ফুটবল থেকে একটা সময় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল দর্শকরা। কিন্তু কিছুদিন হলো রাকিব হোসেন, শেখ মোরসালিনদের ছোঁয়ায় খানিকটা সুরভী ফিরেছে ফুটবলে। বিশেষ করে বসুন্ধরা কিংস অ্যারিনায় ফুটবল ম্যাচ মানেই যেন উপচে পড়া গ্যালারি। উদযাপনে উন্মাতাল দর্শকেরা। রঙিন ধোয়ায় আচ্ছন্ন চারপাশ।
ফুটবল বাংলাদেশের মানুষের কাছে বরাবরই আবেগের দ্বিতীয় নাম। বিশ্বকাপ এলে যে উত্তাপটা টের পাওয়া যায় ভালোভাবেই। অথচ সেই ফুটবলেই বাংলাদেশ কতখানি এগিয়েছে? বিশেষ করে কাজী সালাউদ্দিন সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আদৌ কি এগিয়েছে বাংলাদেশের ফুটবল? নাকি যেখানে ছিল সেখানেই আটকে আছে!
র্যাঙ্কিং কী বলে
কাজী সালাউদ্দিন প্রথম দফায় নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০০৮ সালের ২৮ এপ্রিল। এরপর আরও তিন বার নির্বাচিত হয়ে বসেছেন ফুটবলের সর্বোচ্চ প্রশাসনের চেয়ারে। তিনি যখন নির্বাচিত হন, ওই মাসে ফিফা কোনো র্যাঙ্কিং প্রকাশ করেনি।
কিন্তু এর পরের মাসে অর্থাৎ ২০০৮ সালের মে মাসের ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৮০। বর্তমানে বাংলাদেশের ফিফা র্যাঙ্কিং ১৮৩। কিন্তু এক সময় বাংলাদেশের ফিফা র্যাঙ্কিং ২০০ ছুঁইয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ২০১৭ সালে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ ছিল ১৯৭তম স্থানে, যা কিনা বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সর্বনিম্ন র্যাঙ্কিং।
দক্ষিণ এশিয়াতেই সেরা হতে পারেনি
সাফ চ্যাম্পিয়নশিপকে বলা হয় দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্বকাপ। আঞ্চলিক এই ফুটবল টুর্নামেন্টে এক রকম অঘোষিত রাজা ভারত। এ পর্যন্ত হওয়া ১৪টি আসরের মধ্যে ৯ বার চ্যাম্পিয়ন প্রতিবেশী দেশটি। ভারত নিয়মিত খেলে এশিয়ান কাপে। অথচ বাংলাদেশ সাফেই চ্যাম্পিয়ন হতে পারে না ১৯ বছর।
সাফে সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ ২০০৩ সালে। কাজী সালাউদ্দিন সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার ১৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সাফল্য দুবার সেমিফাইনালে ওঠা। সালাউদ্দিনের আমলে সব মিলিয়ে ৮ বার সাফে খেলেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে সেমিফাইনালে উঠতে পারে- ২০০৯ ও ২০২৩ সাফে। আর গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছে পাঁচবার। ২০২১ সালে রাউন্ড রবিন লিগ পদ্ধতির খেলা হয়। সেবার ৫ দলের টুর্নামেন্টে চতুর্থ হয় বাংলাদেশ।
সালাউদ্দিন আমলের ম্যাচ পরিসংখ্যান
টুর্নামেন্ট | ম্যাচ | জয় | ড্র | হার |
সাফ | ২৬ | ৮ | ৮ | ১১ |
বঙ্গবন্ধু কাপ | ৯ | ৪ | ১ | ৪ |
বিশ্বকাপ বাছাই | ২৪ | ৪ | ৭ | ১৩ |
ফিফা ফ্রেন্ডলি ও অন্যান্য | ৬২ | ১৬ | ১৮ | ২৮ |
মোট | ১২২ | ৩২ | ৩৪ | ৫৬ |
* বঙ্গবন্ধু কাপে অতিথি জাতীয় দলের ম্যাচগুলোকেই ধরা হয়েছে।
* অন্যান্য : এশিয়ান কাপ বাছাই, এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপ, মারদেকা কাপ, চার জাতি আসর, রয়্যাল চ্যালেঞ্জ কাপ, ইত্যাদি।
বিশ্বকাপ বাছাইয়েও তথৈবচ
কাজী সালাউদ্দিন নির্বাচিত হওয়ার পর বিশ্বকাপ হয়েছে চারটি। প্রতিটি বিশ্বকাপেই বাছাইপর্বের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় দল। কিন্তু অভিজ্ঞতা কখনোই সুখকর হয়নি।
২০১০ বিশ্বকাপ : সেবার বিশ্বকাপ বাছাইয়ের প্রথম রাউন্ডে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল তাজিকিস্তান। ঘরের মাঠে ১-১ গোলে ড্র। দ্বিতীয় ম্যাচে তাজিকিস্তান গিয়ে ৫-০ গোলে হার। ফলাফল প্রাক-বাছাইপর্ব থেকে বিদায়।
২০১৪ বিশ্বকাপ : প্রথম রাউন্ডে ঢাকায় পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩-০ গোলের জয়। পাকিস্তানে গোলশূন্য ড্র। যার ফলে বাংলাদেশ কোয়ালিফাই করে দ্বিতীয় রাউন্ডে। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে বাংলাদেশের মাটিতে লেবাননকে ২-০ গোলে হারালেও অ্যাওয়ে ম্যাচে হার ০-৪ ব্যবধানে। এবার বাছাই পর্বে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বিদায়।
২০১৮ বিশ্বকাপ: বাছাইয়ের প্রথম রাউন্ডে ৮ ম্যাচের ৭টিতে হার। একটি মাত্র ড্র। সব মিলিয়ে ৩২ গোল হজম করে বাংলাদেশ। বিপরীতে বাংলাদেশ প্রতিপক্ষকে গোল দেয় দুইটি।
এর আগে প্রাক বিশ্বকাপ বাছাইয়ের বৈতরণী কোনোরকমে পার হয় বাংলাদেশ। লাওসের বিপক্ষে রবিউল হাসানের একমাত্র অ্যাওয়ে গোলের কারণে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে খেলার সুযোগ পায়। ‘হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে’ ম্যাচ দুটিতে প্রথমে ঢাকায় গোলশূন্য ড্র। এরপর লাওসে রবিউলের মহামূল্যবান গোলের সুবাদে বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে খেলতে পারে বাংলাদেশ।
২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর এশিয়ান কাপ ফুটবলের প্রাক বাছাই পর্বে ভুটানের কাছে ৩-১ গোলে হেরে যায় বাংলাদেশ। ফুটবলের ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কিত ভুটান ট্র্যাজেডির কারণে প্রায় ১৮ মাস নির্বাসনে থাকে বাংলাদেশের ফুটবল।
২০২২ বিশ্বকাপ : বাছাইয়ে ৮ ম্যাচে বাংলাদেশ গোল খেয়েছে ১৯টি। গোল করে ৩টি। ৬ হারের পাশাপাশি ২ ড্র।
২০২৬ বিশ্বকাপ : প্রাক বাছাইয়ে মালদ্বীপের সঙ্গে অ্যাওয়ে ম্যাচে ১-১ গোলে ড্র। এরপর হোমে ২-১ গোলের জয়। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে এ পর্যন্ত হয়েছে দুটি ম্যাচ। অস্ট্রেলিয়ার কাছে অ্যাওয়ে ম্যাচে ৭-০ গোলের হার, ঘরের মাঠে লেবাননের সঙ্গে ১-১ গোলের ড্র।
বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপেও হতাশা
কাজী সালাউদ্দিন দায়িত্ব নেওয়ার ৭ বছরের মাথায় বাফুফে আয়োজন করে প্রথম বঙ্গবন্ধু কাপ। সব মিলিয়ে হয়েছে এর ৪টি আসর। বিভিন্ন দেশের জাতীয় দল, বয়সভিত্তিক দল ও ক্লাব দল এই টুর্নামেন্টে খেললেও কখনোই বাংলাদেশের ভাগ্যে শিরোপা জোটেনি। সর্বোচ্চ সাফল্য ২০১৫ সালে রানার্স আপ। আর ২০১৬, ২০১৮ ও ২০২০ বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নেয় বাংলাদেশ।
১২২ ম্যাচে ৩২ জয়
২০০৮ সালে কাজী সালাউদ্দিন বাফুফে সভাপতি হওয়ার পর থেকে গত ২১ নভেম্বর ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন টুর্নামেন্ট, বিশ্বকাপ বাছাই ও ফিফা ফ্রেন্ডলি মিলিয়ে ১২২টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে। এর মধ্যে ৩২টি জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। হেরেছে ৫৬ টিতে। আর ড্র হয়েছে ৩৪ ম্যাচ।
এসব পরিসংখ্যান বলছে কাজী সালাউদ্দিনের আমলে ফুটবলের অবস্থা মোটেও সুবিধার নয়। কোনো ট্রফি নেই, সুরভিত ফুটবল নেই। সালাউদ্দিনের ১৫ বছর কেটেছে ফুটবল হাহাকারে। তার ১৫ বছরের এই সময়কালে বাংলাদেশ ১২২ টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে জিতেছে ৩২ টি। প্রতি বছরে জিতেছে মাত্র দুটো ম্যাচ ! ফুটবলের এমন কঠিন প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে কী বড় স্বপ্ন দেখার সুযোগ আছে !