বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা দেশ মিয়ানমারের ভেতরে কী হচ্ছে, সে সম্পর্কে কিছুই জানেন না নাফ নদীর এপারের মানুষ। তারা কেবল গোলাগুলির শব্দ শুনছেন, আকাশে দেখছেন হেলিকপ্টারের চক্কর আর মাঝে মাঝে সীমান্ত ভেদ করে উড়ে আসছে কিছু বুলেট ও মর্টারের গোলা।
এমন অবস্থায় তীব্র আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন কক্সবাজারের টেকনাফের হোয়াইক্যংসহ সীমান্ত এলাকার মানুষ।
পরিস্থিতি দেখতে রবিবার (২৮ জানুয়ারি) সংশ্লিষ্ট সীমান্ত পরিদর্শন করেছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান।
বিজিবির কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক কর্নেল মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম চৌধুরী জানিয়েছেন, শনিবার (২৭ জানুয়ারি) থেকে রবিবার পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে ছোড়া ১৩টি মর্টার শেল ও একটি বুলেট বাংলাদেশের মাটিতে এসে পড়েছে।
তিনি বলেন, “মিয়ানমারের অভ্যন্তরে মিয়ানমার আর্মি ও বিজিপির সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘর্ষ চলমান। এ পরিস্থিতিতে শনিবার থেকে এসব শেল ও বুলেট বাংলাদেশে পতিত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে বিজিবি’র পক্ষ হতে বিজিপিকে প্রতিবাদলিপি পাঠানো হয়েছে।”
বিজিবি’র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান মিয়ানমারের ছোড়া মর্টার শেল ও বুলেট বাংলাদেশের যেখানে পড়েছে সেসব স্থান পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করেছেন বলে জানান তিনি।
মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “তিনি পালংখালী, তুমব্রু, হোয়াইক্যং বিওপি পরিদর্শন করে মিয়ানমারের চলমান সংঘর্ষ এবং প্রতিপক্ষের বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন। পাশাপাশি বিজিবিকে সীমান্ত এলাকায় সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে উৎসাহও দেন।”
সীমান্তে বসবাসকারি নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিজিবি প্রধান যখন হোয়াইক্যং এলাকায় অবস্থান করছিলেন তখন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের আকাশে চক্কর দিচ্ছিল হেলিকপ্টার। একই সঙ্গে থেমে থেমে গোলাগুলির শব্দও পাওয়া যাচ্ছিল।
টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর আহমেদ আনোয়ারী বলেন, “মিয়ানমারের ভেতরে কী হচ্ছে বলা মুশকিল। তবে কয়েকদিন ধরে বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছে। মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল ও বুলেট বাংলাদেশের ভেতরে এসেছে। উলুবনিয়ার সীমান্তের কাছাকাছি রবিবার বেশ কয়েকবার হেলিকপ্টার চক্কর দিতে দেখা গেছে। এসব ঘটনায় সীমান্তের মানুষ উদ্বিগ্ন।”
একই ভাবে ঘুমধুম সীমান্তেও হেলিকপ্টারের চক্কর দেখার কথা ও গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শফিকুল ইসলাম। সেখানেও সীমান্তের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে জানান তিনি।
মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে কী হচ্ছে তা জানতে সকাল সন্ধ্যার এই প্রতিবেদক কথা বলেছেন দেশটির মংডু শহরের কাছের গ্রাম সোজাপাড়ার এক রোহিঙ্গা নাগরিকের সঙ্গে।
তিনি জানিয়েছেন, মিয়ানমারের রাখাইন ও চিন রাজ্যের অধিকাংশ এলাকা এখন আরকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। যেখানে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান করতেই হামলা শুরু করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। ফলে কয়েকদিন ধরে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এসব গ্রামে গোলাগুলি, আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। রোহিঙ্গারাও নিরাপদ স্থানের আশায় গ্রাম ছাড়ছেন। এরই মধ্যে মংডু শহরের দলিয়াপাড়া, সোজাপাড়া এলাকায় আগুন দেওয়া হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসকারি মাস্টার মোহাম্মদ রফিক স্থানীয় ভাষায় দেওয়া আরাকার আর্মির বিবৃতি পড়েছেন। সেই বিবৃতির তথ্য, রাখাইন থেকে পাওয়া ছবি ও স্থানীয়দের পাঠানো তথ্যের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, “বিদ্রোহীদের সশস্ত্র লড়াই ক্রমাগত তীব্র হয়ে উঠছে। বিদ্রোহীরা একে একে সেনা বাহিনীর ক্যাম্প দখল করে নিচ্ছে। আত্মসমর্পন করছে সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য।”
তিনি জানান, মিয়ানমারে যে সব বিদ্রোহী সংগঠন লড়াই করছে তাদের মধ্যে আরকান আর্মি, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি ও টিএনএলএ মিলে একটি ঐক্যবদ্ধ জোট গঠন করেছে। এরপর থেকে লড়াই তীব্র হয়েছে।
আরাকান আর্মির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিটুয়ের কাছে পাকতাউ শহরের অধিকাংশ সামরিক ঘার্টি এবং চীন সীমান্তে পালেতওয়া শহরে সেনাদের নোনেনবু ঘাঁটি তাদের দখলে রয়েছে।
মিয়ানমারের চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতির প্রভাব পড়েছে বাণিজ্যেও।
সবশেষ গত ২৬ ডিসেম্বর সকালে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ ও শুকনা সুপারিবাহি ট্রলার এসেছিল। টানা ৪২ দিন বন্ধ থাকার পর আকিয়াব বন্দর থেকে আসা ওই ট্রলারটিতে ১২০ মেট্রিকটন পেঁয়াজ ও ৮০ মেট্রিকটন শুকনা সুপারি ছিল।
এরপর নতুন করে আর কোনও পন্যবাহী ট্রলার টেকনাফ স্থলবন্দরে আসেনি বলে জানিয়েছেন টেকনাফ স্থলবন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) মো. জসিম উদ্দিন চৌধুরী।