চাকরিতে কোটা নিয়ে এখন যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে, তার সমাধান আদালত থেকেই আসবে বলে মনে করছে ছাত্রলীগ।
যারা আন্দোলন করছেন, আপিল বিভাগের আদেশের পর জনদুর্ভোগ সৃষ্টির মতো কর্মসূচি না দিয়ে তাদের ক্লাসে ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা।
সর্বোচ্চ আদালতের আদেশের পরও আন্দোলনের কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার মধ্যে রাজনৈতিক ইন্ধন রয়েছে বলে সন্দেহ করছে সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনটি।
সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল করে হাইকোর্টের রায়ের পর থেকে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে আন্দোলন শুরু হয়েছে।
আন্দোলনকারীরা প্রতিদিন ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করছে। এই কর্মসূচি পালনে প্রতিদিন সড়কে অবস্থান নিচ্ছে তারা। এতে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে জনদুর্ভোগ দেখা দিচ্ছে।
আদালতে বিচারাধীন এই বিষয়ে বুধবার আপিল বিভাগে শুনানি হয়েছে। প্রধান বিচারপতি এই বিষয়ে কোনও বক্তব্য আদালতে উপস্থাপনের পরামর্শ দিয়ে আন্দোলন না করতে শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন।
এই প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলনে এসে এই আন্দোলন নিয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে ছাত্রলীগ।
সংগঠনটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট কিছু বক্তব্য রাখা প্রয়োজন অনুভব করেই তারা সংবাদ সম্মেলনে এসেছেন।
বিষয়টি যে আদালতে বিচারাধীন, তা দেখিয়ে তিনি বলেন, বলেন, “এটি আপিল বিভাগের বিচারাধীন বিষয়।
“সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়ে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এর একটি যৌক্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক, যুগোপযোগী ও টেকসই সমাধান আমরা প্রত্যাশা করছি।”
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, “বুধবার আদালত একটি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। আপিল বিভাগ চার সপ্তাহের সময় নিয়েছেন। কারও কোনও কথা থাকলে তা আদালতে বিস্তারিত বলতে পারবে।
“এমন অবস্থায় আদালতের এই আদেশ নিয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা আদালত অবমাননার শামিল হবে বলেই মনে করি।”
ছয় বছর আগে এক আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করেছিল সরকার। তার আগে চাকরিতে নিয়োগে ৫৬ শতাংশ পদ বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষণ করা হতো।
৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তখন একটি আবেদন হলে গত ৫ জুন হাইকোর্ট রায়ে ওই কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত জানায়।
এরপরই কোটা বাতিলের আন্দোলন পুনরায় শুরু হয়। বেশিরভাগ ছাত্র সংগঠন সাংগঠনিকভাবে এই আন্দোলনে না থাকলেও তাদের কর্মীরা রয়েছে। ছাত্রলীগ পরোক্ষভাবে আন্দোলনে বাধা দিচ্ছে বলেও অভিযোগ এসেছে কর্মসূচি পালনকারীদের মধ্য থেকে।
এদিকে হাইকোর্টের রায় স্থগিতে সরকার আবেদন করার পর আপিল বিভাগ নিয়মিত আপিল আবেদনের নির্দেশ দেয়। পাশাপাশি চার সপ্তাহের জন্য হাই কোর্টের রায়ের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করে।
আন্দোলনকারী আপিল বিভাগের রায়কে ইতিবাচক বললেও সরকারের কাছে কোটা সংস্কারের দাবি জানিয়ে বলছে, তা নাহলে তারা আন্দোলন থেকে সরবে না।
এখন আর আন্দোলনের যৌক্তিকতা নেই দাবি করে সাদ্দাম বলেন, “বিচার বিভাগ রায় দিয়েছে, নির্বাহী বিভাগ সরকারি পরিপত্রের পক্ষে আদালতে লড়াই করছে এবং যে দাবির প্রতি সরকার আন্তরিক, সেখানে আন্দোলনকে প্রলম্বিত করা এক ধরনের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ছাড়া কিছু না।
“যে কারণে সব পক্ষের প্রতি আমাদের আহ্বান থাকবে ব্লকেড থেকে ফিরে এসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ন্যায়সঙ্গত মেসেজ পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।”
আন্দোলনকারীদের দাবির বিষয়ে ছাত্রলীগের অবস্থান জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটি এমন একটি আন্দোলন যেখানে কোনো প্রতিপক্ষ নেই।
“ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আমরা কথা দিতে চাই, সাধারণ শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক, ন্যায়সঙ্গত, অন্তর্ভুক্তিমূলক দাবির পক্ষে আমরা থাকব।”
গত কয়েকদিনের আন্দোলনে জনদুর্ভোগের বিষয়টি তুলে ধরে সাদ্দাম বলেন, “বিদ্যমান সমস্যার একটি আইনগত সমাধানের সুস্পষ্ট দরজা উন্মুক্ত থাকা সত্ত্বেও ভিন্ন কোনও পন্থা অবলম্বন করা তরুণ প্রজন্মের জন্য আশা জাগানিয়া নয়।
“যেটি আদালতের মাধ্যমে সমাধান হচ্ছিল এবং যেখানে নির্বাহী বিভাগ থেকে ২০১৮ সালে জারি করা প্রজ্ঞাপন পুনর্বহাল হয়েছে, সেখানে আন্দোলনকে আরও বেশি টেনে-হিঁচড়ে লম্বা করার প্রচেষ্টা এবং বিচার বিভাগের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে এক ধরনের মব জাস্টিসের মতো নির্বাহী বিভাগের প্রতি আদেশ জানানো আমরা মনে করি কোনও সুচিন্তিত পরিকল্পনা নয়।”
আন্দোলনকারীদের ধৈর্য ধরে আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধোন্তের জন্য অপেক্ষা করার আহ্বান জানান তিনি।
এই আন্দোলনকে ‘রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার’ করা হচ্ছে দাবি করে ছাত্রলীগ সভাপতি বলেন, আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীদের অনেকেই আপিল বিভাগের স্থিতাবস্থা জারিকে স্বাগত জানালেও একটি অংশ ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে।
“যারা ছাত্র, আদালতের আদেশের পর তারা সরে এসেছেন। কিন্তু এখনও যারা আন্দোলন করতে চাচ্ছেন, তাদের রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে আমাদের প্রশ্ন আছে। আমরা লক্ষ করছি, এটিকে প্রলম্বিত করার প্রবণতা এক ধরনের পলিটিক্যাল অ্যাটেনশন সিকারদের মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি।”
‘গুটি কয়েকের মতামত ছাত্রসমাজের মতামত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে, তাদের উদ্দেশ্য শুভ বলে মনে করি না,” বলেন ছাত্রলীগ সভাপতি।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে সরকারি চাকরিতে দুর্নীতির কিছু তথ্য তুলে ধরে বিএনপি আমলের সমালোচনা করেন সাদ্দাম।
দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “লন্ডন থেকে যিনি বয়ান দিচ্ছেন, তার কোনও যোগ্যতাই ছিল বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার।
“বিএনপির সময়ে বিসিএসের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। ছাত্রদলের ক্যাডাররা ওই সময় নিয়োগ পেয়েছে। যার কারণে পরীক্ষাও বাতিল হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের সময় কোনও বিসিএস বাতিল হয়নি। যারা মেধাবী তারাই নিয়োগ পেয়েছে।”
সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে ছাত্রলীগের অবস্থান জানতে চাইলে সাদ্দাম বলেন, বাংলাদেশে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ব্যবস্থা তারা চান। সেখানে অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, বিভিন্ন নৃ গোষ্ঠী ও নারীদের পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের পক্ষপাতি তারা।
নারী কোটা রাখার পক্ষে অবস্থান জানিয়ে তিনি বলেন, “অবশ্যই সমতা প্রদর্শন করতে অনগ্রসর নাগরিকদের দিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। তাদের প্রতি থাকতে হবে সংবেদনশীলতা। মেট্রোপলিটননির্ভর চাকরি ব্যবস্থাকে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে ছাত্রলীগ।”
তবে সার্বিকভাবে কোটা কতটা থাকবে, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত, বিচার বিভাগীয় পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন মন্তব্য করে ছাত্রলীগ সভাপতি বলেন, “গুটিকয়েকের মতামত ছাত্র সমাজের মতামত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে, সেই উদ্দেশ্য শুভ বলে আমরা মনে করি না।”