বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে দেওয়া আগুনে দগ্ধ ৮ জন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের কেউই শঙ্কামুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন।
শনিবার সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন ৮ জনের শরীর বাহ্যিকভাবে অনেক কম পুড়েছে। কিন্তু সবার শ্বাসনালীসহ ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেজন্য কাউকেই এই মুহূর্তে শঙ্কামুক্ত বলতে পারছি না। দগ্ধ দুই শিশুর অবস্থা তুলনামূলক ভালো হলেও তারা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।”
দগ্ধদের শারীরিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ হতে দীর্ঘদিন চিকিৎসা প্রয়োজন বলেও জানান সামন্ত লাল সেন। তিনি বলেন, “এরপর মানসিক চিকিৎসা দিতে হবে। কারণ তারা সবাই একটা ট্র্রমার মধ্যে রয়েছে।”
স্বজনদের আহাজারি
দগ্ধদের চিকিৎসা দিতে যখন ডাক্তাররা ছুটাছুটি করছেন, তখন আহতদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠছে বার্ন ইনস্টিটিউটের বাতাস।
এমনই একজন দগ্ধ আসিফ মোহাম্মদ খানের চাচা আবদুল হাই। পাশেই আসিফের বাবা আবু সিদ্দিকী দাঁড়িয়ে থাকলেও, কথা বলতে পারছিলেন না। যেন ছেলের শোকে পাথর হয়ে গেছেন তিনি।
আবদুল হাই বলেন, “ট্রেনের আগুনে আসিফের স্ত্রী নাতাশা নিহত হয়েছেন। ঢাকায় একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষকতা করতেন নাতাশা। ফরিদপুরের ভাঙ্গায় ঘুরতে গিয়েছিলেন তারা। আসার সময় ঘটে এই ঘটনা। স্ত্রীকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেছে আসিফ। কিন্তু জ্ঞান হারিয়ে ফেলায় পারেনি।
“পরে আশপাশের লোকজন আসিফকে টেনে বের করে। কিন্তু তার আগেই ২ পাসহ শরীরের ৮ শতাংশ পুড়ে যায়। চিকিৎসক জানিয়েছেন আসিফের সুস্থ হতে ২-৩ মাস সময় লাগবে।”
আরেক চাচা মির্জা আরাফাত বলেন, গত ২৬ জানুয়ারি বিয়ে করেছে আসিফ-নাতাশা। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ঘুরতে খুব পছন্দ করত। ঘুরতে গিয়েই একজনের প্রাণ গেল, আরেকজন হাসপাতালে। রাস্তায় ভাঙচুর-আগুনের ভয়ে নিজেদের গাড়ি না নিয়ে ট্রেনে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও বিপদ পিছু ছাড়ল না।
রোগী দেখে ফিরছিলেন ডা. কৌশিক
পাশে দাঁড়িয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিলেন দগ্ধ ডা. কৌশিক বিশ্বাসের মা অর্পনা বিশ্বাস। তাদের বাড়ি ফরিদপুরে, বর্তমানে বসবাস করেন ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে। আগুনে কৌশিকের পুরো মুখ ঝলসে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শ্বাসনালী।
অপর্না বিশ্বাস বলেন, কৌশিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক। সপ্তাহে একদিন ফরিদপুরে রোগী দেখতেন তিনি। শুক্রবারও রোগী দেখতেই ফরিদপুর গিয়েছিলেন। ফেরার পথে ঘটে এ ঘটনা।
প্রথম সাপ্তাহিক ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিলেন নাফিস
রোগীদের ওয়ার্ডের বাইরে বারান্দায় বসেছিলেন দগ্ধ নাফিস আলমের মামা মো. মামুন মিয়া। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, নাফিস ফরিদপুরের ভাঙ্গার বাকপোড়া গ্রামের মাসুদ আলমের ছেলে। মিরপুরের শেওড়াপাড়ার একটি মেসে থাকত সে । জানুয়ারিতেই যোগ দিয়েছে নতুন চাকরিতে। প্রথম সাপ্তাহিক ছুটি পেয়ে বাড়ি গিয়েছিল নাফিস।
ছেলের খোঁজে একবার মর্গে, একবার বার্ন ইনস্টিটিউটে
ছেলের খোঁজে একবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে আরেকবার বার্ন ইনস্টিটিউটে ছোটাছুটি করছিলেন আব্দুল হক। বেনাপোল এক্সপ্রেসেই ছিলেন তার ছেলে আবু তালহা(২৪)।
সৈয়দপুরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএসসি মেকানিক্যাল প্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন আবু তালহা।
আব্দুল হক জানান, ট্রেনে আগুনের খবর শোনার পরই ছেলের মোবাইলে কল করে বন্ধ পান। এরপর রাতেই ছেলের খোঁজে ফরিদপুর থেকে ঢাকায় আসেন। বার্ন ইনস্টিটিউটে ছেলেকে না পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে এসেছেন।
ট্রেনে নিহত ৪ জনেরই লাশ দেখেছেন আব্দুল হক। কিন্তু লাশগুলো চেনার কোনও উপায় নেই। তাই বুকে পাথর চেপে ডিএনএ টেস্টের স্যাম্পল দেওয়ার অপেক্ষা করছেন তিনি।
নিখোঁজ আবু তালহার ফেসবুক পেজে দেখা যায়, বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে ওঠার পর সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন তিনি। ট্রেন ভ্রমণ নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে লিখেছিলেন ‘প্রথমবার! অস্থির’।