Beta
শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫
ঋণ খেলাপি রুখতে কঠোর বাংলাদেশ ব্যাংক

কী আছে ১১ দফায়

ব‍্যাংক মালিক-ব‍্যবস্থাপক
মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন।
[publishpress_authors_box]

ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে ৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য হাতে নিয়েছে ১১ দফা কর্মপরিকল্পনা (রোডম্যাপ)।

এক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তাদের তালিকা করে সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে পাঠানো হবে। এছাড়া তাদের ব্যবসা সংকুচিত করে আনা এবং বিলাসী জীবন-যাপন করতে না দেওয়ার মতো কঠোর পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নে হাত দেওয়া হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে ঋণের টাকা ফেরতের সংস্কৃতি গড়ে উঠবে বলে মনে করছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।

রবিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্ত্বে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত পর্ষদ সভায় ১১ দফা কর্মপরিকল্পনা অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর এক সংবাদ সম্মেলনে এই কর্মপরিকল্পনার বিস্তারিত তুলে ধরেন ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাছের।

খেলাপি ঋণ আদায়ের পাশাপাশি ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে আরও ৬ দফা কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়ার কথাও জানান তিনি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা, যা ছিল তখন পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

আগামী আড়াই বছরের মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমিয়ে ১০ শতাংশের মধ্যে এবং বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা এই কর্মপরিকল্পনার আরেকটি লক্ষ্য।

একইসঙ্গে সীমার অতিরিক্ত ঋণ, বেনামি ঋণ ও জালিয়াতি বা প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ বিতরণের পরিমাণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে এই ১১ দফা কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাছের বলেন, ২০২৩ সালের ২৬ জুন ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের সংজ্ঞা অন্তর্ভূক্ত করা হয়। তাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়।

এই ক্ষমতা অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের তালিকা প্রণয়ন করে সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে পাঠাতে পারবে। একইসঙ্গে বিদেশ ভ্রমণ, ট্রেড লাইসেন্স প্রাপ্তি, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার ধারণে নিষেধাজ্ঞায় পড়বে। এমনকি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির পরিচালকও থাকতে পারবে না।

তাছাড়া কোনও ব্যাংক কোম্পানির পরিচালক একবার ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হলে পরবর্তী ৫ বছর তিনি আর ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না বলে জানান ডেপুটি গভর্নর।  

এই কর্মপরিকল্পনার প্রথম দফায় বলা হয়, ব্যাংকগুলোকে এখন থেকে কোনও ঋণ একটানা দুই বছর মন্দ বা ক্ষতিজনক মানে শ্রেণিকৃত বা খেলাপি থাকলে ওই ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রেখে অবলোপন করতে হবে। এতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ৭৬ শতাংশ কমে আসবে। বর্তমানে এ ধরনের খেলাপি ঋণ ৩ বছর পর শতভাগ প্রভিশন সাপেক্ষে অবলোপনা করতে পারে ব্যাংক।

দ্বিতীয় দফার কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে অবলোপন করা খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্যে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) তত্ত্বাবধানে একটি আলাদা ইউনিট গঠন করতে হবে। এই ঋণ আদায়ের লক্ষ্য অর্জন এমডির কর্মদক্ষতার মূল্যায়নে বিবেচনা করা হবে।

তৃতীয় দফার কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে বেসরকারি খাতে একটি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের কথা বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইতোমধ্যে একটি খসড়া আইন প্রস্তুত করে মতামতের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে বলেও জানান মো. নাছের।

চতুর্থ কর্মপরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে, ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে আরোপিত সুদ আদায় না হওয়া পর্যন্ত আয় খাতে না দেখানো। এটা স্থিতিপত্রে আলাদাভাবে দেখাতে হবে। এতে সুদ আদায় বাড়বে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেননা, অনাদায়ী সুদ আয় খাতে দেখাতে না পারলে ব্যাংকের কোনও উপকারে আসবে না।

পঞ্চম দফার কর্মপরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে, ইতোপূর্বে নমনীয়ভাবে ঋণ পরিশোধের জন্য দেওয়া সুবিধাগুলোর মেয়াদ আর বাড়ানো যাবে না। এতে ঋণ পরিশোধ বাড়বে ও ব্যাংকের তারল্য সংকট কমে আসবে। আদায় করা ঋণের টাকা নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারবে ব্যাংক।

ষষ্ঠ দফার কর্মপরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে, মেয়াদি ঋণ পরিশোধের সময় পার হওয়ার সংজ্ঞা—এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্যর্পূর্ণ করা এবং এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট নীতিমালা সংশোধন ও হালনাগাদ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে আর্থিক খাত সংস্কারের শর্তও পূরণ হবে বলে মনে করছে সংস্থাটি।

সপ্তম দফার কর্মপরিকল্পনার মধ্যে ব্যাংকগুলোর আইন বিভাগকে শক্তিশালী করার কথা বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। বর্তমানে অর্থঋণ আদালতে ৭২ হাজার ৫৪৩টি মামলা রয়েছে। এই মামলাগুলোয় আটকে রয়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা।

অষ্টম দফার কর্মপরিকল্পনায় বলা হয়, অর্থঋণ আদালত আইন-২০০৩ এর আওতায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির পদ্ধতিতে আদালতের বাইরে মামলা নিষ্পত্তির জন্য ব্যাংকগুলোকে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে মামলা দ্রত নিষ্পত্তি হবে বলে আশা করছে সংস্থাটি।

নবম দফার কর্মপরিকল্পনায় বলা হয়, ব্যাংক কোম্পানি আইনে সংজ্ঞায়িত ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। এতে ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ পরিশোধ না করা কমে আসবে।

দশম দফার কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, ব্যাংকের কর্মীদের খেলাপি ঋণ আদায়ে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বিশেষ ভাতা চালু করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

একাদশ দফার কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নিজস্ব মূল্যায়নের পাশাপাশি তালিকাভুক্ত জামানত মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঋণের বিপরীতে প্রদত্ত জামানত মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করা হবে। এতে অতিমূল্যায়িত জামানতের বিপরীতে ঋণ দেওয়া বন্ধ হবে। সঠিক জামানত থাকলে ভবিষ্যতে এসব ঋণ আদায়ও সহজ হবে।

ব্যাংক খাতে সুসাশন নিশ্চিতের লক্ষ্যে নির্ধারিত ৬ দফার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়া। ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ ও তাদের সম্মানির জন্য নতুন নীতিমালা প্রণয়ন, ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের নিয়োগ ও পুনঃনিয়োগের নীতিমালা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা, একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রম না করার বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করা এবং ব্যাংক কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে মৌলিক প্রশিক্ষণ ও প্রফেশনাল পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত