Beta
শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

ডলার বিক্রির চাপেই কমছে রিজার্ভ, ৭ মাসে ৮ বিলিয়ন বিক্রি

dollar
Picture of আবদুর রহিম হারমাছি

আবদুর রহিম হারমাছি

জ্বালানি তেল, সারসহ সরকারি কেনাকাটার খরচ মেটাতে রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের কাছে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

চাহিদার কারণে গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় এই অর্থবছরেও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রাখা হয়েছে, যা উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি) সব মিলিয়ে ৮০০ কোটি (৮ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করা হয়েছে। ২০২১ সালের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত—আড়াই বছরে বিক্রি করা হয়েছে ২৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।

আর এ কারণে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে উল্লম্ফন দেখা দিলেও রিজার্ভ কমে ফের ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।

তবে বাড়তে বাড়তে ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ৪৮ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল।

গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৪ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ২১০ কোটি ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছে প্রবাসীরা। এই অঙ্ক সাত মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৬ কোটি ৭৭ লাখ ডলার।

৭ মাস পর ২.১০ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স আসল দেশে। গত বছরের জুনে ২ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।

গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা প্রায় ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। ওই অঙ্ক ছিল ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আগের দুই মাস অক্টোবর ও নভেম্বরেও বেশ ভালো রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। অক্টোবরে এসেছিল ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ (১.৯৮ বিলিয়ন) ডলার; নভেম্বরে ১৯৩ কোটি (১.৯৩ বিলিয়ন) ডলার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ হিসাবে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক শূন্য নয় বিলিয়ন ডলার।

আগের সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক শূন্য দুই বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার।

গ্রস রিজার্ভ বা মোট রিজার্ভ আসলে কী? আইএমএফের ব্যালেন্স অব পেমেন্টস এবং ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল-৬ (বিপিএম-৬) অনুযায়ী এটি হলো রিজার্ভ সম্পদের পরিমাণ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো আস্থার সঙ্গে এই হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করে।

তবে বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভকে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’ রিজার্ভ হিসেবে দাবি করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সবশেষ গত নভেম্বর মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৫ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সেই হিসাবে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’ ১৯ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ রিজার্ভ মজুত থাকতে হয়।

এর আগে গত বছরের ৭ নভেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছিল। কমতে কমতে গত ১৩ ডিসেম্বর রিজার্ভ ১৯ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।

এরপর আইএমএফ ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ৬৯ কোটি ডলার, ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ৪০ কোটি ডলার এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ৯ কোটি ডলার যোগ হওয়ায় বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ বেড়ে ২১ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে উঠে। ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

জরুরি আমদানিতে সহায়তা দিতে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রির কারণেই মূলত রিজার্ভ কমেছে। যদিও আমদানি নিয়ন্ত্রণে রাখার নানা পদক্ষেপ চলমান রেখেছে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, আগের চেয়ে বেশি দর পাওয়ার কারণে রেমিটেন্স বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ব্যাংকগুলো ডলারের যে দর ঘোষণা করছে, তার চেয়ে বাস্তবে বেশি। ডলারের সংকট থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে তেমন কড়াকড়ি করছে না।

এতে করে ব্যাংকিং চ্যানেলের দিকে আগ্রহ বাড়ছে বিদেশে কর্মসংস্থানে থাকা বাংলাদেশিদের। অবশ্য বিদেশে কর্মী যাওয়ার হার যেভাবে বেড়েছে, সে তুলনায় রেমিট্যান্স আরও বেশি আসার কথা। ফলে একটি বড় অংশ হুন্ডির মাধ্যমে আসছে।

জ্বালানি তেল, সারসহ সরকারি কেনাকাটায় প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে চলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

রিজার্ভ থেকে এখন আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের দরে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত সোমবার আন্তঃব্যাংকে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ১১০ টাকা। আগে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের চেয়ে ২/৩ টাকা কম দামে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত জুলাই থেকে আর কম দামে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে না।

তবে সব ব্যাংককে রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করা হচ্ছে না। সরকারের প্রয়োজনীয় আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

অন্য ব্যাংকগুলোকে আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ডলার কিনে আমদানি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে।

বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত, গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক এখন রিজার্ভ। এই রিজার্ভ কমতে কমতে উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে এসেছে। আর এর জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি একটি কারণ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে রিজার্ভ থেকে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছিল। তার আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) বিক্রি করা হয়েছিল ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।

কোভিড-১৯ অতিমারীর কারণে আমদানি কমে যাওয়ায় এবং রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ায় বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ায় ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজার থেকে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

সব ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী ডলার বিক্রি করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সঞ্চিত রিজার্ভ আরও কমে যাবে। সেজন্য সরকারের প্রয়োজনেই শুধু রিজার্ভ থেকে ডলার ছাড়া হচ্ছে।

আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতেও নানা কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে; তারপরও পতন ঠেকানো যাচ্ছে না।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ২০২২ সালের মার্চ থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এতে সংকট আরও বেড়ে যায়।

পরে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এ দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) ওপর।

এরপর থেকে এই দুই সংগঠন মিলে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় এবং আমদানি দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত কার্যকর করছে এই দুই সংগঠন।

তবে, এবিবি ও বাফেদার সিদ্ধান্ত অনেক ক্ষেত্রেই মানেনি ব্যাংকগুলো। অনেক ব্যাংক এই দুই সংগঠনের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়েও বেশি দামে রেমিটেন্স সংগ্রহ করেছে। এজন্য কয়েক দফায় কয়েকটি ব্যাংককে সতর্ক করার পাশাপাশি জরিমানাও করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রায় দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব সব দেশেই পড়েছে। সব দেশেই ডলারের দর বেড়েছে; মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল। সামাল দিয়ে তারা কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সব দেশেই মূল্যস্ফীতি কমে সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি ৭০ শতাংশে উঠে গিয়েছিল; এখন ৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছে তারা।

“কিন্তু আমাদের মূল্যস্ফীতি কমছে না। ডলার সংকট কাটছে না; ডলারের বাজারে অস্থিরতা যাচ্ছে না। রিজার্ভ কমছেই। তাহলে প্রশ্ন জাগে সব দেশ পারলে আমরা পারছি না কেন? আমাদের গলদ কোথায়? আমরা কী ঠিকঠাক মতো ব্যবস্থাপনা করছি না।?”

“এখানে দুটি বিষয় আমি পরিস্কারভাবে উল্লেখ করতে চাই। দীর্ঘদিন ডলারের দর ধরে রেখে আমরা ঠিক কাজটি করিনি। ওইটা ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত।”

“আরেকটি ভুল ছিল আমাদের- মূল্যস্ফীতি বাড়ছিল; তারপরও আমরা ৯ শতাংশ সুদহার দীর্ঘদিন ধরে রেখেছিলাম। এখন অবশ্য সুদের হার বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এই দুই ভুলের মাশুলই আমাদের এখন দিতে হচ্ছে। আরও কতদিন দিতে হবে কে জানে?”

“কতদিন রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হবে, তাও কিছু বলা যাচ্ছে না” যোগ করেন দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত