জানুয়ারির ২৬ তারিখ বিয়ের এক বছর পূর্তি হতো আসিফ-নাতাশা দম্পতির। যৌথ জীবনের এক বছর হওয়ার আগেই একা হয়ে পড়লেন আসিফ। বেনাপোল এক্সপ্রেসের ভয়াবহ আগুন নাতাশাকে কেড়ে নেয় আসিফের চোখের সামনেই।
ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নির্ধারিত ওয়ার্ডের বিছানায় শুয়েছিলেন আসিফ মোহাম্মদ খান। কথা বলছিলেন সকাল সন্ধ্যার সঙ্গে- “ধোঁয়াটা কালো ছিল, অসহ্য ছিল। শ্বাস নেওয়া যাচ্ছিল না। আমি পাশের জানালা ধরে খুলতে চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু পুরোটা খোলেনি।
“জানালা খোলার জন্য চাপাচাপি করলে আমার অর্ধেক শরীরের ওপরেই জানালাটা ‘ফিক্সড’ হয়ে যায়, সেখানেই আটকে যাই আমি। সামনেও যেতে পারি না, পেছনেও না।”
পেছনে তাকিয়ে আসিফ দেখেন, তীব্র ধোঁয়ায় নাতাশা অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন। “শেষ পর্যন্ত সে বাঁচতে চেয়েছিল, আমি তাকে বাঁচাতে পারিনি,” আক্ষেপ ঝরল আসিফের কণ্ঠে।
সেসময় জানালার ওপরে ঝুলে ছিলেন জানিয়ে আসিফ বলেন,“এক থেকে দেড় মিনিট জানালায় ঝুলে ছিলাম। তখনই ভয়াবহ আগুনটা আমার কাছে চলে আসে। আটকে থাকায় আমার কোমর থেকে নিচের সবটুকু পুড়ে যায়।
“চিৎকার শুনে কয়েকজন আমাকে টেনে বের করে, কীভাবে বের করেছিল, জানি না আমি। আর কিছুক্ষণ থাকলে হয়ত আমিও বাঁচতাম না।”
এই আগুনের মধ্যেও ট্রেনের জানালাগুলো যদি পুরোপুরি খোলা যেত তাহলে মানুষ বেঁচে যেত, এত পুড়তে হতো না বলেই মনে করেন আসিফ। তিনি বলেন, “সেটাও করা যায়নি। তবে এটা বলতে পারি, এ আগুন যেনতেন ছিল না, এটা অন্য কিছু ছিল।”
স্ত্রী নাতাশার মরদেহ এখনও পাননি আসিফ। বলেন, “পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কবে নাগাদ পাব, তাও জানি না।”
বিছানায় শুয়ে একা একা বলতে থাকেন আসিফ, “সাত মাস পর আমি চাকরি পেয়েছিলাম। সেটাও ওর জন্যই। চোখের সামনে বউটা পুড়ে গেল। আমি কিচ্ছু করতে পারিনি।”
বার্ন ইনস্টিটিউটের ১০ তলায় অবস্থিত নির্ধারিত কেবিনে অনুমতি নিয়ে ঢোকার পর দেখা যায় বিছানায় রোগী নেই। সৌম্য চেহারার এক নারী ফোনে কথা বলছেন। হেঁটে হেঁটে কথা বলছেন আর শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছেন। ফোনে কাউকে জানাচ্ছিলেন, “আমার ছেলেটা সুস্থ হচ্ছে। ডাক্তার বলেছেন, আর বেশিদিন থাকতে হবে না। ভগবানের কাছে আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।”
ফোনালাপ শেষে তার সঙ্গে কথা হলো সকাল সন্ধ্যার; জানা গেল, তিনি ডা. কৌশিক বিশ্বাসের মা অপর্ণা বিশ্বাস। বাড়ি ফরিদপুরে। সেই শুক্রবার ছেলে ফরিদপুর থেকে ঢাকা ফিরছিলেন বেনাপোল এক্সপ্রেসে।
সেদিনের ঘটনা স্মরণ করে তিনি বলেন, ট্রেন থেকে নেমে সে ফোন করে জানায়, ‘আমি ভালো আছি, চিন্তা করো না’।
প্রাণে বেঁচে গেলেও আগুনে কৌশিকের মুখ ঝলসে গিয়েছিল, ক্ষতিগ্রস্ত হয় শ্বাসনালীও। তবে শুরুতে মাকে তা জানাননি তিনি।
দুই ছেলে নিয়ে অপর্ণা বিশ্বাসের সংসার। একজন চিকিৎসক আরেকজন প্রকৌশলী। ঢাকায় থাকেন এলিফ্যান্ট রোডে। ভারী গলায় বললেন, “ওই আগুনের ভেতর থেকে আমার ছেলে বেঁচে ফিরেছে – এর থেকে ভাগ্যতো আর হয় না। এখনও ও ঘুমিয়ে থাকে, আমি ঘুমাতে পারি না, ছেলেকে দেখি। আমি কেবল ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।”
২০১৬ সালে স্বামীকে হারানোর পর দুই ছেলেকে নিয়ে শুরু হয় অপর্ণা বিশ্বাসের সংগ্রাম। “সেই ছেলে যদি আগুনে পুড়ে চলে যায়…” কথা শেষ হয় না এই মায়ের। ফের ধরে আসে গলা।
সামলে নিয়ে বলেন, “ছেলের তেমন ক্ষতি হয়নি, তাতেই এত কষ্ট লাগছে, আর যাদের স্বজন চলে গেছে – তাদের অবস্থা ভাবতেই পারছি না।”
কথা বলতে বলতেই হুইল চেয়ারে করে এলেন কৌশিক। বিছানায় বসে নিজের এক্সরে ফিল্ম নিজেই দেখতে লাগলেন, পাশের এক বন্ধুকেও দেখালেন। নিজেরা আলোচনা করলেন। কানে এলো – “অনেকখানি… এখনও, সময় লাগবে।”
এবার শোনার পালা সেদিনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার শিকার কৌশিক বিশ্বাসের কাছ থেকে। বরিশালের শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে এখন উচ্চ শিক্ষা নিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি বলেন, “সে এক অবস্থা.. এটা বর্ণনা করার মতো না। ট্রেনের ভেতরে থাকা যাত্রীরা আসলে বুঝবে না, কী ঘটে গেল!”
সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটের ট্রেনটির ‘চ’ বগিতে ছিলেন কৌশিক। স্মৃতিচারণ করে বলেন, “ট্রেন তখন যাত্রাবাড়ি ক্রস করেছে। কিছুক্ষণ পর ট্রেন খানিকটা ধীরগতির হলো। তখনই দেখতে পেলাম সামান্য, ছোট্ট একটা আগুন – একেবারেই ছোট্ট। সবাই তখন আগুন বলে চিৎকার করছিল। আগুন দেখে সঙ্গে থাকা ব্যাগসহ দাঁড়িয়ে গেলাম। আমি ছিলাম পেছনের দিকে, সামনের দিকে যারা ছিলেন তারাও সবাই দাঁড়ানো।”
তবে খুবই আশ্চর্যের বিষয়! বলতে থাকেন কৌশিক, “ধোঁয়া তো হয় সাদা, এই ধোঁয়া ছিল ব্ল্যাক, একদম পুরোপুরি কালো। সর্বোচ্চ ১০ সেকেন্ডের মতো। তারপর চারিদিক কালো হয়ে গেল। আমার মেডিকেল সায়েন্সের জ্ঞান বলছে, এটা কার্বন মনোঅক্সাইড। এই গ্যাসে নিঃশ্বাস নিলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব, আমি কিছুই তখন করতে পারব না। কিন্তু আমাকে তো বাঁচতে হবে।”
ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেন কৌশিক। তিনি বলেন,“ব্যাগসহ হাতের সবকিছু ফেলে জানালা দিয়ে শরীরের অর্ধেকটা বের করে দিলাম যেন বাতাসটা পাই। কোনওভাবেই যেন এই ধোঁয়া আমার ফুসফুসে না যায়…। তখন ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না, কেবল কালো ধোঁয়া ছাড়া। জীবনে এমন ধোঁয়া দেখিনি, একদম গাঢ় ধোঁয়া!”
তখনও ট্রেন চলছিল। এরই মধ্যে আগুন চলে এসেছে। কৌশিক বলতে থাকেন, “গায়ের গরম কাপড় খুলে ফেললাম, যেন জানালা দিয়ে বের হতে পারি। এরপর যখন ট্রেন থামবে থামবে অবস্থা…এক পা বের করে দিলাম। এরপর শরীরটা আরও টেনে বের করে কোনও রকমে সবার সহযোগিতায় বাইরে বের হই। প্রাণে বাঁচি।”
গত ৫ জানুয়ারি গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুন লাগে। এতে প্রাণ হারান চারজন। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন মো. তরিকুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ট্রেনে দগ্ধ হয়ে ১০ জন হাসপাতালে ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন আইসিইউতে রয়েছেন। আসিফ এবং কৌশিক এখন হাসপাতালে রয়েছেন। বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।