ভোর হলো, ইরান-ইসরায়েল সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে। দিনের সূর্য উঠেছে; তবে মধ্যপ্রাচ্যের আকাশ রাতেও আলোকিত থাকছে দুই পক্ষের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রে। আর তা ভূমিতে যখন পড়ে, হয়ে ওঠে প্রাণ সংহারক।
এই যুদ্ধ থেকে আত্মসমর্পণ করে সরে যেতে ইরানকে আহ্বান জানালেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই আহ্বানের থোড়াই পরোয়া করলেন ইরানকে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লাহ আলি খামেনি; তিনি বললেন, যুদ্ধ তো কেবল শুরু।
সোশাল মিডিয়ায় ট্রাম্প ও খামেনির পোস্ট বুধবার এসে এই বার্তা দিচ্ছে যে সংঘাত থামছে না, বরং বেড়েই যাবে। যার মানে বিশ্ববাসীর উদ্বেগ কমার কোনও লক্ষণ আপাতত নেই।
বছরজুড়ে উত্তেজনার গত ১৩ জুন ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়ে শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করে ইসরায়েল।
তার জবাবে ইরান ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে। তারপর থেকে টানা সংঘাত চলছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিমানশূন্য হয়ে পড়া আকাশে এখন দেখা যাচ্ছে শুধু ক্ষেপণাস্ত্রের ওড়াওড়ি।
ওয়াশিংটন এই যুদ্ধে জড়াবে না বলে ট্রাম্প শুরুতে বললেও তেল আবিবে তাদের দূতাবাস আক্রান্ত হওয়ার পর তার মনোভাব যে বদলেছে, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করা সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
ওয়াশিংটনের দুই কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেন, ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর বিষয়ে ক্রমশ আগ্রহী হয়ে উঠছেন এবং ক্রমবর্ধমান সংঘাত অবসানের জন্য একটি কূটনৈতিক সমাধানের ধারণা থেকে ক্রমেই সরে আসছেন।
ট্রাম্প এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু উভয়ই ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে লক্ষ্যবস্তু করার সম্ভাবনা তুলে ধরেছেন।
ট্রাম্প মঙ্গলবার বলেন, তেহরানে খামেনি কোথায় আছেন, তা তার জানা। অর্থাৎ চাইলেন তার আস্তানায় হামলা চালাতে পারেন। তবে এখন তনি তা করছেন না।
এর আগে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ বলেছিলেন যে খামেনির পরিণতি হবে ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের মতো। অর্থাৎ উৎখাতের পর ফাঁসির দড়িতে ঝোলা।
ইরান পরমাণু আলোচনা থেকে সরে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প এটাও বলেন যে যুক্তরাষ্ট্রের ধৈর্য ফুরিয়ে আসছে। ইরানকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে আহ্বান জানান তিনি।
এর কয়েক ঘণ্টা পরই খামেনি সোশাল মিডিয়ায় এক পোস্টে বলেন, “যুদ্ধ তো কেবল শুরু হলো।”
খামেনির ওপর হামলা হলে জটিল মধ্যপ্রাচ্য আরও জটিল হয়ে উঠবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানের ক্ষমতা কাঠামোয় যে পরিবর্তন আসে, তার ধারাবাহিকতায় চার দশক ধরে ইরানের সর্বোচ্চ পদটি ধরে আছেন খামেনি।
লৌহকঠিন হাতে তিনি দেশ শাসন করেছেন, দেশের অভ্যন্তরে ভিন্ন মত কঠোরভাবে দমনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পারমাণবিক কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
সর্বোচ্চ নেতা হিসাবে খামেনি ৯ কোটি মানুষের ইরানে সরকার, বিচার বিভাগ এবং সামরিক বাহিনীর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।
ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী এবং কুদস ফোর্সেরও নিয়ন্ত্রণও তার হাতে। বলা হয়, ইরানের হয়ে প্রক্সি ওয়ার বা ছায়াযুদ্ধ চালানো ফিলিস্তিনের হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতিরাও চলে তার আঙুলের ইশরায়।
১৯৩৯ সালে ইরানের মাশহাদে জন্ম খামেনির। তিনি ছিলেন ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির অনুসারী। ১৯৭৯ সালে ইরানে রাজতন্ত্র উৎখাত করে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় খোমেনির নেতৃত্বে।
১৯৮৯ সালে খোমেনির মৃত্যুর পর খামেনি বসেন সর্বোচ্চ নেতার চেয়ারে। তারপর তিনি তার প্রভাব ইরানের সীমানা ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে বিস্তৃত করেছেন।
খামেনির নেতৃত্বে ইরান এতদিন ধরে তার আঞ্চলিক প্রতিপক্ষদের সঙ্গে সরাসরি সংঘাত এড়িয়ে চললেও ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরুর মধ্য দিয়ে তার মনোভাব পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলছে।
খামেনির সর্বশেষ পোস্ট দেখে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিসি গ্রুপের ইরান সম্পর্কিত বিভাগের পরিচালক আলি ভেজ বলছেন, আত্মসমর্পণের যে আহ্বান ট্রাম্প জানিয়েছেন, তাতে ইরানের সাড়া দেওয়ার সম্ভাবনা কম। তার মানে গোটা মধ্যপ্রাচ্য এখন ঝুঁকিতে।
তিনি বলেন, ইরানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ট্রাম্প হামলার জন্য ইসরায়েলকে সবুজ সঙ্কেত দিচ্ছেন।
“এখন এক হতে পারে ইরানের ওপর আক্রমণ, তাতে ক্ষমতার পতন এবং আত্মসমর্পণ। ঝুঁকিটা হলো ইরানের ক্ষমতাসীনদের যদি পতন ঘটে, তখন তারা গোটা অঞ্চলকে নিজেদের সঙ্গে নিচে নামিয়ে আনার চেষ্টা করবে এবং তখন আঞ্চলিক সংঘাত ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়বে।”
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা, সিএনএন, রয়টার্স