যে আইনে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার সেই আইনেই ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করল অন্তর্বর্তী সরকার। ওই আইনের তফসিল-২ এ ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ নামের ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্ত্বা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
বুধবার রাতে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপনে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের একাধিক কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রায় ৭৬ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম নিষিদ্ধ হলো ছাত্রলীগ।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হত্যা, নির্যাতন, গণরুম কেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ নানাবিধ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল এবং এতৎসম্পর্কিত প্রামাণ্য তথ্য দেশের সকল প্রধান গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এবং কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হয়েছে।”
প্রজ্ঞপনে আরও বলা হয়েছে, “গত ১৫ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ জনগণকে উন্মত্ত ও বেপরোয়া সশস্ত্র আক্রমণ করিয়া শতশত নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও ব্যক্তিদের হত্যা করেছে এবং আরও অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করেছে।”
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, “যেহেতু সরকারের নিকট যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে যে, চলতি বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক, ধ্বংসাত্মক ও উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যের সঙ্গে জড়িত রয়েছে; সেহেতু সরকার সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯ এর ধারা ১৮ এর উপ-ধারা (১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল এবং উক্ত আইনের তফসিল-২ এ বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নামীয় ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্ত্বা হিসাবে তালিকাভুক্ত করল।”
এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলেও প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন।
গত জুলাই মাসে কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকর্মীদের সংঘাতের পর আন্দোলন জোরদার হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ওই আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। তারপর থেকেই আওয়ামী লীগের পাশাপাশি দলটির ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধের দাবি ওঠে।
গত সোমবার ‘সন্ত্রাসী ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ও ফ্যাসিবাদের দোসর রাষ্ট্রপতি চুপ্পুর (রাষ্ট্রপতির ডাকনাম) পদত্যাগের দাবিতে বিপ্লবী ছাত্র-জনতার গণজমায়েত’ কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
এর অংশ হিসেবে মঙ্গলবার বিকাল ৩টা থেকে শহীদ মিনারে অবস্থান নেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। সেখানে চলতি সপ্তাহের মধ্যেই রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ ও ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধের দাবি জানানো হয়। এ সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে রাষ্ট্রপতির বাসভবন বঙ্গভবন ঘেরাওয়ের হুমকিও দিয়েছে সংগঠনটি।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে গঠিত হয় ‘পাকিস্তান ছাত্রলীগ। পরবর্তীতে সংগঠনের নাম হয় ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’।
১৯৪৮ সালেই মাতৃভাষার পক্ষে ছাত্রলীগ আপসহীন অবস্থান তৈরি করে। ১৯৫৬ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি আদায়, ঐতিহাসিক ‘ছয় দফা’ আন্দোলনে রাজপথের প্রথম সারির ভূমিকায় ছিল ছাত্রলীগ।
ছাত্রলীগের নেতৃত্বেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে ছাত্র গণ-আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এরপর একাত্তরে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
১৯৭২ সাল থাকে ১৯৭৫ কালপূর্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনের সংগ্রামে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। সামরিক শাসনের মধ্যেও ১৯৮৩ সালে শিক্ষা আন্দোলন ও সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের ১০ দফা তৈরিতে নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
এরপর বিভিন্ন সময় নিজেদের মধ্যে দলাদলি, অন্তর্কোন্দল, প্রতিপক্ষের ওপর হামলাসহ নানা কারণে সমালোচনার মুখে পড়ে ছাত্রলীগ।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। তারপর থেকে আত্মগোপনে আছেন দলটির প্রথম সারির প্রায় সব নেতাই।
আত্মগোপনে আছেন ছাত্রলীগের প্রথম সারির নেতারাও। এর মধ্যে গত আড়াই মাসে অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন, অনেকে আবার দেশ ছেড়েছেন বলে খবর মিলছে।