গোপালগঞ্জের সীমান্তবর্তী মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলায় প্রায় ৯০ একর জমি রয়েছে সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মির্জার নামে। বেনজীর ২০২২ সালে অবসরে যাওয়ার এক মাস আগ পর্যন্ত মাত্র দুই বছরে কেনা হয় এসব জমি। ১১৩টি দলিলে কেনা এসব জমির বেশিরভাগই ফসলি।
বেনজীরের জমি-জমা ক্রোকে আদালতের আদেশ হওয়ার পর এই জমির আগের মালিকরা মুখ খুলতে শুরু করেছেন, যাদের বেশিরভাগই সনাতন ধর্মাবলম্বী। তাদের দাবি, আইজিপি থাকার সময় ওই জমি সস্তায় বিক্রি করতে তাদের বাধ্য করেছিলেন বেনজীর।
রাজৈরের কদমবাড়ি ইউনিয়নের সাতপাড় ডুমুরিয়া, নটাখোলা ও বড়খোলা মৌজায় জমি কেনা হয়েছে বেনজীরের স্ত্রীর নামে। ওই ইউনিয়নটি হিন্দু অধ্যুষিত।
কদমবাড়ি ইউনিয়নের আড়ুয়াকান্দি গ্রামের ভাষারাম সেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “২৪ একর ৮৩ শতাংশ ফসলি জমি আমাদের বংশীয় লোকদের। এই জমি সবটুকুই কিনে নেন সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ। বিঘা প্রতি সাড়ে ৩ লাখ টাকা দিয়েছেন। অথচ ওই জমির দাম আরও অনেক বেশি।
“প্রায় দুই বছর আগে ভয়-ভীতি দেখিয়ে এই জমি নেন বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবার। প্রথমে চারদিক থেকে জমি কিনে নেন তিনি, মাঝখানে আমাদের জমি থাকায় সেটা লিখে দিতে বাধ্য করেন।”
সাতপাড় ডুমুরিয়া গ্রামের স্বরস্বতী রায় নামে ৭০ বছরের এক বৃদ্ধা বলেন, তারা জমি বিক্রি করতে চাননি বলে ভয় দেখানো হয়েছিল।
“এই জমিতে ফসল হতো, লিখে নেওয়ায় আমাদের চাষাবাদ করার আর কোনও সুযোগ নেই। এই ফসলি জমিটুকু অনেক কষ্টে ধরে রাখছিলাম, কিন্তু সেটার আর শেষ রক্ষা হলো না। আমরা হিন্দু বলেই জোর করে সহজে জমি নিতে পারছে।”
বড়খোলা গ্রামের বাসিন্দা রসময় বিশ্বাসের কাছ থেকে ৩২ শতাংশ জমি কেনা হয়েছে জীশান মির্জার নামে। তিনি বিক্রিতে বাধ্য হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন।
কদমবাড়ির সুকবেদ বালার ছেলে অমল বালা বলেন, “আমাদের হুমকি-ধমকি দিয়েছেন বেনজীর আহমেদ। তার লোক দিয়ে বলেছেন, জমি লিখে না দিলে বিমানে করে বাড়িতে নামতে হবে, চার পাশ আটকে দেবেন। এমন অত্যাচারে অনেকেই জমি লিখে দিয়েছে।”
রাজৈর সাব রেজিস্ট্রার অফিসে খোঁজ নিয়ে ১১৩টি দলিলে ৯০ একর জমি বেনজীরের পরিবারের কেনার তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার ঠেঙ্গামারা মৌজায় ২০১৫ সালে ৫ কাঠা জমি কেনে বেনজীরের পরিবার।
বেনজির বিঘা সাড়ে ৩ লাখ টাকায় কিনলেও ওই এলাকার জমির প্রকৃত দর আরও এক-দেড় লাখ টাকা বেশি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় বাসিন্দা প্রণব বিশ্বাস বলেন, কদমবাড়ি ইউনিয়নের ডুমুরিয়া মৌজায় ৬২ শতাংশে এক বিঘা। প্রতি বিঘা জমির দাম সর্বনিম্ন সাড়ে চার লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, তৈয়ব আলী নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমেই এসব জমি কেনা-বেচা হয়েছে।
স্থানীয়দের কাছে ‘জমির দালাল’ হিসেবে পরিচিত তৈয়ব আলীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
গোপালগঞ্জের সন্তান বেনজীর দুই বছর আইজিপির দায়িত্ব পালনের পর ২০২২ সালে অবসরে যান। আইজিপির দায়িত্ব পালনের আগে তিনি র্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। তারও আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার ছিলেন।
সম্প্রতি কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে বেনজীরের বিপুল পরিমাণ অর্থ-বিত্তের মালিক হওয়ার অভিযোগ তোলা হয়। তারপর বেনজীরের সম্পদ অনুসন্ধানে আদালতে আবেদনও হয়। এরপর দুদকও তৎপর হয়।
পরে বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তালিকা জমা পড়ে আদালতে।
গত ২৩ ও ২৬ মে পৃথক দুইটি আদেশে বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জিশান মির্জা, তিন মেয়ে ফারহিন রিস্তা বিনতে বেনজীর, তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর ও জাহরা জারিন বিনতে বেনজীরের নামে বিভিন্ন সম্পত্তির দলিল, ঢাকায় ফ্ল্যাট ও কোম্পানির আংশিক শেয়ার জব্দের নির্দেশ দেয় ঢাকা মহানগরের সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালত।
আদেশের অনুলিপি থেকে জানা যায়, স্ত্রী সন্তানসহ সাবেক এই পুলিশ প্রধানের নামে দেশের বিভিন্ন জেলায় ২০২টা জমি ও ফ্ল্যাটের দলিল রয়েছে। এসব দলিলে জমি ও ফ্ল্যাটের মোট ক্রয়মূল্য লেখা রয়েছে ২৮ কোটি ৩০ লাখ ৮৩ হাজার টাকা।
এতো জমি কেনার টাকা জোগান দিতে দুর্নীতি হয়েছে কি না তা জানতে সাবেক আইজিপিকে স্বপরিবারের হাজির হতে তলব করেছে দুদক।
হিন্দুদের জমি বিক্রিতে বাধ্য করার অভিযোগ নিয়ে বেনজীরের বক্তব্য সকাল সন্ধ্যা জানতে পারেনি। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর তিনি সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলছেন। তবে সম্প্রতি ফেইসবুকে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় তিনি দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ওগুলো তাদের পারিবারিক সম্পত্তি।
বেনজীরের বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ করেছেন, তাদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি তুলেছেন মাদারীপুর আদালতের আইনজীবী আবুল হাসান।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “জোরপূর্বক কারও সম্পত্তি লিখে নেওয়া ফৌজদারি অপরাধ। ভুক্তভোগীরা চাইলে মামলা করতে পারেন।
“আর সাবেক পুলিশ প্রধানের পরিবারের নামে এত সম্পত্তি কেনা নজিরবিহীন। এ ঘটনায় দলিল গ্রহীতাদেরও আইনের আওতায় আনা হোক। প্রান্তিক কৃষকদের জমি তাদের ফিরিয়ে দেয়া হোক।”
মাদারীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি মাসুদ পারভেজ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সাবেক আইজিপির বাড়ি গোপালগঞ্জে। কিন্তু তার বাড়ির সীমান্ত এলাকা মাদারীপুরের রাজৈরের কদমবাড়িতে বিপুল পরিমাণে সম্পত্তি কেনা আমাদের অবাক করেছে।
“উনি যে এলাকায় জমি ক্রয় করেছেন, সেই এলাকা একটি হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। অধিকাংশ হিন্দুদের জমি তিনি জোর করে কিনেছেন। হিন্দু পরিবারগুলো ভয়ে জমিগুলো তাকে দিতে বাধ্য হয়েছেন।”
তিনিও বলেন, “জমির মূল্য দিলেও কাউকে ভয় দেখিতে ফসলি জমি লিখে নেওয়া চরম অন্যায় কাজ। এর বিচার হওয়া উচিৎ। জমির মালিকদের জমি ফিরিয়ে দেওয়া উচিৎ।”