মানুষের জিন বা ডিএনএ বিশ্লেষণ করে তাকে কতটা চেনা-জানা যায়? সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের একটি দল অমর সুরস্রষ্টা লুডভিগ ফন বিটোফেনের ডিএনএ ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে যে ফল পেয়েছে তা সত্যি চমকে দেওয়ার মতোই।
তাদের গবেষণা বলছে, তাল-লয়ের (বিট সিনক্রোনাইজেশন) ব্যাপারে পশ্চিমা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার বিটোফেনের জিনগত প্রতিভা ছিল একদম সাধারণ মানুষের মতো!
একথা শুনেই তো সঙ্গীত জগতের অধিকাংশ মানুষের বিজ্ঞানের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলার কথা! কিংবা সম্পূর্ণ গবেষণাটি যে ‘ভুয়া’ সেই সম্মিলিত আওয়াজ ওঠার কথা।
অবশ্য একই কথা যদি একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, তাহলে পরিস্থিতি একটু সুখকর হয়। বলতে হবে এভাবে, ‘জার্মান সুরস্রষ্টা বিটোফেনের সঙ্গীত প্রতিভা তার জিনে থাকা সাধারণ মানের গণ্ডি ছাড়িয়ে আকাশ ছুঁয়েছে’।
বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক এ গবেষণা অবশ্য অনেকগুলো বিষয় নিয়ে আলোচনা-বিতর্কের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
এসব আলোচনার একটি হলো- কোনও একজন ব্যক্তির জিন বিশ্লেষণ করে তার ব্যাপারে কতটা জানার পরিধি সীমিতই থাকতে পারে। দ্বিতীয়টি হলো- সঙ্গীত ও সৃজনশীলতা জিনগত বৈশিষ্ট্য ছাড়াও আরও অনেকগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল।
বিটোফেনের ডিএনএ গবেষণাকারী সংস্থা ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর এমপিরিকাল এস্থেটিকস (এমপিআইইআ)- এর কগনিটিভ নিউরোসাইকোলজিস্ট লরা ওয়েসেলজিক বলেন, “কোনও বিশ্লেষণের আগে আমরা মেথড, অনুমিত ফলাফল ইত্যাদি ঠিক করে নিই। বিটোফেনের ডিএনএ নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে আমরা এমন কোনও অনুমান নিয়ে আগাইনি যে, তার স্কোর কত হবে। বরং আমাদের লক্ষ্য ছিল, গবেষণার মধ্য দিয়ে ২০০ বছর আগের কোনও মানুষের জিনগত বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণের চ্যালেঞ্জগুলো বের করা।“
লরার মন্তব্য থেকে এ কথার ইঙ্গিত পাওয়া যায়, মূল গবেষণা আসলে ছিল জিন বিশ্লেষণ থেকে অসম্ভব প্রতিভাবান ও সৃজনশীল ব্যক্তিদের ব্যাপারে কোনও পূর্বাভাস পাওয়া যায় কিনা!
যেভাবে মাপা হলো বিটোফেনের সঙ্গীত প্রতিভা
বিজ্ঞানীরা বিটোফেনের সংরক্ষিত চুল থেকে ডিএনএ পরীক্ষার উপাদান নেন। এরপর তারা ডিএনএ কোড বিশ্লেষণ করে একটি ‘পলিজেনিক স্কোর’ তৈরি করেন। ‘পলিজেনিক স্কোর’ হলো একজন ব্যক্তির জিনগত বৈচিত্র্য এবং তার ফিনোটাইপ (শারীরিক বৈশিষ্ট্য) এর মধ্যে সম্পর্কের একটি সংখ্যাসূচক পরিমাপ। এটি একাধিক জিনের প্রভাবকে একত্রিত করে একটি ফল দাঁড় করায়। একাধারে ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য- যেমন উচ্চতা, চোখের রঙ, বুদ্ধিমত্তা, বা রোগের ঝুঁকি নির্ধারণের ব্যাপারে এটি পূর্বাভাস দেয়।
তবে বিটোফেনের ডিএনএ পরীক্ষার পর যে তিনি সাধারণ ‘তালকানা’ মানুষদের কাতারে দাঁড়াতে পারেন সে অনুমান গবেষক দলের বিজ্ঞানীরা আগেই করেছিলেন। তারা বলছেন, ফলাফলটি তেমন অপ্রত্যাশিত নয়। কেননা পরীক্ষণ পদ্ধতি হিসেবে বেছে নেওয়া ‘পলিজেনিক স্কোর’ এর ক্ষেত্রে একটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো- বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা প্রতিভাধারীকে চিহ্নিত করতে এটির কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
‘পলিজেনিক স্কোর’ জনসংখ্যার মধ্যে সাধারণ প্রবণতা বোঝার জন্য ভালো হলেও বিটোফেনের মতো প্রতিভাবান ব্যক্তির অসাধারণ মূর্চ্ছনার তৈরির ক্ষমতার পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য প্রায় অকেজো।
এমপিআইইএ- এর জিনতত্ত্বের অধ্যাপক সাইমন ফিশার এ কথাটিকেই বলেছেন এভাবে, “আপনার সন্তান সঙ্গীতে অথবা অন্য কোন সৃজনশীল ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রতিভাবান হবে কিনা তা নির্ভরযোগ্যভাবে নির্ধারণ করতে জিনগত পরীক্ষা ব্যবহার করা সম্ভব বলে কেউ যদি দাবি করে, তাহলে আপনার অবশ্যই তাকে সন্দেহ হওয়া উচিত।”
একটি নির্দিষ্ট জনসংখ্যার ওপর একটি নির্দিষ্ট সময় ও স্থানে এ ধরনের গবেষণা করলে সামষ্টিকভাবে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু একজন প্রতিভাবান ব্যক্তির ওপর যখন ডিএনএ পরীক্ষা চালানো হয়- তখন অন্য অনেককিছুর সঙ্গে পরিবেশগত নানা নিয়ামকও বিবেচনায় রাখতে হয় বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিটোফেনের প্রতিভা নির্ধারণের ক্ষেত্রেই পশ্চিমের যে বর্তমান পরিবেশগত অবস্থার ওপর জিন ও সঙ্গীতের সম্পর্ক দেখার চেষ্টা করা হয়েছে, ২০০ বছর আগে বিটোফেনের সময়কার পরিস্থিতি হয়তো সম্পূর্ণ অন্যরকম ছিল।
কিন্তু জিনগত বিশ্লেষণ আবার অন্যান্য কারণে জরুরী হতে পারে। বিশেষত চিকিৎসাক্ষেত্রে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
এর আগে ‘কারেন্ট বায়োলজি’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বলা হয়, কিংবদন্তী সুরস্রষ্টা বিটোফেনের পাঁচ গোছা চুল নিয়ে ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে- তার লিভার সংক্রমণ এবং রক্তের রোগের পাশাপাশি বংশগতভাবে জিনবাহিত স্বাস্থ্য সমস্যাও ছিল। কী কারণে এ সুরস্রষ্টা মারা গিয়েছেন তখন তা জানতে না পারলেও হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল।
পুরনো বিতর্ক নতুন মোড়কে
১৭৭০ সালে জন্ম নেওয়া বিটোফেন বেঁচেছিলেন মাত্র ৫৬ বছর। এক পর্যায়ে শ্রবণশক্তি হারিয়ে বধির হয়ে যান তিনি। তারপরও সৃষ্টি করেছেন ৯টি অমর ‘সিম্ফনি’। সহজে বলতে গেলে, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সুরের ঐকতান ও সমন্বয়ে তৈরি হয় সিম্ফনি। দশম সিম্ফনি তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি।
পশ্চিমের এ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকারের কানে শুনতে না পারার সমস্যা ১৭৯৭-৯৮ সালের দিকে শুরু হয়। সেই সময় তিনি অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় থাকতেন। তবে চিকিৎসকের পরামর্শে ১৮০২ সালে ভিয়েনার কাছেই শান্ত নির্জন শহর হেইলিজেনস্ট্যাডটে আবাস গড়েন। অদ্ভুত হলেও সত্যি কানের সমস্যা শুরুর পরেই তার সিম্ফনিগুলো মঞ্চস্থ হয়।
সেই যাই হোক, এর আগে এক গবেষণায় দেখা গেছে, জিনগতভাবে বাবা-মায়ের সঙ্গীত প্রতিভার প্রায় ৪২ শতাংশ উত্তরাধিকার সূত্রে সন্তান পেতে পারে। তবে বিটোফেনের সঙ্গীত প্রতিভা নিয়ে গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল আবারও একটি পুরনো বিতর্ক উসকে দিল- প্রাকৃতিক প্রতিভা বনাম চর্চা বা পরিবেশের প্রভাবে তৈরি প্রতিভা, কোনটি ঠিক?
সাম্প্রতিক গবেষণাটি মানুষের দক্ষতা গঠনে জিন এবং পরিবেশের মধ্যে জটিল মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের বোঝার ক্ষেত্র তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।
তথ্যসূত্র: সায়েন্স অ্যালার্ট