাকায় একটি বাসা ভাড়া থাকেন। মাসে তাকে বাসাভাড়া দিতে হয় ১৫ হাজার টাকা।
“এখন ঠিকমতো অটো চালাইতে পারতেছি না দেইখ্যা সংসারই চলতেছে না। খরচের অভাবে বড় ভাতিজাটাকে এতিমখানায় পাঠাইছি কয়েকদিন আগে। অটোরিকশা বন্ধের আগে সরকার যেন আমাগো কথা ভাবে”, বলেন লতিফ।
লতিফের পাশে দাঁড়ানো সাব্বির হোসেন নামে আরেক অটোরিকশা চালক বলেন, “আগের সরকার অনুমতি দেওয়ার পর আমরা কেউ ঋণ করে অটো কিনেছি। কেউ জমি বেচে অটো কিনছি। অনেকে বউয়ের গহনা বন্ধক দিয়ে, কেউবা মায়ের গহনা বিক্রি করে অটোরিকশা কিনছে। এখন সরকার অটোরিকশা তুলে দিতে চাইলে আমাদের রাস্তায় নামা ছাড়া উপায় নাই।”
তিনি বলেন, “আমাদের অটো চালাইতে দিতে হবে। সরকার চাইলে আমরা মেইন সড়কে আসবো না, অলিতে গলিতে চালাবো। আমরা রিকশা চালাবো, ভাত খাবো, রাতে বউ পোলাপান নিয়ে শান্তিতে ঘুমাবো। আর কিছু চাই না আমরা।”
গত ১৯ নভেম্বর ঢাকা মহানগর এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল তিন দিনের মধ্যে বন্ধের নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট। প্যাডেলচালিত রিকশা মালিকদের তিনটি সংগঠনের ঐক্য জোটের নেতাদের এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি মাহমুদুর রাজীর হাই কোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেয়।
স্বরাষ্ট্র সচিব, স্থানীয় সরকার সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। একইসঙ্গে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করে হাই কোর্ট।
হাই কোর্টের এ আদেশের পরদিন থেকেই রাজধানীজুড়ে টানা বিক্ষোভ-অবরোধ করছেন ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা; বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকদের বিক্ষোভের কারণে গত কয়েক দিন ব্যাপক যানজট দেখা দেয়। ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হয় বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীদের।
এমন পরিস্থিতিতে সোমবার সকাল ১০টার দিকে আগারগাঁও মোড় আটকে বিক্ষোভ শুরু করে অটোরিকশার চালকরা। পুলিশের আশ্বাসে দুপুর ২টার দিকে অবরোধ প্রত্যাহার করে তারা।
এর আগে রবিবার (২৪ নভেম্বর) সন্ধ্যায় ফরেন সার্ভিস একাডেমি মিলনায়তনে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার জানান, ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে হাই কোর্টের দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এরপর সোমবার সকালে হাই কোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে চেম্বার আদালতে আবেদন জানায় রাষ্ট্রপক্ষ। সেই আবেদনের শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত ওই আদেশের ওপর স্থিতাবস্থা রাখতে বলায় আপাতত কেটেছে ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের বাধা।