যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বাগদাদে নিহত হন ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। তার স্মরণে গত বুধবার ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর কেরমানে সোলাইমানির সমাধিস্থলের কাছে আয়োজিত অনুষ্ঠানে জোড়া বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন ৯৫ জন। এতে আহত হয়েছেন আরও দুই শতাধিক।
এই জোড়া বিস্ফোরণকে গত ৪২ বছরের মধ্যে ইরানে সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা বলা হচ্ছে। এই হামলার পেছনে দায়ীদের সমুচিত জবাব দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে ইরান। তবে এই হামলার নেপথ্যে কে বা কারা, তার খোঁজে সামনে এসেছে নানা প্রশ্ন।
কে ছিলেন কাসেম সোলাইমানি
জেনারেল কাসেম সোলাইমানি ছিলেন ইরানের সেনাবাহিনীর অভিজাত ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) সাবেক প্রধান। ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি ইরাকের বাগদাদ বিমানবন্দরে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় নিহত হন সোলায়মানি। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির পর দেশটির ‘সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি’ মনে করা হতো কাসেম সোলাইমানিকে।
সোলায়মানি আইআরজিসির আল কুদস ফোর্সের দেখভাল করতেন। আল কুদস ফোর্স মূলত ইরানের বাইরে নানা অভিযান চালাত। তিনি ছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ভূরাজনৈতিক কৌশল তৈরির নেপথ্য কারিগর। তাকে তেহরানের মধ্যপ্রাচ্য নীতির স্থপতি মনে করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে প্রতিহত করার জন্য চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে জোট বেঁধে যে ছক ইরান সাজিয়েছে সোলাইমানিকে তার মাস্টারমাইন্ড বলা হয়।
ইরাক ও সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ইরানের সামরিক অভিযানগুলোর পরিকল্পনাও সাজাতেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের সেনা সদর দপ্তর পেন্টাগনের বরাত দিয়ে সিএনএন বলেছে, সোলাইমানি ও তার সৈন্যরা শতাধিক আমেরিকান ও জোট বাহিনীর সদস্যের মৃত্যু এবং কয়েক হাজার সদস্যের আহতের জন্য দায়ী।
এসব কারণে কাসেম সোলাইমানিকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করত ওয়াশিংটন। ২০২০ সালে সোলাইমানিকে গুপ্তহত্যার নির্দেশ দেন দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কাসেম সোলাইমানিকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে কুখ্যাত সন্ত্রাসী’ বলেও আখ্যা দিয়েছিলেন তিনি।
সোলাইমানির চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বুধবার বিকালে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ২০ মিনিটের ব্যবধানে জোড়া বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। একটি বিস্ফোরণ হয় সোলাইমানির সমাধিস্থলের কাছের রাস্তায়। সে সময় শত শত মানুষ ওই রাস্তা দিয়ে হেঁটে তার সমাধিস্থলের দিকে যাচ্ছিলেন। আরেকটি বিস্ফোরণ হয় সমাধি থেকে একটু দূরে সাহেব আল-জামান মসজিদে জড়ো হওয়া মানুষদের ওপর।
ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া
ভয়াবহ এই হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “নির্মম অপরাধীদের অবশ্যই জানা উচিৎ যে তাদের বিরুদ্ধে এখন থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং নিঃসন্দেহে তাদের সমুচিত জবাব দেওয়া হবে।”
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই হামলা চালিয়েছে কারা? কাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে? কাদের ওপরই বা প্রতিশোধ নেবে ইরান?
এখন পর্যন্ত কেউ এই হামলার দায় স্বীকার করেনি। তবে এর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে দায়ী করেছে ইরান। প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি বুধবার সন্ধ্যায় এক টেলিভিশন বক্তৃতায় এই হামলার জন্য সরাসরি ইসরায়েলকে দায়ী করেছেন। এজন্য ইসরায়েলকে চড়া মূল্য পরিশোধ করতে হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
তেহরান থেকে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত বক্তৃতায় রাইসি বলেন, “আমি ইহুদিবাদী শাসকদের সতর্ক করছি, মনে কোনও সন্দেহ রাখবেন না, এই অপরাধসহ আরও যেসব অপরাধ আপনারা করেছেন সেসবের জন্য চড়া মূল্য দিতে হবে। ইসরায়েলের শাস্তি হবে অনুশোচনীয় ও কঠোর।”
তবে রাইসি প্রতিশোধের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়ার অঙ্গীকার করেননি, বরং তা ‘সময়মতো ও সঠিক স্থানে’ নেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেন।
ইব্রাহিম রাইসি ইসরায়েলকে দোষারোপের পরপরই এই হামলার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র বা তাদের মিত্র ইসরায়েল জড়িত নয় বলে ঘোষণা দেয় ওয়াশিংটন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার সাংবাদিকদের বলেন, “এ হামলার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই জড়িত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার ইঙ্গিত করাও একেবারে হাস্যকর। আর আমাদের এটাও বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই যে, এ হামলার পেছনে ইসরায়েল জড়িত রয়েছে।”
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবিও বলেছেন, ইরানের ভয়াবহ বিস্ফোরণে ইসরায়েল কোনোভাবে জড়িত ছিল এমনটা ভাবার কোনও অবকাশ নেই।
এদিকে, বৃহস্পতিবার ইরানের প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক সহযোগী মোহাম্মদ জামশিদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সের (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে লেখেন, “ওয়াশিংটন বলেছে, ইরানের কেরমানে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ভূমিকা নেই। সত্যিই কি তাই? শেয়ালই প্রথম তার নিজের মল-মূত্রের গন্ধ পায়।”
মোহাম্মদ জামশিদি আরও লেখেন, “কোনও ভুল করবেন না। এই অপরাধের দায়ভার যুক্তরাষ্ট্র ও ইহুদিবাদী শাসকদের (ইসরায়েলের) এবং সন্ত্রাসবাদ শুধুমাত্র তাদের একটি হাতিয়ার।”
ইসরায়েল অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে এই ব্যাপারে এখনও কিছু বলেনি। এএফপি জানায়, ইরানে বিস্ফোরণের বিষয়ে জানতে চাইলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন, “আমরা হামাসের সঙ্গে যুদ্ধের দিকে মনোনিবেশ করেছি।”
সন্দেহের তীর আইএসের দিকে
যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসনের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বুধবার বলেছেন, ইরানে জোড়া বিস্ফোরণের ঘটনাকে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) হামলার মতো মনে হচ্ছে।
তিনি বলেন, “ইরানে জোড়া বিস্ফোরণের এই ঘটনাকে সন্ত্রাসী হামলা বলেই মনে হচ্ছে। অতীতে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটকে (আইএস) যেমন হামলা চালাতে দেখেছি আমরা, তেমনই একটি হামলা এটি। এই হামলার বিষয়ে এটাই আমাদের এই মুহূর্তের অনুমান।”
আইএস ও অন্যান্য সুন্নি জিহাদি গোষ্ঠীগুলো ছাড়া মুজাহিদীন-ই-খালকের (এমইকে) মতো ইরানের কোনও বিদ্রোহী গোষ্ঠীও এই হামলা চালিয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বল্টন সিএনএনকে এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, “আইএস এই হামলা চালানোর সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ ইরানের ভেতরে এমন হামলা থেকে আইএসের অর্জন করার কিছুই নেই। হয়তো ইরানের বর্তমান ইসলামি সরকারবিরোধী কোনো গোষ্ঠী এই হামলা চালিয়ে থাকতে পারে। তবে ইরান এই হামলাকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।”
জন বল্টন আরও বলেন, “বিস্ফোরণগুলো ইসরায়েলের কাজ বলে মনে হয় না। বিস্ফোরণে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ইসরায়েলের পদ্ধতির সঙ্গে খাপ খায় না। ইসরায়েল সাধারণত নির্দিষ্টভাবে ইরানের কোনো রাষ্ট্রীয় টার্গেটে হামলা চালায়। বিস্ফোরণের মাত্রা বিচার করলে, ইরানের কোনো বিদ্রোহী সংগঠনের পক্ষেও এমন হামলা চালানো সম্ভব বলে মনে হয়।”
ইরানে এই হামলা এমন এক সময়ে ঘটল যখন ফিলিস্তিনের গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েল তিন মাস ধরে যুদ্ধ করছে। ইসরায়েলের হামলায় গাজায় এরই মধ্যে ২৩ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ইরান সমর্থিত লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুতিরাও প্রায়ই ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে। এমন সময় ইরানে এই হামলার ফলে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের বাইরেও যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
দ্য গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ইরানের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলীয় শহর কেরমানে জনতার ওপর জোড়া বোমা বিস্ফোরণের জন্য কে বা কারা দায়ী, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে যারাই এই ভয়ানক হামলার পেছনে থাকুক না কেন, তারা যে মধ্যপ্রাচ্যে বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধ উসকে দিতে চায়, তা পরিষ্কার।