এডেন উপসাগরে ইয়েমেনি হুতি বিদ্রোহীদের হামলার শিকার জাহাজ ‘মার্লিন লুয়ান্ডা’র মালিক কর্তৃপক্ষ ভুল তথ্য জানিয়েছিল। ওই জাহাজে থাকা এক বাংলাদেশি নাবিকের খোঁজ মিলেছে।
তার নাম বেলাল হোসেন, তিনি চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমির ৫১তম ব্যাচের ছাত্র। তার বাড়ি পাবনার ঈশ্বরদীতে।
ওই নাবিকের সঙ্গে কথা হয়েছে সকাল সন্ধ্যার। তিনি জানিয়েছেন, জাহাজে থাকা ২২ নাবিকের মধ্যে তিনিসহ সবাই নিরাপদে আছেন।
গাজা যুদ্ধের পর থেকে ইয়েমেনি হুতি বিদ্রোহীদের হামলার কারণে এশিয়া-ইউরোপের সংক্ষিপ্ত নৌপথ এডেন উপ সাগর এড়িয়ে চলতে হচ্ছে বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে।
এরমধ্যে গত ২৬ জানুয়ারি ওই এলাকা অতিক্রমের সময় ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় পড়ে জাহাজটি। সেই ঘটনাটি বিবিসি, এনডিটিভিসহ আর্ন্তজাতিক সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়। তাতে জাহাজটিতে ২২ নাবিক ভারতীয় এবং একজন বাংলাদেশি থাকার কথা বলা হয়েছিল।
তবে বাংলাদেশি নাবিকের পরিচয় জানতে পরদিন সকাল সন্ধ্যার পক্ষ থেকে ইমেইল করা হয়েছিল জাহাজটির মালিক কোম্পানি ট্রাফিগুরাকে। কোম্পানির পক্ষে এর মিডিয়া শাখার প্রধান ভিক্টোরিয়া জানিয়েছিলেন, জাহাজটিতে কোনও বাংলাদেশি নেই।
নাবিক নিবন্ধনকারী বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের কাছেও কোনও তথ্য ছিল না।
তা নিয়ে গত ২৮ জানুয়ারি সকাল সন্ধ্যায় প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছিল। তবে অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে থাকা সকাল সন্ধ্যা জানতে পারে বেলালের খবর। বুধবার রাতে তার সঙ্গে কথাও হয়।
‘আতঙ্কিত হলেও বিচলতি হইনি’
বেলাল ফোনে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “২৬ জানুয়ারি আমি আমার কাজ করছিলাম। এমন সময় বিকট একটা শব্দে আশপাশ কেঁপে উঠে। সময়টা তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। প্রথমেই সেইফটি জ্যাকেট এবং সিকিউরিটি মেজার্স নিলাম। জাহাজে বিপদ সঙ্কেত বেজে উঠল। দেখলাম আগুন আর চারদিকে ধোঁয়া। জাহাজটি এবানডন করার কাজে নেমে পড়লাম।
“কী হবে তখনও বুঝে উঠতে পারিনি। এই পর্যন্ত চারটি জাহাজে কাজ করছি, এই জাহাজে অফিসার হিসেবে প্রথম কাজ। আতঙ্ক থাকলেও বিচলিত হয়ে পড়িনি। কাছাকাছি দূরত্বে থাকা ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ জাহাজ এল উদ্ধার করতে। এরপর এল ভারতীয় নেভির জাহাজ আইএনএস বিশাখাপত্তম। সেই জাহাজটিই সবচেয়ে সহযোগিতা করার পরও ১৬ ঘণ্টা লেগেছে পুরো উদ্ধারকাজ সম্পন্ন করতে।”
দুর্ঘটনার খবর শুনলে স্বাভাবিকভাবেই পরিবার বিচলিত হয়ে পড়বে বলে বাড়িতেও খবর দেননি বেলাল।
তিনি বলেন, “তবে ২৮ জানুয়ারি আমি বাংলাদেশের নিয়োগ প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্সকে দুর্ঘটনার বিষয় অবহিত করি। কিন্তু পরে শুনি সেদিনই শিপিং কোম্পানি থেকে আমার বাবাকে ফোনে জানানো হয়েছে।
“পরে জাহাজের ক্যাপ্টেন দেশে পরিবারের সাথে কথা বলার সুযোগ দিলে আমি প্রথমেই বাবাকে জানাই। এরপর আমার স্ত্রীকে জানাই। কথা বলার পর তাদের উদ্বেগ কেটেছে। তারা এখন নিশ্চিন্ত হয়েছেন আল্লাহর রহমতে। ফলে এখনই দেশে ফেরার ইচ্ছে নাই।”
জাহাজটি মেরামত শেষে নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছার পর দেশে ফেরার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান বেলাল।
জাহাজটি এখন কোথায়
মার্লিন লুয়ান্ডা জাহাজটি মার্শাল আইল্যান্ডের পতাকাবাহী অর্থাৎ সে দেশে নিবন্ধিত। কিন্তু জাহাজটির পরিচালনা কর্তৃপক্ষ ব্রিটিশ কম্পানি ‘ওশানিক্স সার্ভিসেস লিমিটেড’। জাহাজের মালিক সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানি ট্রাফিগুরা।
রাশিয়ার তেল নিয়ে জাহাজটি গ্রিসের একটি বন্দর থেকে ২১ জানুয়ারি মিশরের পোর্ট সাঈদ পার হয়ে ৭ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরে পৌঁছানোর কথা ছিল।
এডেন উপসাগরে হামলার শিকার হওয়ার পর জাহাজটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এখন নিরাপত্তার মধ্যে মেরামত কাজ চলছে। ডকে মেরামতের পর আবার সিঙ্গাপুরে যাত্রা শুরু করবে।
তবে জাহাজটির বর্তমান অবস্থান নিরাপত্তাজনিত কারণে প্রকাশ করেননি বেলাল।
ভুল তথ্য দিয়েছে ট্রাফিগুরা
বাংলাদেশি নাবিক না থাকার বিষয়টি ই-মেইলে নিশ্চিত করেছিলেন ট্রাফিগুরার মিডিয়া শাখার প্রধান ভিক্টোরিয়া। বিষয়টি জানিয়ে তাকে পুনরায় সকাল সন্ধ্যার পক্ষ থেকে ই-মেইল করা হলেও এখনও তার জবাব মেলেনি।
নাবিকদের সংগঠন বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ট্রাফিগুরা হচ্ছে জাহাজের মালিক। জাহাজের সর্বশেষ তথ্য থাকবে চার্টারার বা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের। সেজন্যই হয়ত ভুল ইনফরমেশন ছিল।”
রিলায়েন্স কোম্পানি ‘জানায়নি’
একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই নাবিকরা জাহাজে চাকরিতে যোগদান করেন। তার আগে অবশ্যই সরকারের সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হয়। জাহাজে হামলার পর তাৎক্ষণিকভাবে নিয়োগদাতা কোম্পানি রিলায়েন্সকে জানিয়েছিলেন বেলাল। কিন্তু খবরটি প্রকাশ করেনি কোম্পানিটি। সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর ‘সার্ভার ডাউন’ জটিলতায় এখনও পড়ে আছে। ফলে তারাও কিছু জানে না।
বেলাল হোসেন বলেন, “আমার জাহাজ যোগদানের কথা ছিল আরেকটিতে। অস্ট্রেলিয়ার ভিসা জটিলতার কারণে আমি সেই জাহাজে না উঠে মার্লিন লুয়ান্ডা জাহাজে যোগদান করি। আর বিষয়টি আমি রিলায়েন্সকে জানাই।
“তারা বলেছিল, অনলাইনে সেটি নিবন্ধন করবে। কিন্তু সার্ভার জটিলতায় সেটি আর আপডেট হয়নি। ফলে আমার নতুন চাকরি আগের জাহাজের অফারেই রয়ে গেছে।”
এবিষয়ে রিলায়েন্স কোম্পানির কোনও বক্তব্য সকাল সন্ধ্যা জানতে পারেনি।
সিবিএ না থাকার মাশুল
এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে একটি সেন্ট্রাল বার্গেইনিং এজেন্ট (সিবিএ) থাকার প্রয়োজনীয়তা দেখছেন মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “অনেক বছর ধরেই আমরা বলে আসছি সিবিএর প্রয়োজনীয়তার কথা। কিন্তু কে শোনে কার কথা! নাবিকদের সুযোগ সুবিধা, নিরাপত্তা, দুর্ঘটনা, দুর্যোগ সব বিষয়ে আমরা তাৎক্ষণিক বিশ্বজুড়ে থাকা নাবিকদের তথ্য পেয়ে যেতাম। ফলে সেই দেশে না গিয়ে আমরা দ্রুত উদ্যোগ নিয়েও এর সহজ সমাধান করতে পারতাম।”
এর আগে বাংলাদেশি জাহাজ ‘বাংলার সমৃৃদ্ধি’ পণ্য আনতে গিয়ে কৃ্ষ্ণসাগরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের হামলার মধ্যে পড়ে। জাহাজটিতে বোমা হামায় বাংলাদেশি এক নাবিক নিহত হন। বাকিদের সবাইকে উদ্ধার করে দেশে নিয়ে আনে বাংলাদেশ সরকার।