যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের হত্যাচেষ্টা নতুন কোনও ঘটনা নয়। ইতিহাস বলছে, দেশটির চারজন প্রেসিডেন্টকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এর বাইরে একাধিক প্রেসিডেন্টকে হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে। আর বানচাল করা হয়েছে কয়েক ডজন হত্যাচেষ্টা পরিকল্পনা।
রবিবার সকালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়াতে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হত্যাচেষ্টা হয়। হামলাকারীর গুলিতে তার কান ফুটো হলেও অল্পের জন্য বেঁচে যান তিনি। এই ঘটনা দেশটির প্রেসিডেন্টদের হত্যাচেষ্টার তালিকায় আরেকটি ঘটনা হিসেবে যুক্ত হলো।
ট্রাম্পকে অবশ্য এবারই প্রথম নয়, এর আগেও তিনবার হত্যাচেষ্টা হয়েছে। ২০১৬ সালের ১৬ জুন একজন ব্রিটিশ নাগরিক লাস ভেগাসে তাকে গুলি করে ধরা খান। ২০১৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মানদানে ট্রাম্পকে হত্যার পরিকল্পনার অভিযোগে নর্থ ডাকোটার বাসিন্দা গ্রেগরি লি লিনগাংকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের বছর ম্যানিলয়ায় আইএস (ইসলামিক স্টেট) সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয় ট্রাম্পকে হত্যা চেষ্টার ঘটনায়।
যুক্তরাষ্ট্রের অন্য প্রেসিডেন্টদেরও একাধিকবার হত্যাচেষ্টা হয়েছিল। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় সেসব চেষ্টা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়। তবে ব্যতিক্রমও আছে। সাবেক চার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন, জেমস এ গারফিল্ড, উইলিয়াম ম্যাকিনলে ও জন এফ কেনেডিকে হত্যা করা হয়।
হত্যাচেষ্টার ঘটনা
অ্যান্ড্রু জ্যাকসন (১৮৩৫, জানুয়ারি ৩০)
ওয়াশিংটন ডিসিতে এক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন প্রেসিডেন্ট জ্যাকসন। পথিমধ্যে লুকিয়ে ছিলেন রিচার্ড লরেন্স নামে এক বেকার চিত্রকর। তিনি জ্যাকসনকে দুইটি ভিন্ন পিস্তল দিয়ে গুলি করেন। কিন্তু কোনও গুলিই প্রেসিডেন্টের গায়ে লাগেনি। লরেন্সই প্রথম ব্যক্তি যিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত হন।
উইলিয়াম হাওয়ার্ড টাফট (১৯০৯, অক্টোবর ১৬)
যুক্তরাষ্ট্রের ২৭তম প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম হাওয়ার্ড টাফট সেদিন মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট প্রোফিরিও ডিয়াজের সঙ্গে একটি সম্মেলনে যোগ দিতে যান টেক্সাসের এল পাসোতে। অনুষ্ঠানস্থলে পিস্তল নিয়ে অপেক্ষায় ছিল জুলিয়াস বার্জারসন নামের এক ব্যক্তি। প্রেসিডেন্ট টাফট তার কয়েক ফুটের মধ্যে আসতেই জুলিয়াস পিস্তল বের করে। কিন্তু সিক্রেট সার্ভিসের দুই কর্মকর্তা তাকে ধরে ফেলে।
থিওডর রুজভেল্ট (১৯১২, অক্টোবর ১৪)
সেলুন মালিক জন ফ্লাম্যাং শ্র্যাঙ্ক প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে উইসকনসিনের মিলওয়াকিতে বুকে গুলি করেন। সেসময় রুজভেল্ট তার তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় যেতে নির্বাচনী প্রচারে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। গুলি বুকে লাগলেও বেঁচে যান প্রেসিডেন্ট। নিজের চশমা রাখার স্টিলের খাপ ও ৫০ পৃষ্ঠার দীর্ঘ বক্তৃতার লিখিত কাগজের কপি ছিল তার বুকের কাছে। ফলে সেসব ভেদ করে রুজভেল্টের শরীরে খুব একটা ক্ষতি করতে পারেনি ঘাতকের গুলি।
হার্বার্ট হুভার (১৯২৮, নভেম্বর ১৯)
সেদিন প্রেসিডেন্ট হুভার মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা সফরের উদ্দেশ্যে বের হন। চিলি হয়ে অন্দিজ পর্বতমালা দিয়ে যাওয়ার সময় আর্জেন্টিনার একটি চরমপন্থী দলের সদস্যরা হুভারকে বহনকারী ট্রেন বোমা দিয়ে ধ্বংসের চেষ্টা করে। কিন্তু ট্রেনে বোমা রাখার মুহূর্তে ধরা পড়ে দলটির কয়েকজন সদস্য।
ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট (১৯৩৩, ফেব্রুয়ারি ১৫)
ফ্লোরিডার মিয়ামির বে ফ্রন্ট পার্কে বক্তৃতা দেওয়ার সময় বেকার ইটভাটা শ্রমিক গুইসেপ জাঙ্গারা প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে লক্ষ্য করে পাঁচটি গুলি করে। এতে রুজভেল্টের কিছু হয়নি। কিন্তু সভায় উপস্থিত শিকাগো মেয়র অ্যান্তন কারমাক নিহত ও চারজন আহত হন।
হ্যারি এস ট্রুম্যান (১৯৫০, নভেম্বর ১)
পুয়ের্তো রিকোর দুই স্বাধীনতাপন্থী অস্কার কোলাজো এবং গ্রিসেলিও টরেসোলা ওয়াশিংটন ডিসির ব্লেয়ার হাউসে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫তম প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানকে হত্যার চেষ্টা করেন। হোয়াইট হাউসের সংস্কার কাজের সময় ঘটনাটি ঘটে। হামলাকারী দুজন বাড়িতে প্রবেশের চেষ্টা করলে তাদের সঙ্গে নিরাপত্তারক্ষীদের গুলি বিনিময় হয়। এসময় একজন হামলাকারী ও পুলিশ কর্মকর্তা লেসলি কফেল্ট নিহত হন। অপর হামলাকারীকে আটক করা হয়েছিল।
রিচার্ড নিক্সন (১৯৭২, এপ্রিল ১৩ এবং ১৯৭৪, ফেব্রুয়ারি ২২)
কানাডার অটোয়াতে সফররত প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে গুলি করে আর্থার বার্মার নামের এক ব্যক্তি। কিন্তু প্রেসিডেন্টের গাড়ির গতির কারণে গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। এভাবে কয়েক দফা নিক্সনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এমন এক হত্যাচেষ্টায় বার্মারের হাতে নিক্সনের জায়গায় গুলিবিদ্ধ হন আলাবামার গভর্নর জর্জ ওয়ালেস।
হোয়াইট হাউসে উড়োজাহাজ দিয়ে আত্মঘাতী হামলার পরিকল্পনা ছিল স্যামুয়েল বায়েক নামের এক ব্যক্তির। বাল্টিমোর বিমানবন্দর থেকে এক পুলিশ কর্মকর্তা ও একজন পাইলটকে হত্যা করে ডিসি-৯ উড়োজাহাজ হাইজ্যাক করে বায়েক। কিন্তু উড়োজাহাজের চাকা আটকে থাকায় সেটি চালাতে না পেরে নিজেকে গুলি করে হত্যা করে নিক্সনকে হত্যার পরিকল্পনাকারী বায়েক।
জেরাল্ড ফোর্ড (১৯৭৫, সেপ্টেম্বর ৫ ও ২২)
ক্যালিফোর্নিয়ার স্যাক্রামেন্টোতে লিনেট ফ্রোমে নামের এক নারী প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডকে গুলি করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু গুলি করার আগেই সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টরা তাকে আটক করে। এর কয়েক সপ্তাহ পরে সারা জেন মুর নামের অপর এক নারী ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকোতে ফোর্ডকে গুলি করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেখানেও সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টরা ওই হত্যাচেষ্টা ব্যর্থ করে দেন।
জিমি কার্টার (১৯৭৯, মে ৫)
যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯তম প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারকে লস অ্যাঞ্জেলসের সিভিক সেন্টার মলে বক্তৃতা দেওয়ার সময় গুলি করে হত্যার পরিকল্পনা করে রেমন্ড লি হার্ভে। তবে তাকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়, দেখা যায় তার পিস্তলে ফাঁকা শেল ছিল। পরে জানা যায়, মানসিকবাবে অসুস্থ হার্ভে প্রেসিডেন্টকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে ওই মলে ফাঁকা গুলি করতে চেয়েছিলেন।
রোনাল্ড রেগ্যান (১৯৮১, মার্চ ৩০)
ওয়াশিংটন ডিসির হিলটন হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগ্যান ও তার নিরাপত্তা রক্ষীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে জন হিঙ্কলি জুনিয়র নামের এক ব্যক্তি। এতে রেগ্যান আহত হন। টানা ১২ দিন তাকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল।
জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ (১৯৯৩, এপ্রিল ১৩)
প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা ছাড়ার তিন মাস পর কুয়েত গিয়েছিলেন সিনিয়র বুশ। তার সঙ্গে ছিল তার দুই সন্তান, স্ত্রী, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস এ বাকের তৃতীয়, সাবেক চীফ অব স্টাফ জন সুনুনু ও সাবেক ট্রেজারি সেক্রেটারি নিকোলাস ব্র্যাডি। বুশকে বহনকারী গাড়িতে বোমা হামলার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু কুয়েতি কর্তৃপক্ষের তৎপরতায় ওই পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়।
বিল ক্লিনটন
প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে তার শাসনামলে মোট পাঁচবার হত্যাচেষ্টা হয়। ১৯৯৪ সালের ২১ জানুয়ারি, ২৯ অক্টোবর ও একই বছরের নভেম্বরে দুবার এবং ২০১৮ সালের অক্টোবরে এসব চেষ্টা হয়। প্রথমবার ক্লিনটনকে ফ্লোরিডায় ভোরবেলা হাঁটার সময় তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে রোনাল্ড জিনি বার্বার নামের এক ব্যক্তি।
এরপর হোয়াইট হাউসের নর্থ লনে ফ্রাঙ্কোসিস মার্টিন দুরান অন্তত ২৯ রাউন্ড গুলি ছোড়ে ক্লিনটন সেখানে আছেন এমনটা ভেবে। এছাড়া রামজি ইউসুফ নামের এক ভাড়াটে খুনিও ক্লিনটনকে হত্যার চেষ্টা করেন। ১৯৯৬ সালের ২৪ নভেম্বর ম্যানিলায় এশিয়া প্যাসিফিক ইকোনোমিক করপোরেশনের বৈঠকে যান ক্লিনটন। সেখানে তাকে হত্যার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেওয়া হয়।
২০১৮ সালের অক্টোবরে ক্লিনটনের নিউ ইয়র্কের বাসভবনে পাইপবোমা পাঠানো হয়।
জর্জ ডব্লিউ বুশ
২০০৫ সালের ১০ মে ও ২০২২ সালের ২৪ মে দুই দফায় বুশকে হত্যাচেষ্টা হয়। প্রথমবার জর্জিয়ার তিবলিসির ফ্রিডম স্কয়ারে তাকে লক্ষ্য করে সোভিয়েত আমলের আরজিডি-৫ সিরিজের গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু সেটি ফাটেনি। ওই ঘটনায় আরুতুনিয়ান নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এরপর ২০২২ সালের ২৪ মে ওহাইওতে ইরাকি এক নাগরিককে বুশকে হত্যার পরিকল্পনা করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়।
বারাক ওবামা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার বারাক ওবামাকে হত্যাচেষ্টা হয়েছে। ২০০৮ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে মোট ৮ বার তাকে হত্যাচেষ্টা হয়। প্রত্যেক চেষ্টাই ব্যর্থ করে দেওয়া হয়।
হত্যার ঘটনা
আব্রাহাম লিঙ্কন (১৮৬৫, এপ্রিল ১৪)
ওয়াশিংটন ডিসির ফোর্ডস থিয়েটারে ‘আওয়ার আমেরিকান কাজিনস’ নাটক দেখতে গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট। তখন তাকে মাথায় গুলি করে হত্যা করেন জন উইল্কস বুথ নামের এক ব্যক্তি। ঘটনাটি ঘটেছিল আমেরিকার গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতির একেবারে শেষ দিকে। বুথের মতো অনেকের কাছে লিঙ্কন ছিলেন একজন অত্যাচারী প্রেসিডেন্ট যিনি সংবিধান লঙ্ঘন করেছিলেন।
জেমস এ গারফিল্ড (১৮৮১, জুলাই ২)
স্বাধীনতা দিবসের বক্তব্য দিতে ম্যাসাচুসেটস যাচ্ছিলেন প্রেসিডেন্ট জেমস এ গারফিল্ড। পথে ওয়াশিংটন ডিসির একটি ট্রেন স্টেশনে প্রবেশের সময় চার্লস জে গুইটো নামের এক ব্যক্তি গুলি করে প্রেসিডেন্টকে। এতে আহত হওয়ার দুই মাসের মাথায় মারা যান গারফিল্ড। কেন গুইটো প্রেসিডেন্টকে গুলি করে, এর কারণ অনুসন্ধানে নেমে ব্যক্তিগত আক্রোশ ছাড়া কিছু পাওয়া যায়নি। তবে তখন বলা হয়েছিল, হামলাকারী মানসিকভাবে সুস্থ ছিল না।
উইলিয়াম ম্যাকিনলে (১৯০১, সেপ্টেম্বর ৬)
নিউ ইয়র্কের বাফেলোতে প্যান আমেরিকান এক্সপোজিশনে প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাকিনলের পেটে গুলি করে লিওন চেলগোস নামের এক ব্যক্তি। এতে আহত হন প্রেসিডেন্ট। চিকিৎসা চলাকালে আটদিনের মাথায় ম্যাকিনলে মারা যান। তখন বলা হয়েছিল, হত্যাকারী চেলগোস ছিলেন একজন নৈরাজ্যবাদী।
এই ঘটনার পরই যুক্তরাষ্ট্রের সরকার আধুনিক সিক্রেট সার্ভিস প্রতিষ্ঠার দিকে মনোযোগ দেয়।
জন এফ কেনেডি (১৯৬৩, নভেম্বর ২২)
টেক্সাসের ডালাসে স্ত্রী জ্যাকুলিনকে নিয়ে একটি ছাদখোলা কনভার্টিবল গাড়িতে করে ঘুরছিলেন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। কাছাকাছি একটি ছয়তলা ভবনে তখন প্রেসিডেন্টের জন্য অপেক্ষা করছিল হামলাকারী লি হার্ভে অসওয়াল্ড। সেখান থেকে প্রেসিডেন্টকে দেখা মাত্রই তিনটি গুলি ছোড়া হয়। এর মধ্যে দুটি গুলি লাগে কেনেডির মাথায়।
তথ্যসূত্র : ওয়ান নিউজ।