Beta
শনিবার, ১৫ মার্চ, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৫ মার্চ, ২০২৫

ফারুক আহমেদ নিশ্চয়ই সালাউদ্দিন হবেন না

বিসিবির নতুন সভাপতি ফারুক আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
বিসিবির নতুন সভাপতি ফারুক আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
[publishpress_authors_box]

কী অসম্ভব সম্ভবের ভাগ্য নিয়ে এসেছেন ফারুক আহমেদ। পাকিস্তানের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয় দিয়ে শুরু করেছেন বিসিবির নতুন সভাপতি। এমন সৌভাগ্য ক’জনের হয়!

দেশের ক্রিকেট সমুদ্রে ঢেউ তুলে ফারুক আহমেদ বিসিবির সভাপতি পদে বসেছেন। নতুন সভাপতির প্রথম জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের অভিযোগ-অনুযোগের শেষ ছিল না। প্রশ্নগুলো আসলে অভিযোগের মতো শুনিয়েছে বেশি।

হয়তো-বা আগের বোর্ড প্রধানের সামনে বলার উপায় ছিল না। যেমন দুর্নীতি, লঙ্কান সিন্ডিকেট, হাথুরুসিংহে প্রসঙ্গ ইত্যাদি। ক্রিকেট বিচ্যুতির ব্যাপারগুলো শুনতে নতুন সভাপতিরও বোধহয় মন্দ লাগেনি, কৌশলে বোর্ডের পুরনো সভাসদদেরও পাশে বসিয়ে শোনালেন তাদের অতীত অনাচারগুলি।

দুজনই খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করে সভাপতি হয়েছেন। কাজী সালাউদ্দিন আছেন ১৬ বছর। আর ফারুক আহমেদ নতুন শুরু করেছেন। ছবি: সংগৃহীত

এজন্যই তিনি হয়তো বারবার নিজেকে সৎ দাবি করেছেন সংবাদ সম্মেলনে। তার প্রমাণ দিতে হবে এবার। বিসিবির গুণগত পরিবর্তন, বিকাশ ও পরিণতির দিকে তাকিয়ে সবাই। একই সঙ্গে স্থানু হয়ে পড়া মাঠের ক্রিকেট পারফরম্যান্সের আরেকধাপ উল্লম্ফনও দরকার। শেষমেষ প্রশাসনিক সংস্কার ও খেলোয়াড়দের মাঠের পারফরম্যান্স মিলিয়েই সংগঠক ফারুক আহমেদের সাফল্য-ব্যর্থতার মূল্যায়ন হবে।  

সফল হলে ফারুকের মাথায় উঠবে এক অবিশ্বাস্য বিজয় মুকুট। তিনি হবেন সভাপতি পদে কোনও খেলোয়াড়-সংগঠকের সাফল্যের নতুন ‘ট্রেন্ডসেটার’। যা দেশের ক্রীড়াঙ্গনে কোনও খেলোয়াড়ের ভাগ্যে এখনও জোটেনি। তাই এখনও বলা হয়, ভাল খেলোয়াড়ের ভাল প্রশাসক হয়ে ওঠা কঠিন। এটা এক অদ্ভুত গেরো।

এই গেরো খোলার ভাল সুযোগ ছিল ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের। এই ফুটবল কিংবদন্তি খেলার মাঠে যা সুনাম কামিয়েছিলেন ১৬ বছরের সাংগঠনিক ক্যারিয়ারে তার সবটুকু জলাঞ্জলি দিয়ে এখন নিঃস্ব প্রায়। ডাহা ফেল মেরে প্রতিদিনই শুনছেন ফুটবল সমর্থকদের দুয়োধ্বনি।

এমন মহাতারকার স্খলন-কাহিনী ফারুকের জন্য অবশ্য পাঠ্য হতে পারে। সাফল্য-বটিকার বই-পত্র আপনি হাতের কাছে পাবেন। পাশাপাশি ব্যর্থতার কানা-ঘুপচি পথগুলো জানা থাকলে আপনি সতর্ক হতে পারবেন। 

বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। ছবি: সংগৃহীত

কাজী সালাউদ্দিনও ২০০৮ সালে ফুটবলের হাল ধরেছিলেন প্রবল আশা জাগিয়ে। প্রথম চার বছরের কর্মকাণ্ড ইতিবাচকই ছিল। এরপর থেকেই ফুটবলের অন্দর-বাহির চলেছে একদম তার খেয়াল-খুশি মতো। জালিয়াতি ও দুর্নীতির আখড়া হয়ে ওঠে বাফুফে। এই দাবি দেশের মিডিয়া করলে সালাউদ্দিন অস্বীকার করতেন। কিন্তু ফিফা যখন বাফুফের দুর্নীতির শিরোপা জয়ের খবর বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে তখন ‘চোরের সর্দার’ হয়েই বাঁচতে হবে তাকে।

২০২৩ সালে ফিফা বাফুফের গায়ে দুর্নীতির সিলমোহর লাগিয়ে নিষিদ্ধ করে সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগকে। চলতি বছর আর্থিক কেলেঙ্কারির দায়ে ফিফা নিষিদ্ধ করে বাফুফের আরও দুই নির্বাহীকে এবং জরিমানা করে সিনিয়র সহ সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদীকে। অনেকে সালাউদ্দিনের ছত্রছায়ায় এসব হয়েছে বলে মনে করলেও বাফুফে সভাপতি নাকি কিছুই জানতেন না।

না জানাটাও তার বড় অপরাধ। ক্রিকেটে নাজমুল হাসান পাপন জানতেন কিনা কে জানে, তবে এখন সবাই সোচ্চার হচ্ছে বিসিবির দুর্নীতি নিয়ে। মূলত কয়েকজন পরিচালকের দিকেই উঠছে সন্দেহের আঙুল। তাদের বাণিজ্য বিসিবির সঙ্গেই!

ফুটবলেও সালাউদ্দিনের দুই কাছের সঙ্গী ভুয়া নামে বাফুফের সঙ্গে বাণিজ্য করতে গিয়েই ধরা খেয়েছে। কারণ ফিফার গাইডলাইনে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের সংঘাতের ব্যাপারে কড়া বিধি-নিষেধ আছে। থাকা উচিত ক্রিকেটেও। অথচ বিসিবির কোচ নিয়োগের পেছনে আছে বাণিজ্য, তারই অংশ হিসেবে এক পরিচালকের উৎসাহে লঙ্কান কোচের বড় বলয় তৈরি হয়েছে দেশের ক্রিকেটে। নতুন স্টেডিয়াম তৈরির নামে ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়েছে প্রায় ৮৬ কোটি টাকা পরামর্শক ফি। পরামর্শের জন্যই এত বড় অঙ্ক দিলে কাজ শুরু হলে কী হবে! কেউ কেউ দুর্নীতির মোচ্ছব দেখতে পাচ্ছেন।  

মিরপুরে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ। ছবি: বিসিবি

সেই জায়গা থেকে বিসিবিকে বের করে আনার উদ্যোগ নিতে হবে নতুন সভাপতিকে। তার সুনাম ও শুদ্ধতা খুব জরুরী। যে কোনও প্রতিষ্ঠানের শুদ্ধতার বড় নিয়ামক হচ্ছে তার দুর্নীতিমুক্ত আর্থিক শৃঙ্খলা। তা নিশ্চিত করতে পারলে মাঠের বাইরে বিসিবি ইমেজ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে।

আরেকটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো নেতৃত্বের স্বৈরাচারী মনোভাব। যার বড় উদাহরণ কাজী সালাউদ্দিনের ফুটবল সভা। দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর বদলে যায় তার ফুটবল দরবারের চরিত্র। নির্বাচিত কমিটি গৌণ হতে থাকে। গুরুত্ব বাড়তে থাকে বিশেষ দুই নর-নারীর। মহিলা ফুটবলের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ ও বাফুফের সাবেক সম্পাদক সোহাগের যত্ন-আত্তিতে বাঁধা পড়েন সভাপতি।

তাদের খেয়ালেই চলেছে ফুটবল, কোনও রকমের পরিকল্পনা ও দূরদর্শী চিন্তা ছাড়া। এরই খেসারত দিচ্ছে ফুটবল। এখন দক্ষিণ এশিয়ার মর্যাদাহীন এক দল বাংলাদেশ, যার পাইপলাইন বলে কিছু নেই। ফিফার টাকায় একটি একাডেমি শুরু করে এক বছর চালিয়ে লোপাট করে দেয় ৭ কোটি টাকা।

বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। ছবি: সংগৃহীত

ক্রিকেটের পাইপলাইনে প্রতিভার উন্মেষ থাকলেও তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। দেশজুড়ে ক্রিকেটার হওয়ার হিড়িক থাকলেও লাল-সবুজের জার্সিতে নেই তার যথার্থতা। এই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিসিবির সেতুবন্ধন রচনায় কোথাও ফাঁক আছে। হয়তো-বা ক্রিকেট অবকাঠামোয় আছে বড়সড় গলদ। এখানে সংস্কার না করলে ক্রিকেটের ভবিষ্যৎও থাকবে ঝুঁকির মুখে।

১৯৮৬ সালে প্রথম অফিসিয়াল ওয়ানডে ধরলে গত ৩৮ বছরে বাংলাদেশের কোনও বৈশ্বিক ট্রফি জয়ের গৌরব নেই। তাই বলি, সালাউদ্দিনের মতো অলক্ষ্যে পথ চললে ভাগ্যও মুচকি হাসবে ফারুকের সঙ্গে। নির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং কখন কোন মাইলস্টোনে পৌঁছাতে চাই, তার একটা বাস্তব রোডম্যাপ থাকা উচিত। নইলে বিদায়ী সভাপতির মতো তাকেও ব্যর্থতার মিছিলে দাঁড়িয়ে ‘পরের বিশ্বকাপ’-এর কথা বলে যেতে হবে বারবার।

বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ কথা বলছেন সংবাদ সম্মেলনে। ছবি: বিসিবি

তার একটি বড় সুবিধা হলো, ক্রিকেটে টাকার অভাব নেই। ১১’শ কোটি টাকার ফিক্সড ডিপোজিট আছে। সেদিক থেকে সালাউদ্দিন দুর্ভাগা, অর্থের টানাটানিতে চলে ফুটবল। ফুটবলের মান তলানিতে নামার প্রসঙ্গ উঠলেই তিনি অর্থাভাবের কথাই ফলাও করে বলেন। অর্থাভাব মিটে গেলে যেন ফুটবলকে বিশ্বকাপে নিয়ে যেতেন! সত্যিটা হলো, পুরো টাকশাল দিয়ে দিলেও তিনি পারতেন না। কারণ এই টানাটানির মধ্যেও যারা আর্থিক জালিয়াতিতে ফিফার শিরোপা জিততে পারে, তাদের নিয়ত নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে বৈকি।

ফারুক আহমেদকেও খাস নিয়তে চেষ্টা করতে হবে। শুরুতে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ভাগ্য নিয়ে সন্দেহ নেই। সততার কথা তিনি বারবার বলেছেন। এগুলো ঠিকঠাক থাকলে খেলোয়াড়-সংগঠক হিসাবে সাফল্যের নতুন অধ্যায় শুরু হবে এই ক্রিকেট তারকাকে দিয়ে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত