অর্থ সংকটে পড়ে ঠিকমতো রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না, তাই এক্ষেত্রে পুনরায় ঋণ সুবিধা চালুর আবেদন করেছে দেশের আলোচিত শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো।
গত বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের চারজন উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে দেওয়া এক চিঠিতে এই আবেদন করেছে বেক্সিমকো গ্রুপ।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের কাছে এই চিঠি পাঠিয়ে সুবিধা চেয়েছে বেক্সিমকো টেক্সটাইল ও অ্যাপারেল বিভাগ।
বেক্সিমকো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওসমান কায়সার চৌধুরী সই করা ওই চিঠিতে বলা হয়, চলতি সেপ্টেম্বর মাসের বেতন বাবদ কর্মীদের আগামী ৮ অক্টোবরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন হবে ৬৫ কোটি টাকা। বর্তমানে প্রত্যাবাশিত রপ্তানি আয় এবং আগামী ৬ অক্টোবর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির অর্জিত রপ্তানি আয় থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ কর্তন করে সেপ্টেম্বর মাসের বেতনের প্রয়োজনীয় তহবিল জোগানের অনুরোধ জানানো হয়েছে কোম্পানিটির পক্ষ থেকে।
গত আগস্ট মাসে জনতা ব্যাংক থেকে কর্মীদের বেতন-ভাতা দেওয়ার জন্য ৫৫ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করেছে বেক্সিমকো লিমিটেড।
চিঠিতে বলা হয়, আগস্ট মাসে শ্রমিকদের মজুরি দিতে ৬৯ কোটি ৫ হাজার টাকা দরকার ছিল। জনতা ব্যাংক সে লক্ষ্যে ৫৫ কোটি টাকা ঋণ দেয়। বাকি অর্থ কাঁচামাল আমদানির জন্য আলাদা করে রাখা তহবিল থেকে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বেক্সিমকো গ্রুপের নিয়মিত ঋণসুবিধা বন্ধ থাকায় সেপ্টেম্বর মাসের মজুরি পরিশোধ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
চিঠিতে শিল্পের উৎপাদন ও কর্মসংস্থান অব্যাহত রাখতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করে বেক্সিমকো গ্রুপ বলছে, সরকারের এই ঘোষণা আমাদের উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
এই শিল্পগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৪০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান আছে; প্রতিষ্ঠানটি গত ১৪ মের পর জনতা ব্যাংক থেকে কোনও ঋণসুবিধা পায়নি বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
চিঠিতে অভিযোগ করা হয়েছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে দেশে সরকার পরিবর্তন এবং যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাতে তাদের রপ্তানিমুখী পণ্য ও পোশাক শিল্প ও সংশ্লিষ্ট সব অবকাঠামোতে ব্যাপকভাবে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এ কারণে, তাদের কোনও চলতি মূলধন অবশিষ্ট নেই, যা দিয়ে তারা রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
গ্রাহকরা ইতিমধ্যেই ক্রয়াদেশ বিকল্প গন্তব্যে সরিয়ে নিচ্ছে এবং সক্ষমতার তুলনায় এখন কম ক্রয়াদেশ রয়েছে বলে চিঠিতে শিল্পগোষ্ঠী উল্লেখ করেছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, আমরা প্রতিষ্ঠানের সম্ভাব্য বিক্রয় এবং আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত নগদ অর্থ প্রাপ্তির যে প্রক্ষেপণ করেছি, তা দিয়ে বিদ্যমান স্তরের ব্যয় (শ্রমিক মজুরি, কর্মকর্তার বেতন, শক্তি, লজিস্টিক এবং প্রশাসনিক) মেটানো সম্ভব হবে না। এরকম পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে প্রতিষ্ঠানটি তাদের গ্রাহক হারাবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
এই পরিস্থিতি সামাল দিতে বেক্সিমকোর সামনে দুটি পথ খোলা রয়েছে। প্রথমত, প্রাসঙ্গিক ব্যয় কমানো এবং দ্বিতীয়ত, ব্যবসা ব্রেক ইভেন পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত শ্রমিকদের ধরে রাখা। প্রতিষ্ঠানটি আশা করছে, তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে এবং আগামী বছরের জানুয়ারির মধ্যে ব্রেক ইভেন পয়েন্টে ফিরে আসবে।
তবে সে জন্য তারা জনতা ব্যাংক থেকে কিছু ঋণসুবিধা পাওয়ার আবেদন করেছে চিঠিতে। চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত যত দেনা আছে, তা একটি সুদবিহীন ব্লক হিসাবে রাখা এবং দুই বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ পরবর্তী ১০ বছরে এই টাকা পরিশোধের সুযোগ চেয়েছে তারা।
এছাড়া প্রয়োজনীয় ব্যাক টু ব্যাক এলসি চালু রাখা, ১০ শতাংশ টাকা জমা দিয়ে (মার্জিন) বস্ত্র ও আনুসাঙ্গিক পণ্য আমদানির বিল ডিসকাউন্টিং সুবিধা দেওয়া, ১৫ শতাংশ সুদে প্যাকিং সুবিধা দেওয়া এবং রপ্তানি থেকে পাওয়া আয় থেকে সুদ ও অন্যান্য চার্জ বাদ দিয়ে বাকি ঋণের অর্থ প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ছাড় করার সুবিধা চেয়ে আবেদন করেছে বেক্সিমকো।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর ১৩ অগাস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানকে গ্রেপ্তার করার কথা জানায় পুলিশ। পরে একাধিক হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নেওয়া হয়। এখন তিনি কারাগারে আছেন। তার ব্যাংক হিসাব জব্দ ও বেক্সিমকো গ্রুপের ব্যাংক হিসাবের তথ্য তলব করা হয়।
গত জুন শেষে জনতা ব্যাংক থেকে বেক্সিমকো গ্রুপের নেওয়া মোট ঋণের পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধনের প্রায় ৯৫০ শতাংশ। নিয়ম অনুযায়ী, একক ঋণগ্রহীতাকে ব্যাংকগুলো তাদের পরিশোধিত মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিতে পারে না। সেখানে জুন শেষে জনতা ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাব খাটিয়ে ঋণ বের করে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে বেক্সিমকোর কর্ণধার সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে। তবে সরকারের ঘনিষ্ট হওয়ায় এ বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।
জনতা ব্যাংক বেক্সিমকো গ্রুপের মালিকানাধীন ৩০টি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে। এই ৩০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৬টি একক ঋণগ্রহীতার সীমা লঙ্ঘন করেছে।