সারাদেশে গত অক্টোবর থেকে ট্রেনে পাঁচটি নাশকতার ঘটনা ঘটে। এছাড়া বিভিন্ন রেললাইনে প্যান্ডেল ক্লিপ, ফিশ প্লেট ও নাট-বলটু খুলে নেওয়ার ঘটনাও ঘটে। রাজধানীর তেজগাঁও রেলস্টেশনে গত ১৯ ডিসেম্বর মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে নাশকতার পর রেলওয়ের সার্বিক নিরাপত্তা বাড়াতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তখন রেলপথ মন্ত্রণালয় সারাদেশে রাত্রিকালীন ছয়টি ট্রেন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে। পাশাপাশি সম্ভাব্য নাশকতার ঝুঁকি থাকা রেলপথে টহল ইঞ্জিন চালু করে রেললাইনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ‘নিশ্ছিদ্র’ করার ঘোষণা দেয় রেলপথ অধিদপ্তর।
এর পাশাপাশি ২২ ডিসেম্বর থেকে সারাদেশের রেলস্টেশন, রেললাইন ও ট্রেনে ২ হাজার ৭০০ আনসার সদস্য মোতায়েন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রাজধানীর কমলাপুর রেল স্টেশন ও বিমানবন্দর রেল স্টেশনে র্যাবের টহল দল মোতায়েন করা হয়। এই দুটি স্টেশনে র্যাবের ডগ স্কোয়াডও মোতায়েন করা হয়।
এমন নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেই শুক্রবার রাতে রাজধানীর গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেসে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এ ঘটনাকে পরিকল্পিত নাশকতা বলে উল্লেখ করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (অপারেশন) খ. মহিদ উদ্দিন। শুক্রবার রাতে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “এটি যে নাশকতা সেটি স্পষ্ট। বোঝাই যাচ্ছে পরিকল্পিতভাবে এই নাশকতা করা হয়েছে।”
ট্রেনে ছিল ৭ জনের নিরাপত্তা টিম
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসা রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) শফিকুর রহমান জানান, ট্রেনটিতে রেল পুলিশের সাতজনের একটি দল ছিল। রাত ৯টা ৪ মিনিটে কন্ট্রোল রুমে ট্রেনে আগুনের খবর দেওয়া হয়। তিন থেকে চার মিনিটের মধ্যে ট্রেনটিকে দাঁড় করানো হয়।
তিনি বলেন, “গেন্ডারিয়া স্টেশন পার হওয়ার কিছুক্ষণ পর ট্রেনে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। এখানে ট্রেন থামে না, কিন্তু একটু স্লো হয়। চলন্ত ট্রেনের দরজাও বন্ধ থাকার কথা ছিল। তবে ঘটনার সময় কী হয়েছে তা বলা যাচ্ছে না।”
গত ১৯ ডিসেম্বর তেজগাঁওয়ে ট্রেনে নাশকতার পর রেলওয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সব ট্রেনে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হবে। কিন্তু বেনাপোল এক্সপ্রেসে সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না বলে নিশ্চিত করেছেন রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান।
টহল ইঞ্জিন বেনাপোল এক্সপ্রেসকে চলাচলের অনুমতি দেয়
মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে নাশকতার পর রেললাইনে টহল ইঞ্জিন চালু করে রেলপথ অধিদপ্তর। এই ইঞ্জিন নির্ধারিত একটি দূরত্ব অতিক্রম করার পর রেললাইন দিয়ে আন্তঃনগর ট্রেন চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, টহল ইঞ্জিন বেনাপোল এক্সপ্রেসের জন্যও নির্ধারিত ছিল। টহল ইঞ্জিনে থাকা কর্মকর্তাদের অনুমতিতেই ট্রেনটি চলাচল করছিল।
টহল ইঞ্জিন চলাচলের সময় সম্ভাব্য নাশকতার বিষয়ে কোনও সন্দেহ হয়েছিল কিনা– এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আমরা কোনও নাশকতার সম্ভাবনা লক্ষ্য করিনি। আমাদের পক্ষে তো আর এতকিছু লক্ষ্য রাখা সম্ভব না।”
আনসার ছিল গেন্ডারিয়া স্টেশনে
মোতায়েন করা আনসার সদস্যদের কাজ ছিল লোকালয় বা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় রেললাইন ধরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু শুক্রবার রাতের গোপীবাগে ট্রেনের আগুনের ঘটনার সময় সেখানে কোনও আনসার সদস্য ছিল না। বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ঘটনাস্থলে আশেপাশে আনসার সদস্যরা ছিলেন না। তারা পাশের গেন্ডারিয়া স্টেশনে ছিলেন।”
আনসার সদস্যদের লোকালয়ে রেললাইন ধরে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা থাকলেও সেখানে না থেকে তারা স্টেশনে কেন ছিলেন, যেখানে এমনিতেই পুলিশসহ নিরাপত্তায় নিয়োজিত অন্যান্য বাহিনী ছিল— এ প্রশ্ন করতেই আনোয়ার হোসেন উত্তেজিত হয়ে বলেন, “সব জায়গায় তো গার্ড দেওয়া সম্ভব না।”
মোতায়েন করা দুই হাজার ৭০০ আনসার সদস্যের মধ্যে দুই হাজার সদস্য রেললাইনের নিরাপত্তায় এবং ৭০০ জন রেলওয়ের বিভিন্ন স্থাপনা ও যন্ত্রপাতির নিরাপত্তায় মোতায়েন করা হয়। এর মধ্যে ৭৩১ জন আনসার সদস্য মোতায়েন হয় শুধুমাত্র রেলওয়ের ঢাকা রেঞ্জের জন্য।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী বলেন, “আমি জানি নিয়োগ হয়েছে, কিন্তু কীভাবে কোথায় কে দায়িত্ব পালন করছে তা আমার জানা নেই। আমাদের কাজ ট্রেন চালানো, নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা পুলিশের দায়িত্ব।”
আনসার মোতায়েনের আগের নিরাপত্তা পরিস্থিতি
দুই হাজার ৭০০ আনসার সদস্য মোতায়েনের আগে পুলিশ, আনসার, র্যাব, রেল পুলিশ ও আরএনবির প্রায় ১০ হাজার সদস্য সারাদেশের ৩ হাজার ৪০০ কিলোমিটার রেলপথের নিরাপত্তা দিচ্ছিল।
রেল মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে ৩ হাজার ৪০০ কিলোমিটার রেলপথে ১২০টি আন্তঃনগর ট্রেন, তিন শতাধিক মেইল, লোকাল, কমিউটার ও ডেমু ট্রেন চলাচল করেছে। এর সঙ্গে ২০টি কন্টেইনারবাহী ও অয়েল ট্যাংকারবাহী ট্রেন চালু রয়েছে। এসব ট্রেনের মধ্যে মেইল, লোকাল ও কমিউটার ট্রেনগুলোর প্রতিটি কোচের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ একটি কোচের সঙ্গে অন্য কোচগুলোর সংযোগ দরজা নেই। এ কারণে এ ধরনের ট্রেনে নিরাপত্তা দিতে প্রতিটি কোচে পুলিশ বা আনসার মোতায়েন করতে হয়।
তবে প্রতিটি কোচে পুলিশ বা আনসার মোতায়েন করা সম্ভব না হওয়ায় নিরাপত্তা ঝুঁকি এড়াতে রাত্রিকালীন মেইল, লোকাল ও কমিউটার ট্রেনের ছয়টি ট্রেন চলাচল সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করেছিল রেলপথ অধিদপ্তর।