শত শত নদ-নদী, ষড়ঋতু আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের এ ব-দ্বীপের বেশিরভাগটাই গঠিত পলি মাটি দিয়ে। তবু ভৌগলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে ছোট্ট এ বাংলাদেশেও আঞ্চলিক স্থাপত্যচর্চা নানামাত্রিক। হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা বাংলার গ্রামীণ স্থাপত্যচর্চায় জলবায়ুর সাথে লৌকিক বিজ্ঞান ও স্থানীয় প্রাজ্ঞমতবাদ যেমন গভীরভাবে সম্পর্কিত তেমনি আধুনিক স্থাপত্যচর্চার জন্যও সেসব অনুসরণীয়। বাংলাদেশের আঞ্চলিক তথা গ্রামীণ স্থাপত্যের বহুমাত্রিকতা নিয়ে লিখেছেন স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ তাসলিহা মওলা।
‘‘দক্ষিণ দুয়ারী ঘরের রাজা
উত্তর দুয়ারী তাহার প্রজা,
পূর্ব দুয়ারির ভাত নাই
পশ্চিম দুয়ারির মুখে ছাই।’’
খনার এই বচনের মতোই লোকজ জ্ঞানের নানা প্রবাদ-প্রবচন বাংলার গ্রামীণ স্থাপত্যবিদ্যায় আজকের সময়েও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। খনার বচনে উল্লেখ থাকা আবহাওয়া বিষয়ক পংক্তিগুলো বাংলাসহ বিহার ও উড়িষ্যা অঞ্চলের অনেকটা জুড়েই প্রায় একইরকমভাবে প্রযোজ্য। ভৌগলিক অবস্থানের সাপেক্ষে আবহাওয়া-পরিবেশের বিষয়টি স্থাপত্যবিদ্যার সাথে যুক্ত ওতোপোত্রভাবে।
উল্লেখিত খনার বচনের প্রথম পংক্তিতে মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য দক্ষিণ দিকের দরজা থাকা ঘর-বাড়ির কথা বলা হয়েছে। বাংলার ভূ-প্রকৃতি ও আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্যের কারণে দক্ষিণমুখী বাড়িতে সরাসরি আসতে পারে মুক্ত আর সতেজ আলো-বাতাস।
এ খনার বচন থেকেই জানা যায়, ঘর-বাড়ি উত্তরমুখী হলে আলো-বাতাসের সঠিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়— দক্ষিণমুখী ঘর-বাড়ির সাথে তুলনা করে বলা হয়েছে এ কথা। আবার পশ্চিমমুখী হলে দুপুরের পর থেকে সূর্যের আলোর তাপে ঘরে থাকাই দায় হয়ে পড়ে বাসিন্দাদের। একইভাবে পূর্বমুখী ঘর-বাড়িতে আলো-বাতাস আসে কম, বৃষ্টিতে যায় ভিজে। এমন ঘর-বাড়ি মানের দিক থেকে উৎকৃষ্ট নয় বলে তাদের কাছ থেকে খাজনাও সংগ্রহ করা হতো না বলে ঐতিহাসিকরা জানিয়েছেন।
বাংলার মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই রোদ, ঝড়, বৃষ্টি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সহাবস্থান করে আসছে। এর মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া অভিজ্ঞতা রূপান্তরিত হয়েছে বিদ্যায়। কৃষিভিত্তিক বাংলার সমাজে প্রকৃতির সাথে সহাবস্থান করে মানুষের দৈনন্দিন জীবন-যাপন অর্থপূর্ণ করার উপায়ের কথা বলা হয়েছে খনার বচনে।
এসব বচন, উক্তি বা কথামালা থেকে বোঝা যায়, এ অঞ্চলের মানুষ নানান প্রবাদ-প্রবচন মেনে যে গ্রামীণ স্থাপত্যের ধারা বজায় রেখেছে তা খুবই বিজ্ঞানসম্মত এবং সত্যিই অসাধারণ। আমাদের বাড়ি বা ঘরগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ক্লাস্টার প্ল্যানিং বা গুচ্ছ পরিকল্পনায় এমনভাবে ঘরগুলোর স্থান নির্ধারিত হয়— যেন দক্ষিণ বা দক্ষিণ পূর্বদিক কোনওভাবেই কোনও স্থাপনা দিয়ে বাধাপ্রাপ্ত না হয়। এতে করে বাতাস দক্ষিণ দিক দিয়ে প্রবেশ করে খোলা দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। চারপাশ আবদ্ধ থাকায় সেখানে একটা ‘এয়ার ফানেলিং’ হয়। ফলে বাতাসের চলাচল থাকে।
আদিতে মানুষ থাকত গুহায়। ধীরে ধীরে তারা পর্ণকুটিরে বসবাস শুরু করল। সেই হাজার হাজার বছর আগের মানুষ বিবর্তিত হয়ে পরিণত হয়েছে আজকের আধুনিক মানুষে। তেমনি তাদের আবাসস্থলেও এসেছে পরিবর্তন। পৃথিবীর একেক অঞ্চলের আবহাওয়া একেকরকম হওয়ায় ঘরবাড়ির ধরনেও আছে বৈচিত্র্য। অঞ্চলভেদে আবহাওয়া, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপত্যের ধরনের যে ভিন্নতা, তাকেই আমরা বলি ‘Vernacular Architecture’ বা ‘আঞ্চলিক স্থাপত্য’।
স্থাপত্যের এই আঞ্চলিক চর্চা হয়ে আসছে যুগযুগ ধরে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, আধুনিক স্থাপত্যে যত ব্যাকরণ, গণিত, অর্থনীতি, জলবায়ু, আবহাওয়া, পরিবেশ, শিল্প বা বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের চর্চা করা হয়, আঞ্চলিক স্থাপত্যেও তা খুব সুচারুরূপে করা হয়ে থাকে। অবশ্য অঞ্চলভেদে তার রকমফের আছে। কিন্তু সকল আঞ্চলিক স্থাপনার উদ্দেশ্যগুলো একই থাকে— তা হলো টেকসই কাঠামো, আবহাওয়া ও জলবায়ুর সাথে খাপ খাওয়ানো, আরামদায়ক পরিবেশ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যার সাথে আধুনিক শহুরে স্থাপত্যের উদ্দেশ্যের কোনও ফারাক নেই।
বাংলাদেশের আঞ্চলিক স্থাপত্য নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তাই অবাক না হয়ে উপায় থাকে না। আমাদের গ্রামীণ স্থাপত্যের নির্মাণশৈলী আসলে হাজার বছর ধরে চলে আসা পরম্পরা, যার সাথে শুধু জলবায়ুই নয় বরং লৌকিক বিজ্ঞান, স্থানীয় প্রাজ্ঞমতবাদ ইত্যাদি আরও বহুকিছু জড়িত। গ্রামীণ বাংলায় মূলত কয়েকটি একক ঘরের সমন্বয়ে হয় একটি বাড়ি। চারদিকে থাকে ঘর, মাঝখানে উঠান– এই হলো আমাদের গ্রামীণ স্থাপত্যের মূল পরিকল্পনা। যাকে কেতাবি ভাষায় বলা হয় ‘Cluster Housing’।
যদিও কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রাম– গ্রামীণ পরিবেশ। অর্থনীতির উন্নতির সাথে সাথে স্বাভাবিকভাবেই বদলে যাচ্ছে আর্থ-সামাজিক কাঠামো। মানুষ ঝুঁকছে দালানবাড়ির দিকে। ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে শুরু করেছে একচালা, দোচালা ও চৌচালা ঘর কিংবা একগুচ্ছ ঘরের মাঝখানে থাকা উঠান। সেই নিকোনো উঠানের মায়া কি আর দালানবাড়িতে মেলে?
আমাদের এই স্বল্প আয়তনের দেশটি একটি ব-দ্বীপ, যার প্রায় পুরোটাই গঠিত হয়েছে নদীবাহিত পলি মাটি দিয়ে। পুরো দেশটি জুড়ে আছে ছোটবড় নাম না জানা শত শত নদী। নদী বিধৌত ও ষড়ঋতুর এ দেশটি দুর্যোগপ্রবণ। বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় আমাদের অঞ্চলের প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
আবহাওয়া, দুর্যোগ, রোদ-জল-হাওয়ার খেলা– এসব বিবেচনা করেই এ অঞ্চলের ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়ে আসছে আদিকাল থেকে। বিশ্বের খুব কম দেশেই আঞ্চলিক স্থাপত্য ও নির্মাণ শৈলীর এমন বৈচিত্র্য দেখা যায়।
ছোট আয়তনের দেশ হলেও এখানে বাতাসের চলাচল ও গতিবেগে আছে ভিন্নতা। উপকূলীয় অঞ্চলের আর হাওর অঞ্চলের বায়ুর প্রকৃতি ভিন্ন, তাই এই দুই অঞ্চলের ঘরবাড়ির নকশাতেও আছে ভিন্নতা। আবার বরেন্দ্র অঞ্চলের ঘর-বাড়ি আর পার্বত্য অঞ্চলের ঘর-বাড়ির মধ্যেও আছে পার্থক্য।
বাংলাদেশে অধিকতর কম বৃষ্টিপ্রবণ এলাকায় যেমন দেখা যায় মাটির বাড়ি, তেমনি প্লাবনভূমিতে গড়ে ওঠা বাড়িগুলো তৈরি হয় উঁচু ঢিবি বা মাচার উপর। কোনও এলাকার ঘরের চালা/চাল অপেক্ষাকৃত নিচু হয়, অনেক এলাকায় আবার চাল হয় উঁচু– পুরো ব্যাপারটাই বাতাসের গতিবেগের ওপর নির্ভর করে।
এ দেশের অনেক অঞ্চলেই মাটির বাড়ি দেখা যায়। তবে সাধারণত স্বল্প বৃষ্টিপাত হয় এমন এলাকায় বেশি দেখা যায় মাটির বাড়ি। মোটা মাটির দেয়ালের এ বাড়িগুলো সব ধরনের আবহাওয়ার জন্যই আরামদায়ক। অত্যধিক শীতে মাটির ঘরের ভেতরটা থাকে উষ্ণ। এ জন্যেই দেশের উত্তরবঙ্গের বেশকিছু জায়গায় মাটির ঘর দেখতে পাওয়া যায়।
উত্তরাঞ্চল সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০-৫০ ফুট উঁচুতে আর বরেন্দ্রভূমির মাটিও যথেষ্ট শক্ত হওয়ায় এ অঞ্চলে বাংলাদেশের মোট মাটির বাড়ির প্রায় ষাটভাগ দেখতে পাওয়া যায়। মাটির ঘরের নির্মাণ উপকরণ প্রধানত এঁটেল মাটি, খড়কুটো, বাঁশ ও কাঠ। ছাউনি দেওয়ার কাজে ছন, টিন ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। মাটির ঘর তৈরির কারিগরদের বলা হয় ‘দেল বারুই’।
গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, ময়মনসিংহ জেলার বেশ কিছু জায়গায়ও এখনও মাটির ঘর দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু অংশে মাটির ঘর দেখতে পাওয়া যায় তবে সংখ্যায় সেগুলো অনেক কম।
এ ধরনের ঘরে জানালার অবস্থান ভূমিসমতল থেকে কিছুটা উপরে এবং পুরু মাটির দেয়ালের ভেতরের দিকে থাকে। দরজাও একইভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়ে থাকে, যার ফলে সরাসরি রোদ প্রবেশ করতে পারে না এবং বৃষ্টি থেকেও ঘরের ভেতরটা রক্ষা পায়। মাটির ঘরের দেয়াল পুরু হলেও জানালার অবস্থানের কারণে এতে আলো-বাতাসের চলাচল পর্যাপ্ত থাকে।
শুধু আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়ানোই নয়, এসব বাড়িগুলোতে দেখা যায় নান্দনিকতা ছোঁয়া। উত্তরবঙ্গের বহু মাটির বাড়ির দেয়ালে গৃহিণীরা আল্পনা আঁকেন অবসর সময়ে। অসাধারণ শিল্পশৈলীর সে কাজ এদেশের গ্রামীণ মানুষের শিল্পীস্বত্তার পরিচয় বহন করে। উত্তরাঞ্চলসহ দেশের অনেক জায়গায় মাটির দোতলা বাড়িও দেখা যায়।
বন্যাপ্রবণ অঞ্চলগুলোর বাড়ি সাধারণত উঁচু ভিটের উপর তৈরি করা হয়। ভিটে তৈরির কাজে পুকুর সেঁচা মাটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এর কারণ হলো, বন্যার সময় যেন ঘরের মেঝে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে না যায়। এ ধরনের বাড়িগুলোর দেয়াল বেড়া বা ঢেউটিন দিয়ে ঘেরা থাকে। অনেক জায়গায় একচালা ছাদ দেওয়া হয় যেন বন্যার পানি বেড়ে গেলে ছাদের উপর গিয়ে আশ্রয় নেওয়া যায়।
আবার উপকূল অঞ্চলের ঘরবাড়ির ছাদ হয় নিচু নিচু যেন বাতাসের গতি বাড়ির ক্ষতি করতে না পারে। দুবলার চর, শরণখোলা– এসব অঞ্চলে সাধারণত ছনের ছাউনি ব্যবহার করা হয়। ছোটখাটো সাইক্লোন বা জলোচ্ছ্বাসের সময় তারা সেসব ছাউনি খুলে ফেলে যেন ভেলা বানিয়ে ভেসে থাকতে পারে।
সুন্দরবন অঞ্চলে দেখা যায় গোলপাতার ঘর। বাওয়ালী, কাঠুরেরা এসব ঘর বানিয়ে থাকে। সুন্দরী কাঠের খুঁটির ওপর নির্মিত ঘরগুলো জোয়ারের পানি থেকে রক্ষা করে তাদের সহায় সম্বল। পাহাড়ি এলাকায়ও দেখা যায় মাচা ঘর। মূলত মাচার উপরে এসব ঘর তৈরি হয়ে থাকে। মূল উপাদান থাকে বেড়া ও বাঁশ, উপরে টিন বা ছনের ছাউনি। এছাড়াও বাঁশের কাঠামো দিয়ে চারপাশ বেড়ায় ঘেরা, উপরে ছন বা টিনের ছাউনি।
ছাউনির কাঠামো একচালা, দোচালা বা চৌচালা যাই হোক, ছন আর টিনের ব্যবহারই দেখা যায় বেশি। তবে এখন অভিজাতরা বাড়িতে টিনের ছাদ ব্যবহার করলেও আমাদের আবহাওয়ার জন্য ছন মানানসই উপকরণ। ছনের ঘরে চৈত্র-বৈশাখের গরমে যেমন স্বস্তিদায়ক পরিবেশ থাকে, তেমনি পৌষ-মাঘের শীতে ঘরের ভেতরে থাকে উষ্ণ। এখন গ্রামের সাধারণ মানুষ ঘরের ছাদে খড় ব্যবহার করলেও আগের আমলে অভিজাতরাও দোচালা, চৌচালা যেকোনও কাঠামোতেই ছন ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন।
এক সময়ে বনজঙ্গলে ছনের গাছ পাওয়া যেত, এছাড়া ছনের চাষও করা হয়। যারা ছনের কাজ করে তাদের বলা হল ‘ছাফরবন্ধ’। তারা বিশেষ কায়দায় কয়েক ধাপে ছন বাঁশ ও বেত দিয়ে বেঁধে ছাদ তৈরি করত। বাঁধার সময় তারা পানি ছিটাতো ছনের উপর, এতে করে বাঁশের কাঠামোর সাথে ছন খুব ভালোভাবে বসে যেত। ধারণা করা হয়, পানি ছিটানোর কারণে বাতাসের আর্দ্রতা ধরে রাখার এক বিশেষ ক্ষমতা ছনের ছাউনিতে থাকে। প্রাকৃতিক গঠনগত কারণ এবং নির্মাণশৈলী উভয়ের জন্যই ছনের ঘরের ভেতরটা খুব আরামদায়ক থাকে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায়।
গ্রামীণ স্থাপত্যের নির্মাণ শৈলী এবং নির্মাণ উপকরণ তাই আবহাওয়ার সাথে গভীরভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। জল-হাওয়ার বিষয়টিও গ্রামীণ স্থাপত্যে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। এছাড়া আমাদের দেশে বছরের বেশিরভাগ সময় সূর্যালোকের আধিক্য থাকে।
একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে– জানালার অবস্থান নির্ণয় করার যে সর্বজনীন পরিমাপ আমাদের আধুনিক শহুরে স্থাপত্যে ব্যবহার করা হয়, তা আমাদের গ্রামীণ স্থাপত্যের ক্ষেত্রে অনেকটাই ভিন্ন। মূলত জানালার অবস্থান রোদের তীব্রতার ওপর নির্ভর করে।
বরেন্দ্র অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হলেও শীত ও গরমের আধিক্য বেশি দেখা যায়। এজন্য সেখানকার ঘর-বাড়ির জানালাগুলো মাটি অর্থাৎ সমতল থেকে অনেকটা উপরে স্থাপন করা হয় যেন সূর্যের তাপ সরাসরি প্রবেশ করতে না পারে। এক্ষেত্রে জানালাগুলো পুরু মাটির দেয়ালের ভেতরের দিকে স্থাপন করা হয়, আবার জানালার অবস্থান উপরের দিকে হওয়ায় ছাদের বর্ধিত অংশ সানশেডের কাজ করে। তাই সূর্যের প্রখর আলো সরাসরি না ঢুকে অনেকটা ‘ডিফিউজড’ হয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে বিধায় ঘর আলোময় হলেও তাপের আধিক্য থাকে না।
এছাড়া অন্যান্য অঞ্চলে যেমন— বরিশাল, বরগুনা, পিরোজপুর এসব এলাকায় জানালা বরেন্দ্র অঞ্চলের চেয়ে অপেক্ষাকৃত নিচুতে স্থাপন করা হয়। এর কারণ হিসেবে আমরা পাই, ওই অঞ্চলের গাছপালার আধিক্যের কারণে ঘরবাড়ি ছায়াঘেরা থাকায় আবহাওয়া ঠান্ডাও থাকে। আর দক্ষিণাঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়, বাতাসের আর্দ্রতাও থাকে বেশি। তাই দক্ষিণাঞ্চলের বাড়িগুলোতে বাতাস আটকে না রেখে বরং বায়ু চলাচলের সুব্যবস্থা রাখা হয়।
বরিশাল অঞ্চলের কাঠের বাড়ির সুনাম দেশ জুড়ে। কাঠের দোতলা বাড়িগুলো মজবুত কাঠামোর উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। কাঠের এ কাঠামোর উপরে থাকে টিনের চাল। কাঠের বাড়িগুলোতে থাকে বারান্দা। বারান্দার ঝুলে আবার নকশা কাটা থাকে। সে ঝুলগুলো দিনের বেলা বা চাঁদনী রাতে যে আলো-ছায়ার নকশা তৈরি করে, সেটি নিঃসন্দেহে সেই ঘরের বাসিন্দাদের বিমোহিত করে তোলে।
বরিশাল অঞ্চলের কাঠের বাড়ি ছাড়াও খুলনায় আছে ছাদে মাটির টালির বাড়ি। পটুয়াখালীর দিকে দেখা যায় বাঁশ ও বেতের চৌচালা ঘর, যার চালাগুলো ঢেউটিন দিয়ে তৈরি করা হয়। আবার বিক্রমপুরে তো আস্ত টিনের ঘরই কিনতে পাওয়া যায়। ‘প্রি-ফেব্রিকেটেড’ বা তৈরি সেসব বাড়ির নির্মাণ শৈলীও অসাধারণ।
তবে মাটির ঘর হোক বা কাঠের, বেড়ার ঘর বা টিনের, গ্রাম-বাংলার ঘরগুলো কিন্তু আলো হাওয়ার বাধাহীন চলাচল নিশ্চিত করে এসেছে স্থাপত্য ও বিজ্ঞানের তত্ত্ব। গ্রাম-বাংলার মানুষরা কীভাবে এ জ্ঞান রপ্ত করেছিল– এ নিয়ে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করে থাকেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই যে, প্রকৃতিই এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় তাত্ত্বিক জ্ঞানের আকর।
গ্রামীণ স্থাপত্যে রোদ-বৃষ্টি-মেঘ থেকে বাঁচাতে যত ধরনের ব্যবস্থা দরকার সেটি নেওয়া হয়ে থাকে। কালের বিবর্তনে এই গ্রামীণ বাড়িগুলো প্রায় বিলুপ্তই হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের শেকড় তো সেই পল্লীবাংলায়। এই নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের আবহাওয়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে অঞ্চলভেদে যে ঘর-বাড়ি এখনও তৈরি করা হয়— সেটিই আমাদের নিজস্ব স্থাপত্যরীতি। গ্রামীণ স্থাপত্যের বৈচিত্র্যময়তা এত বেশি, এত অভাবনীয় তার নির্মাণশৈলী যে– নিঃসন্দেহে সেগুলো বাংলার ঐতিহ্য ও সম্পদ।
অবশ্য যুগের সাথে সাথে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থান বদলায়। মানুষ একটু ‘ভালোভাবে’ থাকার চেষ্টায় ছন-বেড়ার ঘর বাদ দিয়ে গড়ে তোলে ইট-সিমেন্টের দালানবাড়ি। পুরো বিশ্বেই যখন এমন হচ্ছে, এ দেশে তার ব্যতিক্রম হবে এমনটা আশা করা বোকামি।
এমন প্রেক্ষাপটে এই সময়ে স্থাপত্যের ধরণ বদলে গেলেও— জল, হাওয়া ও আলোর বিষয়ে আমাদের ঐতিহ্যগত বাস্তুরীতি কীভাবে আধুনিক ভবন নকশা ও নির্মাণে আরোপ করা যায় সেদিকে যত্নবান হতে হবে। এতে কৃত্রিম আলো ও বাতাসের প্রয়োজন কমে যাবে অনেকটা। সূর্যের আলোর যথাযথ ব্যবহার, বাতাসের উপর্যুপরি ও অবাধ চলাচল– এ দুই কমিয়ে দেবে যান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীলতা, সাশ্রয় হবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির।
আজকাল সবুজ স্থাপনা বা ‘Green Building’ নিয়ে অনেক আলোচনা ও চর্চা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব যত বাড়ছে, ততই বেড়ে চলেছে সবুজ স্থাপত্যের প্রয়োজনীয়তা। আমাদের বিচিত্র ধরনের আঞ্চলিক স্থাপত্যগুলো কিন্তু সবুজ স্থাপত্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
সাম্প্রতিক সময়ে গৃহহীনদের জন্য ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’-এর মতো পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের কাজ হাতে নেওয়া হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে যে এসব প্রকল্পে স্থান, আবহাওয়া, সংস্কৃতি নির্বিশেষে তৈরি করা হচ্ছে একই ধরনের পাকা দালান। অন্ততঃ এসব ঘর তৈরির ক্ষেত্রেও অঞ্চলভেদে প্রচলিত স্থাপত্যের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা গেলে একদিকে যেমন তা পরিবেশের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ হতো, অন্যদিকে নির্মাণ ব্যয়ও কিছুটা কম পড়ত।
পৃথিবীর অনেক দেশে দুর্যোগ প্রবণ এলাকা বা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এমন নজিরও আছে যে, আঞ্চলিক স্থাপত্যরীতি অনুসরণ করে তৈরি ভবন আধুনিক স্থাপত্যরীতিতে তৈরি ভবনের তুলনায় দুর্যোগ মোকাবিলায় তুলনামূলকভাবে বেশি সক্ষম, অথবা এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম।
গ্রামবাংলার এ অসাধারণ স্থাপত্যশৈলী, এই লোকবিজ্ঞান ও লোকস্থাপত্যের চর্চা একেবারে হারিয়ে যেতে দেওয়া উচিত নয়। বরং স্থপতি ও সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসতে হবে এ ঐতিহ্য সংরক্ষণে। লোকজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির উপযুক্ত মিশেলই পারে টেকসই স্থাপত্য-নির্মাণশৈলীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
লেখক: স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ।
ইমেইল: [email protected]