অনুমোদন নেই, তবুও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পথে; এই ব্যাটারি রিকশাগুলোকে দেখে না দেখার ভান করে আসছিল সরকারের কর্তাব্যক্তিরা। কেউ আবার বলছিল- ‘বাংলার টেসলা’।
সেই ‘টেসলা’ বন্ধ করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার কয়েকমাস আগেই বিক্ষোভের মুখে পিছু হটেছিল। এখন হাই কোর্টের আদেশ হয়েছে তিন দিনের মধ্যে ঢাকায় এই যান চলাচল বন্ধ করার।
আদালতের এই আদেশের পরদিন বুধবারই ঢাকার দয়াগঞ্জে সংগঠিত হয়ে বিক্ষোভ করেছে ব্যাটারি রিকশার চালকরা। জীবিকায় হাত পড়েছে বলে তাদের ক্ষোভ। তারা চান, এই ত্রিচক্রযানের আইনি বৈধতা।
“আরে কইলেই হইব নাকি বন্ধ? যে রায় দিছে, সে জানে যে কত মানুষ চালায় এই রিকশা? যারা এডি বেচে তাগো ধরে না, আমগো গরিবগো উপর যত জুলুম,” আদালতের আদেশের খবর শুনে এভাবে ক্ষোভ জানান ব্যাটারি রিকশার চালক সিরাজ মিয়া।
তিনি গাইবান্ধা থেকে ঢাকায় এসেছেন ১০ বছর আগে, তখন থেকেই রিকশা চালান। প্রথম দুই বছর প্যাডেল রিকশা চালিয়েছেন। এরপর থেকে ব্যাটারি রিকশাই চালিয়ে যাচ্ছেন।
সিরাজ মিয়ার মতো কতজন রাজধানীতে ব্যাটারি রিকশা চালান, তার কোনও হিসাব নেই। তবে ধারণা করা হয়, ২ লক্ষাধিক ব্যাটারি রিকশা রয়েছে ঢাকা শহরে।
রিকশা চালকসহ মালিক, মেকানিক, গ্যারেজ মালিক, চার্জিংয়ে জড়িত ব্যক্তি, ব্যাটারি ও পার্টস ব্যবসায়ী সবাইকে মিলিয়ে এই খাতের সঙ্গে জড়িত লোকের সংখ্যা ১০ লাখ হবে।
বাংলাদেশের সড়কে এক সময় শুধু প্যাডেল রিকশা থাকলেও এক সময় চীন থেকে আসতে শুরু করে ব্যাটারির রিকশা। পরে স্থানীয়ভাবেই এগুলো তৈরি হতে থাকে।
গত কয়েক বছর ধরে ঢাকার অলি-গলিতেও ছড়িয়ে পড়ে এই রিকশাগুলো। প্রথমে বড় সড়কে না এলেও এখন ভিআইপি সড়ক বাদে সব সড়কেই চলছে এই বাহন।
ইজিবাইক ও ব্যাটারি রিকশার বড় বাজার ঢাকার কমলাপুরের বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়াম। পাশাপাশি নবাবপুর, বংশাল, উত্তরা ও ঢাকার মিরপুরে অটোরিকশার বাজার আছে। এসব বাহনে তৈরির যে যন্ত্রাংশ প্রয়োজন, তার বড় বাজার ঢাকার নবাবপুর এলাকা।
গত মে মাসে ঢাকায় ব্যাটারি রিকশা বন্ধ করতে গিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু চালকরা বিক্ষোভ শুরু করলে চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়।
প্যাডেল রিকশার মালিকদের এক রিট আবেদনে মঙ্গলবার হাই কোর্ট তিন দিনের মধ্যে ঢাকার ব্যাটারি রিকশার চলাচল বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছে।
এই আদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে ব্যাটারি রিকশার যাত্রীদের মধ্যে। কেউ কেউ মনে করছেন, বিকল্প ব্যবস্থা না করে এভাবে বন্ধ করে দেওয়া যৌক্তিক নয়। আবার কেউ প্রধান সড়ক থেকে সব রিকশা তুলে দিয়ে বাস বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছেন।
‘ইনকাম যেডায় বেশি, সেডাই তো চালামু’
প্যাডেল রিকশা ছেড়ে ব্যাটারি রিকশা চালানোতে ঝোঁকার বিষয়ে অধিকাংশ চালক বলছেন, শারীরিক শ্রম কম লাগে, আর আয় বেশি হয়।
সিরাজ মিয়া বলেন, “ইনকাম যেডায় বেশি, সেটাই তো চালামু। প্যাডেল রিকশা একদিন চালাইলে পরের দিন চালাইতে কষ্ট হইয়া যাইত। আর একটা খ্যাপ মারতেই অনেক সময় লাইগা যাইত। অটোয় তো বেশি খ্যাপ মারা যায়। ইনকামও বেশি হয়।”
সিরাজ মিয়া হিসাব করে বলেন, প্যাডেল রিকশা চালানোর সময় দিনে ৫ ঘণ্টায় ১০-১৫টি ট্রিপ দিতে পারতেন। ব্যাটারি রিকশায় ৩০-৩৫টি ট্রিপ দিতে পারেন।
এই রিকশা বন্ধের আদেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “আমি তো চুরি-ডাকাতি করতাছি না। নিজে নিজের কাম করতাছি। আমার কামে কেন সরকার গ্যাঞ্জাম করব?”
প্রায় একই রকম কথা বলেন ব্যাটারি রিকশার চালক মো. আতিয়ারও।
“আরে ভাই, কইলেই হইল নাকি। নিজের কর্ম করি। এখানে ঝামেলা করব কেন কেউ?”
এখন পুলিশের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আসল কথা পুলিশ কার্ড দিয়া টাকা খাইতে পারতাছিল না এতদিন। এখন এই আদেশের ভয় দেখাইয়া আবার টাকা খাইব। আদালত তো রায় দিয়া খালাস। জানে দেশে কেমনে কী হয়?”
আরেক চালক লুৎফুর রহমান বলেন, “কয়দিন পর পরই তো এসব নাটক করে। একটা নিয়মে নিয়া আইলে কী হয়? আমরাও সেই নিয়ম মাইন্যা চালামু। তা না হুদাই একটা গন্ডগোল লাগায় শুধু।”
রিকশা ভাড়া বেড়ে যাওয়ার শঙ্কায় যাত্রীরা
গত মে মাসে ব্যাটারি রিকশা বন্ধের ঘোষণার পর ঢাকায় রিকশা ভাড়াতেও তার প্রভাব পড়েছিল। ব্যাটারি রিকশা বন্ধ হওয়ার পর ২০ টাকা ভাড়ার দূরত্বে প্যাডেল রিকশা চালকেরা কয়দিন ৩০ থেকে ৪০ টাকাও চেয়েছিল।
এবারও সেই আশঙ্কাই করছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত দীপ্ত চৌধুরী। তার অফিস মতিঝিল। তিনি থাকেন গোড়ান টেম্পু স্টান্ডের কাছে। সেখান থেকে মতিঝিল যেতে প্রথমে তাকে খিলগাঁও রেলগেট যেতে হয় প্রথমে। তার বাসা থেকে রেলগেট পর্যন্ত ব্যাটারি রিকশায় ভাড়া ২০ টাকা।
দীপ্ত বলেন, “গতবার যখন বন্ধ করেছিল, তখন তো ভাড়া ২০ টাকার জায়গায় ৩০ টাকায় পৌঁছেছিল। এমনকি কেউ কেউ তো ৪০ টাকাও চেয়েছে। এখনও তাই হওয়ার সম্ভাবনা আছে।”
ব্যাটারি রিকশার নানা সমস্যার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ব্রেক নিয়ে সমস্যা রয়েছে। এগুলো হালকা বলে উল্টে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি। তাছাড়া এই বাহনগুলোর চালকদের সড়কে নিয়ম না মানার বিষয়টিও আলোচিত।
নানা পরিসংখ্যানের বরাতে অনেক আগে থেকেই বলা হচ্ছে, সড়কে তিন চাকার এ ধরনের যান দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশে দায়ী।
মঙ্গলবার আদালতের আদেশের দিনই ঢাকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাটারি রিকশার ধাক্কায় এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু সেই ঝুঁকির বিষয়টি আবার সামনে আনে।
দীপ্ত বলেন, ব্যাটারি রিকশার যদি নির্মাণ নকশায় সমস্যা থাকে, তা সেরে এগুলো তৈরি করা যায়। কারণ এই ধরনের রিকশা চালকদের শ্রমসাধ্য কাজ থেকে মুক্তি দিয়েছে।
“মানুষ মানুষকে টেনে নেবে, এটা তো ভালো না। যন্ত্রই এই কাজ করবে। যদি ঘাটতি থাকে, প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করে তা কাটানো যায়।”
অন্যদিকে ঢাকার সড়কে এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ যানসহ সব ধরনের রিকশাই তুলে দেওয়ার পক্ষপাতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সরফরাজের।
তিনি বলেন, “গণপরিবহন বাড়াতে হবে। রিকশা থাকলে রাস্তা স্লো হবেই। এলাকার বা ছোট গলির রাস্তায় শ্যাটল সার্ভিসের মতো কিছু ছোট যানবাহন থাকতে পারে।”
নীতিমালা কথায় আছে, কাগজে নেই
ব্যাটারি রিকশার বৈধতা নিয়ে বিতর্কের অবসান চায় এই খাত সংশ্লিষ্ট শ্রমিক সংগঠনগুলো। তারা বলছে, এভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষকে বিপদের ফেলার কোনও মানে হয় না। বরং দ্রুত সময়ের মধ্যে বিআরটিএ যেন ব্যাটারি রিকশাকে একটি নীতিমালার আওতায় আনে।
গত মে মাসে ব্যাটারি রিকশা বন্ধের বিরুদ্ধে যখন চালকরা আন্দোলনে নেমেছিল, তখন একটি নীতিমালা তৈরির আলোচনা হয়েছিল। তার আগেও এমন কথা উঠেছিল, তবে তা কখনও আলোর মুখ দেখেনি।
রিকশা ভ্যান ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম নাদিম বলেন, “১০ বছরের বেশি সময় ধরে লাইসেন্সের জন্য আন্দোলন করছি। কিন্তু কেউ শোনে না।”
প্যাডেল রিকশার জন্য সিটি করপোরেশন লাইসেন্স দিয়ে থাকে। কিন্তু ব্যাটারি রিকশার অনুমোদন নেই বলে লাইসেন্স নেওয়ার কোনও সুযোগও নেই।
দুর্নীতি টিকিয়ে রাখতেই নীতিমালা হয়নি দাবি করে নাদিম বলেন, “এই রিকশাকে এতদিন লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। মূল কারণ ছিল পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের লুটপাট। প্রত্যেক রিকশায় কার্ড বাবদ মাসে ৭০০-১৫০০ টাকা নিত তারা। আমরা তো ভাবি, এই সরকার এই সমস্যার সমাধান করবে।”
কিন্তু এবার আদালতের আদেশ আসায় আইনি পথও দেখতে হচ্ছে তাদের।
নাদিম বলেন, “আমরা আইনি লড়াইয়ে থাকব। একইসাথে রাজপথেও এই আদেশের বিরুদ্ধে আন্দোলন করব। আগামী রবিবার প্রেস ক্লাবে আমরা গণ অবস্থান কর্মসূচি নিয়েছি এরই মধ্যে।”