রক মিউজিক মানেই গিটার। একটি আরেকটির সমার্থক। ব্লুজ থেকে কান্ট্রি, যত জনরার পত্তন আর বিকাশ দেখেছে সারা দুনিয়া, তার সবকটিকে গণমানুষের কাছে নিয়ে গেছে এই গিটার। গিটার কখনও কথা বলেছে কালো হেন্ড্রিক্স এর হয়ে; গিটার তখন মাতাল সার্কাসম্যান। আবার গিটার কখনও কথা বলেছে বিবি কিং এর আঙ্গুলে। গিটার তখন নোটে নোটে খেলা ম্যাজিক। তাকে দেখে এবং শুনে উপলব্ধি করতে হয়।
অনন্য এ বাদ্যযন্ত্রটির কথা বললেই মনে পড়ে যায় দুনিয়া কাঁপানো সব গিটারিস্টদের নাম। সঙ্গীত বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘ডিসকভার মিউজিক’ সর্বকালের সেরা ৭৫ গিটারিস্টদের একটি তালিকা সম্প্রতি প্রকাশ করেছে। সেখান থেকে সেরা ১০ নিয়ে এই লেখাটি।
১০
জর্জ হ্যারিসন
পপ ঘরানায় ‘বিটলস’-এর দক্ষতা তাদের পাণ্ডিত্য প্রায়ই ঢেকে দিত। এর জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ জর্জ হ্যারিসন। সদা নিরিবিলি এই কিংবদন্তি যখন যতটুকু দরকার ঠিক ততটুকুই বাজাতেন। তার গিটার ‘বিটলস’ এর সাউন্ড এর অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছিল। ব্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যালবাম ‘অ্যাবি রোড’ প্রকাশের পর ভেঙ্গে যায় ব্যান্ডটি। এই অ্যালবামে জর্জ হ্যারিসন আগের অ্যালবামগুলোর চাইতে যেন আরও বেশি উজ্জ্বল ছিলেন। মহান এই শিল্পী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বেঁধেছিলেন গান। নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে লক্ষ শ্রোতার সামনে গেয়েছিলেন ‘বাংলাদেশ’ গানটি। তার এই গানে বাংলাদেশে যুদ্ধ এবং গণহত্যার ভয়াবহতা উঠে আসে।
৯
জেফ ব্যাক
ব্রিটিশ গিটারিস্ট জেফ ব্যাকের প্লেয়িং স্টাইল হেভি মেটাল এবং জ্যাজ রক ঘরানাকে দারুণ প্রভাবিত করে। ছিলেন এরিক ক্লেপটনের ব্যান্ড ‘দ্য ইয়ার্ডবার্ডস’ এর সদস্য। তবে ক্লেপটন যেবার ব্যান্ড ছেড়ে দেন, সে বছর জেফ ব্যাক যুক্ত হন ব্যান্ডটিতে। সময়টা ১৯৬৫। অবশ্য ঠিক পরের বছর ছেড়ে দিয়ে গড়ে তোলেন নিজের ব্যান্ড ‘দ্য জেফ ব্যাক গ্রুপ’। ব্লুজ ঘরানায় গিটারের ‘ওভারড্রাইভ’ এর ব্যবহার জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে ব্যান্ডটির বিশেষ ভূমিকা আছে।
রোলিং স্টোন ম্যাগাজিনের বিবেচনায় জেফ ব্যাক ‘সময়ের সবচাইতে প্রভাব বিস্তারকারী গিটারিস্টদের একজন’।
৮
স্টিভ ক্রুপার
স্টিভ ক্রুপারকে বলা হয় পৃথিবীর সেরা রিদম গিটারিস্ট। গিটার সলো বাজানোর ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অসাধারণ। গিটার সলো, রিদম এবং গ্রুভি প্লেয়িং সব মিলিয়ে তার একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছিল।
ধারণা করা হয়, কিংবদন্তি গিটারিস্ট জিমি হেন্ড্রিক্স-এর স্টাইলে তার প্রভাব ছিল। যদিও এই ধারণাকে ক্রুপার একেবারে উড়িয়ে দেন।
৭
জিমি পেইজ
কিংবদন্তি ব্রিটিশ রক ব্যান্ড ‘লেড জেপলিন’ এর গিটারিস্ট জিমি পেইজ। এই পরিচয়েই তিনি বিশ্বব্যাপী পেয়েছেন পরিচিতি। গিটার রিফ- এর অন্যতম উদ্ভাবক বলে তাকে গণ্য করা হয়। গিটারিস্ট হিসেবে তিনি বিশ্বনন্দিত। পাশাপাশি নিজেকে মিউজিক প্রডিউসার হিসেবেও পরিচয় দিতে ভালোবাসেন।
বিবি কিং তাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৯৮০ সালে ব্যান্ড ‘লেড জেপলিন’ ভেঙ্গে যাওয়ার পর সেশন মিউজিশিয়ান হিসেবে তিনি কাজ করেছেন বহু কিংবদন্তির মিউজিশিয়ানের সঙ্গে। মজার ব্যাপার হলো, জিমি পেইজের সমসাময়িক মিউজিশিয়ান বন্ধুরা প্রায় সকলেই তার মতই কিংবদন্তি। এই তালিকায় আছেন জেফ ব্যাক থেকে শুরু করে এরিক ক্লেপটনসহ আরও অনেকেই।
‘লেড জেপলিন’ এর আইকনিক গান ‘স্টেয়ারওয়ে টু হ্যাভেন’ সহ ব্যান্ডটির বেশিরভাগ গানের দুর্দান্ত হয়ে উঠার পেছনে সিংহভাগ অবদান পেইজের।
৬
সিস্টার রোজেটা থার্প
শৈশবে তার গিটারের হাতেখড়ি। মাত্র চার বছর বয়সে শুরু করেন বাজানো। রোজেটা থার্প এর বয়স যখন মাত্র ছয় তখন মায়ের সঙ্গে চার্চে গসপেল সঙ্গীতের দলে যুক্ত হন। সেই গসপেল দলের সঙ্গে মা আর মেয়ে মিলে ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা আমেরিকা।
বড় হতে হতে রোজেটা জ্যাজ এবং ব্লুজ মিউজিকে প্রভাবিত হলেন। আরকানসো ছেড়ে ১৯২০ সালে যখন শিকাগোতে থিতু হলেন, ততদিনে উঁচুমানের জ্যাজ এবং ব্লুজ গিটারিস্ট হয়ে উঠেছেন। তার গসপেলের পারফর্ম্যান্সেও জ্যাজ ব্লুজের প্রভাব পড়তে শুরু করলো।
১৯৪৫ সালে তার গান ‘স্ট্রেঞ্জ থিংস হ্যাপেনিং এভ্রিডে’ পায় জনপ্রিয়তা। তার অসাধারণ গিটার প্লেয়িং যেন কান্ট্রি, জ্যাজ আর গসপেলের সীমারেখা মুছে দিয়েছিল। স্বতন্ত্র এই জনরাগুলোকে তার অসাধারণ দক্ষতায় মিশেল ঘটাতেন থার্প।
৫
এরিক ক্লেপটন
কিংস্টন আর্ট কলেজের ছাত্র এরিক ক্লেপটন গিটার হাতে নেন কিশোর বয়সে। সেই ষাটের দশকে গিটারিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন দুটো ব্যান্ডে। একটির নাম ‘ইয়ারবার্ডস’ আরেকটি ‘রিদম অ্যান্ড ব্লুজ’। পরে ১৯৬৬ সালে গঠন করেন রক ব্যান্ড ‘ক্রিম’। তারকাখ্যাতি এখান থেকেই।
রক এবং ব্লুজের ফিউশনে সারাবিশ্বে জনপ্রিয়তা পায় ব্যান্ড ‘ক্রিম’। ব্লুজ প্লেয়িং- এ ক্লেপটন অসামান্য মুন্সিয়ানা তাকে অনেকের কাছেই ‘গিটার গড’-এ পরিণত করে। আজও বহু তরুণের কাছে ক্লেপটন গিটার আইডল।
৪
বিবি কিং
‘ব্লুজের রাজা’ বলে সারাবিশ্ব যাকে চেনে, তার নাম বিবি কিং। তার বেড়ে ওঠা মোটেই সহজ ছিল না। তার গল্পটা আর দশজন কৃষ্ণাঙ্গ গ্রেট মিউজিশিয়ানদের মতোই।
জন্মেছিলেন দারিদ্র আর বৈষম্যের মাঝে। শৈশবে-কৈশোরে তার পরিবারের ন্যূনতম চাহিদা মেটানোরও সামর্থ্য ছিল না। এমন অবস্থার মাঝেই শৈশবের অমিত প্রতিভাধর এই শিল্পী একদিন হয়ে উঠলেন ব্লুজ গিটারিস্টদের সেরাদের সেরা।
কথায় আছে, কষ্ট মানুষের সেরাটা বের করে আনে। হয়তো দারিদ্রের সঙ্গে শৈশবের নিরন্তর সংগ্রাম তাকে মহান করে তুলেছিল। বিংশ শতকের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ গিটারিস্টদের একজন বলা হতো তাকে। যতদিন বেঁচে ছিলেন, মঞ্চ মাতিয়ে গেছেন। জীবদ্দশায় তার চাইতে ব্যস্ত গিটার আর্টিস্ট খুব বেশি কেউ ছিল না।
“থ্রি ও’ক্লক ব্লুজ’ ছিল তার প্রথম হিট ট্র্যাক। প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে।
৩
ওয়েস মন্টগমেরি
ওয়েস মন্টগমারি তার ভিন্ন ধরনের গিটার প্লাকিং এর জন্য নজর কেড়েছিলেন। জ্যাজ মিউজিকের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নাম, মন্টগমারিকে বলা হয় জন্মগত প্রতিভাবান শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম সেরা।
১৯৬৫ সাল পর্যন্ত মন্টগমারির রেকর্ডিংগুলোতে ছিল সৌল জ্যাজ, হার্ড বপ এবং পোস্ট বপ-এর প্রভাব। তবে পরবর্তী সময়ে এক ভিন্ন মন্টগমরিকে পাওয়া গেল। পপ ঘরানার দিকে ঝুঁকে পড়েন এই গিটার মায়েস্ত্রো। এ পথে তার সাফল্যও আসে।
আরও পরে, জ্যাজ ফিউশন এবং স্মুথ জ্যাজ জনরায় ওয়েসলি মন্টগমেরি গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
২
চাক বেরি
রক মিউজিকে একটি কথা বেশ প্রচলিত। সেটি হলো “রক অ্যান্ড রোল হলো ব্লুজের সন্তান।” আর ব্লুজের গর্ভে রকের জন্ম মুহূর্তের ক্ষণটি হলো চাক বেরির ‘মেইবিলিন’ গানটি।
বেরিকে বলা হতো গিটার সলোর ‘মাস্টার’। ছোট ছোট সলো বাজিয়ে মুগ্ধ করে রাখতেন তিনি শ্রোতাদের। অবশ্য তার লম্বা গিটার সলোগুলো শুনতে চাইলে বেরির অ্যালবাম ‘কনসার্টো ইন বি গুড’ শোনা যেতে পারে।
জানা যায়, ‘কিং অব রক অ্যান্ড রোল’ খ্যাত এলভিস প্রিসলি, নিজেই ছিলেন চাক বেরির ভক্ত। বেরির এক লাইভ শোতে এলভিস তাকে দেখিয়ে বলেছিলেন “রক অ্যান্ড রোলের আসল রাজা।”
১
জিমি হেন্ড্রিক্স
জিমি হেন্ডরিক্সের মতো গিটারিস্ট যে রক মিউজিক আর কখনোই পাবেনা এ কথা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবে। গিটারের স্কিলে জিমি হেন্ড্রিক্স যেন শেষ কথা। তার হাতে গিটার পেয়েছিল বৈচিত্র্য। গিটারের সাউন্ড নিয়ে নানান নিরীক্ষা করেছিলেন তিনি।
ব্লুজ গিটারিস্ট এরিক গেইলস একবার বলেছিলেন, জিমি হেন্ড্রিক্স অদ্বিতীয়ই থাকবেন। কারণ গিটারের নতুন সব সাউন্ড উদ্ভাবন করে বাদ্যযন্ত্রটির সম্ভাবনা এক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যান হেন্ড্রিক্স।
জিমি হেন্ড্রিক্স আজও মহাসমারোহে চর্চিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। তার উত্থান রক মিউজিকের অভিমুখ নির্ধারণ করে দেয়। আজও ব্লুজ রকপ্রেমী তরুণদের কাছে হেন্ড্রিক্স অনুপ্রেরণা।